ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দুটি গল্প ॥ নিশিপদ্ম

প্রকাশিত: ১০:৪৮, ১৭ মে ২০১৯

 দুটি গল্প ॥ নিশিপদ্ম

নিশি পদ্মরা ঢাকার অভিজাত এলাকার বাসাবাড়িতে ফুটছে খুব। বউদের অনুপস্থিতিতে বিশ্বস্ত স্বামীরাই তাদের যত্নটত্ন দেখভাল করে ভাল। পদ্মদের নিজস্ব সু-ঘ্রাণ নাইতো, কি? সস্তা, পাউডার, লিপস্টিকের ঘ্রাণে তারা প্রস্ফুটিত হয়ে ভ্রমরাকে মোহিত করে নানা কায়দায়। উদার মনের কেউ কেউ নিশি পদ্মদের হাতে তুলে দেয় বিদেশী বডি স্প্রে, লোশন, সাবান, হাতের কাছে টুকিটাকি যা পায়! অবশ্য এজন্য তারা সন্দেহের তালিকায় পড়ে না মোটেও, বাড়ির ছুটা বুয়াদের ওপর দিয়েই গড়িয়ে যায় সুন্দরভাবে। তাছাড়া অনেক পদ্মরা আবার ভ্রমরাদের অলক্ষ্যে এটা সেটা টুক করে ভরে নেয় হাতব্যাগে। রাত বারোটার পর পদ্ম ফুটে আর শেষ রাতের আঁধার ভোরের গায়ে বিলীন হতে হতেই সব বেরিয়ে যায়। আজ নিশি নামে যে, পদ্মটি ফুটেছে সে এক বুড়ো ভামের ফ্ল্যাটে। ষাট ছুঁই ছুঁই তার পরেও কব্জি ডুবিয়ে খাওয়ার সখ। ষোলো বছরের নিশি মরা বুড়োকে জাগাতে ঘেমে একাকার। ওড়না দিয়ে নিজের ভেজা থুঁতনি মুছতে মুছতে বলে ও দাদা-ভাই তোমার তো নুন আনতে পান্তা ফুরায়। তা দুধ ভাত খাওয়ার খায়েস এহনও মরে না ক্যা?। আমি না হয় যোগাড় যাগাড় করে সব তোমার মুখে তুলে দিলাম। গলায় ঠেকে যদি মরো পুলিশ এসে কি হাল করবে সেটা জান? তুমি না হয় মরে বাঁচবা আমার মরণ ঠেকাবে কে? কি হবে আমার? মুচকি হেসে পৌঢ় বলে কি করব বল? বউটা আমেরিকা মেয়ের বাসায় দিব্যি আছে। আমার খবর রাখার প্রয়োজনও মনে করে না। কি করব আমি? শরীর না হয় মরেছে মন তো মরেনি। তাই তো মাঝে মধ্যে তোমাদের আমন্ত্রণ জানাই। আহা বুড়োটার জন্য বড় মায়া হয় নিশির। আপ্রাণ চেষ্টা চালায় তরুণী কণ্ঠের উচ্ছল হাসি ঘরময় ছড়িয়ে পড়ে মধ্য রাতের গাঢ় আঁধারে। ভয়ে আতঙ্কে উ™£ান্ত হয়ে পৌঢ় নিশির মুখে হাত চাপা দিয়ে বলে, আহা মেয়ে আস্তে। সমাজে একটা অবস্থান তো আমার আছে নাকি? ফিসফিসে কণ্ঠে নিশি বলে তাতো জানি। বড় বড় মানুষের বড় বড় সমাজ। বড় বড় সমাজে বড় বড় কুকীর্তি। নিশির গলা আকড়ে পৌঢ় বলে, আমার যদি কুকীর্তি হয় তবে তোমারটা কি? আমার রুটি রোজগার। যদি তাই হয় তবে তাকে কুুকীর্তি বল কোন মুখে? নিশি মুখ ঝামটায়, কাজের সময় অকাজের কথা বলে আমার মুড নষ্ট কর না। এমনিতেই ঢোঁড়া সাপ, বিষাক্ত সর্পের সঙ্গে ফণা তুলে নাচতে নাচাতে বড় আনন্দ। বিষহীন সাপে অরুচী বাড়ে। তাও মোটা অংকের