শংকর লাল দাশ, স্টাফ রিপোর্টার, গলাচিপা ॥ সাগরপাড়ের জেলা পটুয়াখালীতে এবার মুগ ডালের বাম্পার ফলন হয়েছে। যা গতবছরের তুলনায় অনেক বেশি। ঘূর্ণিঝড় ফণীতেও মুগ ডালের তেমন একটা ক্ষতি হয়নি। বরং ফণী পরবর্তী কড়া রোদের কারণে মুগ ডালের পরিপক্কতা আগেভাগে এসে গেছে। তাই কৃষাণ-কৃষাণীরা ক্ষেত থেকে মুগ ডাল তোলার কাজে কোমর বেঁধে মাঠে নেমে পড়েছে। তুলনামূলক বাজারে মুগ ডালের দামও মিলছে ভাল। জেলার কোন কোন এলাকা থেকে জাপানেও যাচ্ছে পটুয়াখালীর মুগ ডাল। যা মুগ চাষীদের জন্য সুফল বয়ে এনেছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের পটুয়াখালী কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, এবার জেলার ৮ উপজেলায় ৮৭ হাজার ৭০৬ হেক্টর জমিতে উচ্চ ফলনশীল ও স্থানীয় জাতের মুগের চাষ হয়েছে। এর মধ্যে বাউফল উপজেলার মুগ ডালের চাষ হয়েছে সবচেয়ে বেশি। এখানে ১৮ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে মুগ ফসলের আবাদ হয়েছে। সদর উপজেলায় আবাদ হয়েছে ১৭ হাজার ৩৫৬ হেক্টর, রাঙ্গাবালী উপজেলায় ১৫ হাজার ৫০০ হেক্টর, গলাচিপায় ১৫ হাজার হেক্টর, দশমিনায় ১২ হাজার ৮০০ হেক্টর, দুমকিতে তিন হাজার ৮৫০ হেক্টর, মির্জাগঞ্জে তিন হাজার ৫০০ হেক্টর ও কলাপাড়ায় এক হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে মুগ ফসলের আবাদ হয়েছে।
ঘূর্ণিঝড় ফণীর প্রভাবে ঝড় বৃষ্টিতে জেলায় তিন হাজার ৮৯৪ হেক্টর জমির মুগডাল কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এরপরেও সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন এবার জেলায় অন্তত এক লাখ পাঁচ হাজার ২৪৭ মেট্টিক টন মুগ ডাল উৎপন্ন হবে। যা গতবছরের তুলনায় অনেক বেশি। গতবছর জেলায় ৭৪ হাজার ৮০৭ হেক্টর জমিতে মুগ ডালের আবাদ হয়েছিল। এতে উৎপাদন হয়েছিল ৮৯ হাজার ৭৬৮ মেট্টিক টন। সংশ্লিষ্টদের হিসেবে দেখা যাচ্ছে, প্রতিবছরই পটুয়াখালী জেলায় মুগ ডালের চাষক্রমে বাড়ছে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, মুগ ডাল চাষে তুলনামূলক খরচ কম। উৎপাদন বেশি। মুনাফাও অনেক বেশি। এছাড়া, গত কয়েক বছর ধরে জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে সুদূর জাপানে মুগ ডাল রফতানি হচ্ছে। যা মুগ চাষীদের জন্য আশীর্বাদ বয়ে এনেছে।
