ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

জনতার অনলকুসুম

প্রকাশিত: ১০:৩০, ১৭ মে ২০১৯

জনতার অনলকুসুম

উপমহাদেশের রাজনৈতিক অস্থিরতাকে মাথায় নিয়ে উনিশ শ’ ছাব্বিশের মধ্য আগস্টে যার জন্ম তার কলম দিয়ে দ্রোহ আর বিক্ষোভের অগ্নিস্ফুলিঙ্গের জন্ম হওয়াই স্বাভাবিক। নচেত ম্যালেরিয়ায় পর্যুদস্ত হয়ে, যক্ষ্মারোগের ক্ষয়ে জীবনের দীপ যার নিভে যায় দীপ্যমান কুশে তার কবিতায় কোমল প্রেমের পঙ্ক্তিমালাই হয়ত মন ভরাত কোটি কোটি তরুণ-তরুণীর। প্রেম যে সুকান্তর জীবনে আসেনি তা নয়। তার পরও সে প্রেম তার কলমে কোমল আবেগের নহর বইয়ে দেয়নি তা কেবল ওই মুমুক্ষু সময় আর বুভুক্ষু রাজনীতির কারণে। যে কিশোর জন্মেই দেখে ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি, যে কিশোর জাপানী বোমার সাইরেন শুনে শুনে বড় হয়েছে দীর্ণ-জীর্ণ কলকাতার রাস্তায় তার কাছে পূর্ণিমা চাঁদ সঙ্গত কারণেই জাগাতে পারে না রোমান্টিকতা, বরং ক্ষুধার্ত চোখে ওই শীতল দীপ্তিমান পূর্ণ চাঁদকেই মনে হয় ঝলসানো রুটি। দারিদ্র্য যে কিশোরের শৈশবকে করতে পারেনি আনন্দময়, তৃতীয় বিশ্বের রাজনীতি যার জন্য নিশ্চিত করতে পারেনি একটি বাসযোগ্য ভূমির, সে কিশোরের কলমে প্রকৃতির অমল রূপের বিভার স্তুতি ফুটিয়ে তোলা অসম্ভবই ছিল। বরং তারচেয়ে সময়ের অধীরতাকে ধারণ করে জীবনের অনটনকে তীক্ষè করে কলমের ডগায় হেনে তাকে বল্লমে পরিণত করাই স্বাভাবিক। আর এ কারণেই কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য হয়ে উঠেছেন জনতার কবি, নির্যাতিতের কবি এবং নিরন্নেরও কবি। এই কথার প্রতিধ্বনি আমরা পাই তার বৌদিকে লেখা সুকান্তের পত্রে, ...আমি কবি বলে নির্জনতাপ্রিয় হব, আমি কি সেই ধরনের কবি? আমি যে জনতার কবি হতে চাই, জনতা বাদ দিলে আমার চলবে কি করে? তা ছাড়া কবির চেয়ে বড় কথা আমি কমিউনিস্ট, কমিউনিস্টদের কাজ-কারবার সব জনতা নিয়েই। কবি সুকান্তের উন্মেষ কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য শৈশবেই কবি হয়ে উঠেছেন তার সহজাত প্রতিভায়। সুকান্তর সাহিত্য জগতে প্রবেশের প্রধান অনুপ্রেরণা তৈরি করেন রানীদি। শ্রুতি ও পাঠের মধ্য দিয়ে তার সাহিত্য জগতের হাতেখড়ি। স্কুলে ‘সঞ্চয়’ নামে হাতে লেখা পত্রিকায় হাসির গল্প দিয়ে সূচনা হলেও সুকান্ত পরিণত হন একজন কবি হিসেবে। দশ-বার বছরের বালক কবি সূচনাতেই সামষ্টিক বিভাজনকে ব্যক্তিক অনুবীক্ষণে প্রত্যক্ষ করেন কবিতায়। সাদামাটা লেখাও তখন হয়ে পড়ে নির্যাতিতের ইশতেহার। তার শৈশবের লেখাতেই পাই, ‘বল দেখি জমিদারের কোনটি ধাম জমিদারের দুই ছেলে রাম শ্যাম। রাম বড় ভাল ছেলে পাঠশালা যায় শ্যাম শুধু ঘরে বসে দুধ ভাত খায়।’ তার প্রথম মুদ্রিত লেখা প্রকাশিত হয় বিজন কুমার গঙ্গোপাধ্যায়ের সম্পাদনায় ‘শিখা’ পত্রিকায় যা ছিল স্বামী বিবেকানন্দের জীবনী। সুকান্তের ছড়া ও কাব্যগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ছাড়পত্র, পূর্বাভাস, মিঠেকড়া, অভিযান, ঘুম নেই, হরতাল ইত্যাদি। সুকান্তের কবিতার বিষয় ছিল বিচিত্র আর তাতে সতত বহমান ছিল নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের সুখ-দুঃখের বেদনার স্রোত। সুভাষ মুখোপাধ্যায় নিজেই কবির ‘কোন বন্ধুর প্রতি’ কবিতাটির প্রশংসা করে সুকান্তের কবি সত্তার প্রতিষ্ঠায় স্বীকৃতি তৈরি করে গেছেন। সুকান্তের জীবিত অবস্থাতেই ‘এক সূত্রে’ নাম নিয়ে বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অজিত দত্ত, সমর সেন, অচিন্ত্য, অন্নদাশঙ্কর, অমিয় চক্রবর্তী প্রমুখ বাংলার পঞ্চান্ন জন কবির কবিতা নিয়ে প্রকাশিত গ্রন্থে সুকান্তের একটি কবিতা স্থান পেয়েছে। সুকান্তের কবিতায় সিঁড়ি, দেশলাই কাঠি, মোরগ, কলম ইত্যাদি ক্ষুদ্র বিষয়গুলো প্রতিবাদের মারণাস্ত্র হয়ে উঠে এসেছে। এসব জীবনমুখী কবিতায় শ্রমে-ঘামে নির্যাতিত মানুষের চাপা পড়া গহন প্রাণের কোমল কথা ধ্বনিত হয়ে উঠেছে। কবি যখন দৃপ্ত কণ্ঠে বলেন, ‘আমি একাই একটা ছোট্ট দেশলাই কাঠি’ তখন তা আর একা হয়ে থাকে না, নিমিষেই হয়ে যায় সমষ্টির অন্তর্বেদনা নিঃসরিত নান্দনিক স্লোগান। ‘কাস্তে’র কবি দিনেশ দাশ নতুন চাঁদকে নিয়ে লিখেছেন, ‘নতুন চাঁদের বাঁকা ফালিটি তুমি বুঝি খুব ভালবাসতে? চাঁদের শতক আজ নহে তো এ যুগের চাঁদ হলো কাস্তে!’ কবির এ কথাকে আরও এগিয়ে পূর্ণিমা চাঁদকে নিয়ে ক্ষুধাকাতর কলকাতাকে দেখে সুকান্ত লিখেছেন, ‘প্রয়োজন নেই কবিতার স্নিগ্ধতা কবিতা তোমায় দিলেম আজকে ছুটি ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময় পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।’ বাম রাজনীতির পতাকাতলে এসে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন, তাঁরা কবিতা ছেড়ে পার্টিতে এসেছিলেন, আর সুকান্ত এলেন কবিতা নিয়ে। অর্থাৎ কবি সুকান্তের কাছে কবিতা কেবল নিছক শিল্প নয়,কবিতা জীবনের অধিকার আদায়ের হাতিয়ার। ‘ছাড়পত্র’-এর মাধ্যমে কবি সুকান্ত জীবনের জয়গান গেয়েছেন অকপট ভাবে। যে পৃথিবী তিনি বাসযোগ্য পাননি, যে পৃথিবীর কাছে তার মেলেনি পরিমিত অন্ন, কেবল যুদ্ধ আর