বিষয়টি স্বীকার করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের পটুয়াখালীর উপ-পরিচালক হৃদয়েশ্বর দত্ত বলেন, পটুয়াখালীতে প্রতিবছরই মুগ ডালের বাম্পার ফলন হচ্ছে। আমন ফসল ওঠার পরই জমি চাষ দিয়ে বীজ ফেলে কৃষক। এখানকার কৃষক ক্ষেতে তেমন একটা সার ব্যবহার করে না। শুধু কীটনাশক ব্যবহার করে। এছাড়া মুগ ফসল আবাদে কৃষক সবদিক থেকে লাভবান হচ্ছে। বিশেষ করে মুগ ফসল আবাদের ফলে গাছের শেকড়ে রাইজরিয়াম নামের এক ধরনের ব্যাকটেরিয়ার জন্ম হয়। যা মাটির গুণাগুণ বাড়াতে সহায়তা করে। এতে করে পরবর্তী আবাদে কৃষকের রাসায়নিক সারের ব্যবহার অনেকাংশে কমে যাচ্ছে।
এদিকে, জেলার কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ঘূর্ণিঝড় ফণী পরবর্তী তাপপ্রবাহ মুগ ডালের জন্য যথেষ্ট সুফল বয়ে এনেছে। মুগ ডাল দ্রুত পরিপক্বতা লাভ করেছে। যে কারণে কৃষাণ-কৃষাণীরা এখন ক্ষেত থেকে মুগ ডাল তোলায় ব্যস্ততায় সময় কাটাচ্ছে। গলাচিপা উপজেলার চরবিশ্বাস গ্রামের ইউপি মেম্বার জামাল হোসেন জানান, গত কয়েক বছরে এ এলাকায় মুগ ডাল চাষের ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটেছে। স্থানীয় সম্পন্ন চাষী নাসির বিশ্বাস বলেন, এখানকার চাষীরা আমন চাষের পর এখন আর কেউ এক ইঞ্চি জমিও ফেলে রাখতে চাইছে না। অধিকাংশই মুগ ডালের চাষ করছে। কয়েকটি ক্ষেত ঘুরে দেখা গেছে, ক্ষেত থেকে মুগ ডাল তোলায় পুরুষদের চেয়ে নারীরাই বেশি এগিয়ে এসেছে। দক্ষিণ চরবিশ্বাস গ্রামের গৃহবধূ শেফালী রানী হাওলাদার বলেন, যাদের নিজের জমি নেই, তারা অন্যের জমির মুগ ডাল তুলছে। এক মণ মুগ ডাল তুললে ৫-৬ সের ডাল মজুরি মিলছে। তাই এখানকার নারীরা এখন আর ঘরে বসে থাকতে চাইছে না।
যে কোন মুহূর্তে বর্ষা আসতে পারে, সে আশঙ্কাতেও অনেকে দ্রুত ক্ষেত থেকে ডাল তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তাই মুগ ডালের ক্ষেতগুলোতে এখন কৃষাণীদের ভিড় যেন উপচে পড়ছে। যেখানে চোখ যায়, সেখানেই নারীরা মুগ ডাল তোলায় ব্যস্ত সময় পার করছে। পটুয়াখালী সদর উপজেলার কালিকাপুর ইউনিয়নের শারিকখালী গ্রামের কৃষক কাসেম চৌকিদার জানান, মুগ ফসলে আবাদে খরচ কম। দাম পাওয়া যায় ভাল। এ বছর তিনি ২ একর জমিতে মুগ আবাদ করেছেন। খরচ হয়েছে মোট ১০ হাজার টাকা। এখান থেকে তিনি ১২ মণ ডাল পাবেন। বিক্রি হবে ৩০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। একই গ্রামের কৃষক সুরেশ মিস্ত্রি জানান, বন্যার আগে অনেকে ক্ষেত থেকে এক দফা ডাল ঘরে তুলছে। ফণীর প্রভাবে বৃষ্টির পানি ক্ষেতে জমলেও তা আবার দ্রুত নেমে যাওয়ায় ক্ষতির পরিমাণ কম হয়েছে। এখন দ্রুত ক্ষেত থেকে ডাল ঘরে তুলতে পারলে ক্ষতির আশঙ্কা আরও অনেক কমে যাবে। যে কারণে মুগ চাষীরা ডাল তোলার জন্য ক্ষেতে বাড়তি লোক নামিয়ে দিয়েছে।