ধ্বংসের পৃথিবীতে অশান্তি আর অসুখের ছড়াছড়ি, সে পৃথিবীকে অনাগত প্রজন্মের কাছে বাসযোগ্য করে তুলতে তার ছিল অন্তহীন প্রয়াস। হয়তো সামর্থ্যে তা সম্ভব হয়নি, কিন্তু কালের প্রবাহে তাই হয়ে উঠেছে কোটি কোটি মানুষের অদম্য কণ্ঠস্বর, ‘চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল, এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি- নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’ গীতিকার ও অন্য ভূমিকায় সুকান্ত সুকান্ত কেবল কবি ছিলেন তাই-ই নয়। তিনি কৈশোরকাল থেকেই ছিলেন গীতিকার। গল্পদাদুর আসরের জন্য তিনি একটি গান লিখেছিলেন যাতে কণ্ঠ দিয়েছিলেন বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী পঙ্কজ মল্লিক। তার লেখা গীতি আলেখ্য প্রশংসিত হয়েছে বোদ্ধা মহলে। তার লেখা গান, ‘বর্ষ-বাণী’, ‘যেমন ক’রে তপন টানে জল’, ‘জনযুদ্ধের গান’, ‘আমরা জেগেছি আমরা লেগেছি কাজে’, ‘শৃঙ্খল ভাঙা সুর বাজে পায়ে’ ইত্যাদি শোষিতের অধিকার আদায়ে হয়ে উঠেছিল কার্যকর হাতিয়ার। তার লেখা ‘রানার’ কবিতা কিংবদন্তি গায়ক হেমন্ত কুমার মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে হয়েছে কালজয়ী। ছোটবেলায় ‘ধ্রুব’ চরিত্রে অভিনয় করা সুকান্ত রবীন্দ্রনাথের প্রয়াণের পর তার কবিতা রেডিওতে আবৃত্তি করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। এগারো বছর বরসে গীতি আলেখ্য ‘রাখাল ছেলে’ লিখে সুকান্ত জয় করেছিলেন সকলের মন। সুকান্তের জীবনে নারী ও প্রেম সুকান্তের জীবনে পাঁচজন নারীর ভূমিকাকে প্রধান বলে ধরে নেয়া যায়। একজন তার মা সুনীতি দেবী যিনি শৈশবেই উনিশ শ’ সাঁইত্রিশ সালে ক্যান্সারাক্রান্ত হয়ে মারা যান। তারও আগে মারা যান সুকান্তর প্রিয় রানুদি, কেউ কেউ যাকে রানীদিও বলে। রানুু ছিল সুকান্তর জ্যাঠাত দিদি যিনি তার চেয়ে সাত বছরের বড় ছিলেন। রানুদির মুখে গল্প-কবিতা শুনতে শুনতে সুকান্তর সাহিত্যপ্রীতি নির্মিত হয়। রানুদি কেবল তার নামকরণই করেননি, বরং এই আদরের ভাইটিকে সৃজনশীল মনন নির্মাণ করে দিয়ে গেছেন। অকালে রাণনদি যখন প্রয়াত হলেন তখন সুকান্ত ছিলেন বিমর্ষ। তার এই শোক কাটেনি সহজে। মাকে হারিয়ে, রানুদিকে হারিয়ে সুকান্ত খুঁজে পেয়েছিলেন একান্ত আপনার বন্ধু অরুণাচল বসুর মা সরলা বসুকে, যাকে কবিও মা সম্বোধন করতেন। আরেকজন নারী সুকান্তকে স্নেহ দিয়েছিলেন। তিনি মনমোহন দাদার বউ, সরযূ বৌদি। বন্ধু অরুণের জীবনে একাধিক প্রেম এলেও সুকান্তের জীবনে প্রেম এসেছিল একবারই। তার প্রিয় মানুষের নাম জানা ছিল কষ্টকর, তবে ধারণা করা যায় তিনি ছিলেন তার সহপাঠী এবং দুই বন্ধুর চিঠি চালাচালিতে বোঝা যায় তারা তার ছদ্মনাম দিয়েছিলেন উপক্রমণিকা। নজরুলের ফজিলতুন্নেসার প্রতি প্রেম আর সুকান্তর উপক্রমণিকার প্রতি প্রেমের আবেগ প্রকাশের ধরন একই। কবি নজরুল তার বন্ধু কাজী মোতাহার হোসেনকে চিঠিতে জসনাতেন তার প্রেমের আবেগ আর সুকান্ত তা জানিয়েছেন তার হরিহর আত্মা অরুণাচল বসুকে। আমরা সুকার্নতের ভাষ্যে তার প্রেমের পূর্বরাগের বর্ণনায় পাই,’ উপক্রমনিকা ভরিয়ে তুলল আমাকে তার তীব্র শারীরিকতায়- তার বিদ্যুতৎময় ক্ষণিক দেহ-ব্যঞ্জনায়।মনে হল আমি যেন সস্পূর্ণ হলাম তার গভীরতায়। তার দেহের প্রতিটি ইঙ্গিত কথা কয়ে উঠতে লাগল আমার প্রতীক্ষমান মনে। ওকে দেখবার তৃষ্ণায় আমি অস্থির হয়ে উঠতে লাগলাম বহদর্শনেও।’ কবি প্রেমে পড়ে বন্ধু অরুণের কাছে উনিশ শ’ পঁয়তাল্লিশের আটাশ ফেব্রুয়ারি তারিখে লেখা পত্রে স্বীকার করেন, ‘কী যে হয়েছিল আমার, এখনও বুঝতে পারছি না; শুধু এইটুকু বুঝতে পারছি, আমার মনের অন্ধকারে ফুটে উঠেছিল একটি রৌদ্রময় ফুল। তার সৌরভ আজও আমায় চঞ্চল করে তুলছে থেকে থেকে।’ ছদ্মনামের সেই প্রেয়সী উপক্রমণিকা ছিলেন কবিবন্ধু অরুণের কাছে ‘ডায়ালেকটিক্যাল আদালত’ যার কাছে নালিশের ভয় দেখিয়েছিলেন অরুণাচল কেননা, সুকান্তের সঙ্গে উপক্ররমণিকার সম্পর্ক ছিল ‘দ্বন্দ্ব-মধুর’। বাংলাদেশ ও কবি সুকান্ত কবি সুকান্তের সঙ্গে বাংলাদেশে নাড়ির টান ছিল। পিতৃপুরুষের ভিটা বৃহত্তর ফরিদপুরের কোটালীপাড়ার ঊনশিয়া গ্রামে হলেও তিনি কখনও এখানে আসেননি। তবে ১৯৪৩ সালে প্রাদেশিক ছাত্র সম্মেলনে যোগ দিতে তিনি বিপ্লবের ঊর্বরভূমি, অগ্নিযুগের বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্যসেন আর বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারের চট্টগ্রামে এসেছিলেন। কধুরখীল উচ্চ বিদ্যালয়ে এসে যে কক্ষে বসে চট্টগ্রাম : ১৯৪৩ কবিতাটি রচনা করেন, সেই কক্ষটিকে নাম দেয়া হয়েছে সুকান্ত কক্ষ। ইতিহাসের বীরপ্রসূ চট্টগ্রামকে নিয়ে তিনি ‘চট্টগ্রাম : ১৯৪৩’ কবিতায় লেখেন, ‘তোমার প্রতিজ্ঞা তাই আমার প্রতিজ্ঞা, চট্টগ্রাম! আমার হৃৎপিণ্ডে আজ তারই লাল স্বাক্ষর দিলাম’। কেবল চট্টগ্রামই যে কবির কবিতায় স্থান পেয়েছে তাই নয়। তার ‘দেওয়ালী’ কবিতায় আমরা ঢাকা ও নোয়াখালীর দেখা পাই। এই কবিতাতে তিনি তার বন্ধুকে মানুষের কষ্টে ব্যথিত হয়ে বলছেন- ‘তোর সেই ইংরেজীতে দেওয়ালির শুভেচ্ছা কামনা পেয়েছি, তবু আমি নিরুৎসাহে আজ অন্যমনা আমার নেইকো সুখ, দীপান্বিতা লাগে নিরুৎসব রক্তের কুয়াশা চোখে, স্বপ্নে দেখি শব আর শব। এখানে শুয়েই আমি কানে শুনি আর্তনাদ খালি, মুমূর্ষু কোলকাতা কাঁদে, কাঁদে ঢাকা কাঁদে নোয়াখালী।’ বাংলাদেশের জন্মের চৌত্রিশ বছর আগেই তিনি ‘বাংলাদেশ’ কথাটিকে প্রতিষ্ঠিত করেন ‘দুর্মর কবিতায়। পূর্ববঙ্গে যার শেকড় তার কবিতা এর চেয়ে আর কিই বা বলতে পারে? বিশেষত কবি যখন বলে ওঠেন, ‘হিমালয় থেকে সুন্দরবন, হঠাৎ বাংলাদেশ কেঁপে কেঁপে উঠে পদ্মার উচ্ছ্বাসে, সে কোলাহলের রুদ্ধস্বরের আমি পাই উদ্দেশ জলে ও মাটিতে ভাঙ্গনের বেগ আসে। হঠাৎ নিরীহ মাটিতে কখন, জন্ম নিয়েছে সচেতনতার ধান, গত আকালের মৃত্যুকে মুছে আবার এসেছে বাংলাদেশের প্রাণ।’ বাস্তবিক, বাংলাদেশের জন্মলগ্নের এতো আগে তিনি যে বাংলাদেকে চেতনায় ধারণ ও লালন করে গেছেন তা জেনে গর্বে বুকটা আপনা আপনিই ভরে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কলমযোদ্ধা কবি সুকান্ত কলকাতাকে জাপানী আক্রমণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জেরবার হতে দেখে ব্যথিত হয়ে উঠেন সুকান্ত ভট্টাচার্য। বন্ধুকে লেখা পত্রে তিনি বেদনার সঙ্গে সেই আক্রান্ত কলকাতার দিনলিপি তুলে ধরেন যেন। তিনি বন্ধুকে কলকাতার হয়ে বলেছেন, ‘কাল রাত্রিতেও আক্রমণ হয়ে গেল, ব্যাপারটা ক্রমশ দৈনন্দিন জীবনের অন্তর্ভুক্ত হয়ে আসছে,... গুজবের আধিপত্যও আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে।... প্রথম দিন খিদিরপুরে, দ্বিতীয় দিনও খিদিরপুরে, তৃতীয় দিন হাতীবাগান ইত্যাদি বহু অঞ্চলে, চতুর্থ দিন ড্যালহৌসি অঞ্চলে আর পঞ্চম দিনে অর্থাৎ গতকালও আক্রমণ হয়। ... অবিশ্রান্ত এরোপ্লেনের ভয়াবহ গুঞ্জন, মেশিনগানের গুলি আর সামনে পেছনে বোমা ফাটার শব্দ। সমস্ত কলকাতা একযোগে কান পেতে ছিল সভয় প্রতীক্ষায়, সকলেই নিজের নিজের প্রাণ সম্পর্কে ভীষণ রকম সন্দিগ্ধ। দ্রুতবেগে বোমারু এগিয়ে আসে, অত্যন্ত কাছে বোমা পড়ে আর দেহে মনে চমকে উঠি, এমনি করে প্রাণপণে প্রাণকে সামলে তিনঘণ্টা কাটাই।’ জাপানী বোমারু বিমানের এই আক্রমণে সদ্য তরুণ কবি কলমযুদ্ধ ছাড়া কী আর করতে পারতেন? তাই তিনিও জাপানীদের বিরূদ্ধে লেখেন, ‘জাপানী গো জাপানী ভারতবর্ষে আসতে কি তোর লেগে গেল হাঁপানী?’ জাপানী আক্রমণ ঠেকাতে তিনি ডাক দিয়েছেন বাংলার কিষাণ-শ্রমিক-মজদুর সবাইকে- ‘বন্ধু তোমার ছাড়ো উদ্বেগ সুতীক্ষ্ণ করো চিত্ত বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি বুঝে নিক দুর্বৃত্ত।’ সম্পাদক সুকান্তের সৃজনশস্য উঠন্তি মূলো পত্তনে চেনা যায়। সুকান্তের ক্ষেত্রে এই সত্য ধ্রুব হয়ে ওঠে পুনর্বার। স্কুলে দেয়ালিকা সম্পাদনা দিয়ে যার সম্পাদক হওয়ার শুভ সূচনা সেই বালকই সপ্তম শ্রেণিতে উঠে বন্ধু অরুণের সঙ্গে সম্পাদক হয়ে যায় ‘সপ্তমিকা’র। ১৯৪৪ সালে ফ্যাসিবাদবিরোধী লেখক ও শিল্পীসংঘের প্রকাশনা ‘আকাল’ সম্পাদনার দায়িত্বও তার ঘাড়ে ন্যস্ত হয়। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তার বন্ধু অরুণের যশোহর হতে প্রকাশিত হাতে লেখা পত্রিকা ‘ত্রিদিব’ এ বিভাগীয় সম্পাদক হিসেবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা ‘ দৈনিক স্বাধীনতা’র তিনি আজীবন ‘কিশোর সভা’ বিভাগেরও সম্পাদক হিসেবে বহাল ছিলেন। প্রাবন্ধিক ও ছন্দবেত্তা সুকান্ত ভট্টাচার্য একুশ বছরের কবি সুকান্ত কেবল কবি কিংবা রাজনৈতিক কর্মীই ছিলেন না। মননশীল সাহিত্য রচনা ও সমালোচনায়ও ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তার লেখা ‘ছন্দ ও আবৃত্তি’ প্রবন্ধখানি আজও বিজ্ঞ ও বোদ্ধা মহলের চিন্তাকে নাড়িয়ে দেয়। ছন্দকে গভীরভাবে রপ্ত করে তিনি আধুনিক বাংলা কবিতার গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন। মধ্যযুগের দ্বিপদী-ত্রিপদী ও পয়ার ভেঙ্গে বাংলা কবিতার ছন্দ উত্তরণে সুকান্ত বেশ সন্তুষ্টি প্রকাশ করে বলেছিলেন ছন্দের এই মুক্তি বিহারীলালদের হাতে লোহা থাকলেও রবীন্দ্রনাথের হাতেই তা ইস্পাতে পরিণত হয়ে উঠেছে। তার দৃষ্টিতে মাইকেল ‘অমিত্রাক্ষর’ আনলেও পয়ারের মায়া ছাড়তে পারেননি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ মাত্রাবৃত্তের জনক হয়ে বাংলা গদ্য কবিতাকে এগিয়ে দিয়েছেন অনেকদূর। আবৃত্তিকারের ছন্দ-অভিজ্ঞান বিষয়ে তার প্রবন্ধে যে কার্যকর আলোচনা দেখতে পাওয়া যায় তাতেই সুকান্তের মননশীলতার গভীরতার আঁচ পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথ ও সুকান্তের সম্পর্ক ছোটবেলায় পাঠ্যবই ব্যতীত অন্যসব বই পড়তে অভ্যস্ত সুকান্ত ভট্টাচার্য তার দিদি রানীর মুখে মুখে শুনে শুনে রবীন্দ্রনাথকে জেনেছেন। ১৯৪১ সালে রবীন্দ্র প্রয়াণের পর রেডিওতে গল্পদাদুর আসরে রবীন্দ্রনাথকে উৎসর্গ করে রবীন্দ্রনাথের কবিতা আবৃত্তি করে বেশ প্রশংসিত হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর কবিতায় একজন ভবিষ্যত কবির সন্ধান দিয়েছেন যিনি পরবর্তীতে এসে নির্বাক বেদনার্ত মনের ত্রাতা হবেন। সুকান্তর কবিতাগুলোর নিবিড় পাঠে মনে হয় অকালপ্রয়াত সুকান্তই ছিলেন সেই মর্মবেদনার কাক্সিক্ষত কবি। কেননা রবীন্দ্রনাথই বলেছেন, ‘এসো কবি অখ্যাতজনের নির্বাক মনের মর্মের বেদনা যত করিয়ো উদ্ধার। প্রাণহীন এ দেশেতে গানহীন যেথা চারিধার, অবজ্ঞার তাপে শুষ্ক নিরানন্দ সেই মরুভূমি রসে পূর্ণ করি দাও তুমি। অন্তরে যে উৎস তার আছে আপনারি তাই তুমি দাও তো উদ্বারি।’ রবীন্দ্রনাথের সেই আকাক্সক্ষাকে বাস্তবে রূপ দিয়ে নিজের অজান্তেই বুঝি কবি কিশোর সুকান্ত লিখেছেন, ‘আমার দিন পঞ্জিকায় আসন্ন হোক বিস্ফোরণের চরম, পবিত্র তিথি’। সুকান্ত রবীন্দ্রনাথকে অন্তরে ধারণ করতেন বলেই তার প্রিয়দর্শিনী, উপক্রমণিকা ছদ্মনামের প্রেয়সীর জন্যে উপহার হিসেবে নিয়ে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের ‘জীবন-স্মৃতি’ গ্রন্থখানি। রবীন্দ্রনাথের ছন্দ চর্চায় সুকান্ত এতই নিমগ্ন ছিলেন যে মাত্রাবৃত্ত মুক্তক গদ্য ছন্দে ‘বলাকা’কে পেয়ে তিনি বিশেষ আপ্লুত ছিলেন। রবীন্দ্র বলয়ে থেকেও রবীন্দ্র-প্রভাবমুক্ত কবি রবীন্দ্রনাথকে নিবেদন করে যে কবিতা লিখেছেন তাতে যেন রবীন্দ্রনাথের স্বপ্নকে তিনি বাস্তবায়নের অভিলাষ ব্যক্ত করেছেন। তিনি রবীন্দ্রনাথকে বিনয়ের সঙ্গে অবহিত করে বলেছেন, ‘আমি এক দুর্ভিক্ষের কবি প্রত্যহ দুঃস্বপ্ন দেখি, মৃত্যুর সুস্পষ্ট প্রতিচ্ছবি আমার বসন্ত কাটে খাদ্যের সারিতে প্রতীক্ষায়, আমার বিনিদ্র রাতে সতর্ক সাইরেন বেজে যায় আমার রোমাঞ্চ লাগে অযথা নিষ্ঠুর রক্তপাতে আমার বিস্ময় জাগে নিষ্ঠুর শৃঙ্খল দুই হাতে।’ অন্যসব মহান কবির মতো কবি সুকান্তও একসময় জেনে যান তার অন্তরে এই ক্ষয়িত জীবনের অকাল পরিণতির কথা। তাই নিজেই যেন বলে যান নিজেকে, ‘আজকাল মাঝে মাঝে অব্যক্ত স্পৃহা সরীসৃপের মতো সমস্ত গা বেয়ে সুস্থ মনকে আক্রান্ত করতে চায়।...আশার চিতায় আমার মৃত্যুর দিন সন্নিকট। তাই চাই আজ আমার নির্বাসন।... তোমাদের কাছে শেখা মারণ-মন্ত্রকে ভুলে, ধ্বংসে প্রতীক স্বপ্নকে ভুলে মৃত্যুমুখী আমি বাঁচতে চাই। কিন্তু পারব না, তা আমি পারব না; —আমার ধ্বংস অনিবার্য।’ কবির এই কথা যেন বীররসে সিক্ত কোন মহাকাব্যের মহান বীরের করুণ পরিণতির মর্মস্পর্শী প্রতিধ্বনি। বাংলা সাহিত্যের এই অপার ও অনন্ত সম্ভাবনার তারাটি একসময় ক্রমাগত দেহ-মনে ক্ষয়ে ক্ষয়ে ঝুপ করে খসে পড়ে ১৩ মে, ১৯৪৭। অথচ যে স্বাধীনতার জন্য আমৃত্যু কবি লড়াই করেছেন কলমে ও কায়ায় সে স্বাধীনতা এক সময় হাতে আসে ব্রিটিশের দেশভাগ নাটকের যবনিকায়। আর মাত্র কয়েকটা মাস বেঁচে যেতে পারলে স্বাধীন দেশের নাগরিকের মর্যাদায় বিদায় দিতে পারত তার প্রিয় কলকাতা সাহিত্যের এই অনলকুসুমকে।
×