বখশিশের জন্য আসা। পৌঢ় নিশিকে জাপটে ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে অংক যখন মোটাই তবে সেটা চোরাই হোক আর ঢোঁড়াই হক সে দেখে লাভ কি? বরং চোরাকে ফণা তুলে নাচতে শেখাও। থাকতে যদি আমার বয়সকালে, বুঝতে বিষের ফণা কাকে বলে? নিশি বাকা ঠোঁটে হেসে চোখ মেরে বলে, ও দাদা ভাই তোমাকে তো বিষের রস ছড়িয়ে দিয়েছি এবার ফণা তুলে নাচো না দেখি। ফণা তুলতে সব শেষ, নাচবে আর কখন? হিসাব বুঝে নিয়ে ভোরে যাওয়ার সময় নিশি বলে ধুওরী বুইড়া খামোখা ধানখেতে আম কুড়াতে নামছ। আমার কি? মন চাইলে ডেক চলে আসব। তবে দুদিন আগে বল। অন্যখানে বুকিং থাকে বোঝ না? ভোরে সবার চোখের আড়ালে শিং কাটা চোরের মতো গুটি গুটি পায়ে নিজের রুমের তালা খুলে টুক করে ঢুকে পড়ে ঘরে। বিছানায় গা এলাতেই ঘুমিয়ে যায় নিশি। ঘণ্টা দুই যেতেই ঘুমের মধ্যেই শুনতে পায় কলতলার চিৎকার চ্যাচাম্যাচি। এ নিত্যদিনের ব্যাপার কানে হাত দিয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে কান পেতে শুনতে থাকে কলতলার কোলাহল। কোলাহল হওয়াটাই স্বাভাবিক। বিশ পঁচিশ খানা ঘর, একটা মাত্র কল। একেক ঘরে মানুষ তো আর কম নয়। কমের পক্ষে হলেও চারজন, উপরে তো আছেই। একেক জনের ঘর ভাড়ায় কুলানো কষ্ট। তাই তো ছোট একটি রুমে স্বামী-স্ত্রী চকিতে থাকে, ফ্লোর ভাড়া দেয় অন্য দম্পতি বা সিঙ্গেল মেয়েদের কাছে। সবাই মিলেমিশে থাকার চেষ্টা করে যতটা তার চেয়ে ঝগড়া ঝাটিই বেধে যায় বেশি। এই চুলো নিয়ে, বাথরুম নিয়ে, কল নিয়ে, বাচ্চাদের নিয়ে, এমনকি কুট- কাচালী করেও। নিশির সামনের সারির ঘরে থাকে মর্জিনা, খুশি, সাহেরা, এদের সঙ্গে নিশির বড় ভাব, কখনও ঝগড়া-টগড়া বাধেনি। ঘুম থেকে উঠে নিশি যায় মর্জিনার ঘরে। কি করছ মর্জিনা? আস নিশি, বইসাই আছি দেখ না হাত পা ফুইলা কলাগাছ হইয়া গ্যাছে, প্যাটটাও দেহ না কও বড় হইছে। মনে হয় জমজ দুইটা হইব। ক্যা আল্টাস্নো কর নাই? তুমার যেই কথা, ভাত- খাইবার ভাত নাই আবার আলতা ছুনু। পালংশাক দিয়া পুঁটিমাছ কাঁচামরিচ চিরা ঝাল ঝাল কইরা বড় খাবার মন ধরছিল। ঘরের মানুষটারে কইলাম শুইনাও শুনল না। শাশুড়িডা শুইন্যা কইল এই শাকের যে গন্ধ মাইনসে খায়। আমি তো এই শাক পছন্দই করি না। কও তো নিশি কয় টাকার জিনিস খাবার চাইছিলাম? পোলাও, কোর্মা, ফলফলালি, দুধ, ডিম তো চাই নাই। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিশি বলে, টাকাটা তো বড় কথা না। ভালবাসা স্নেহ মমতার অভাব। মমতা থাকলে শাশুড়ি নাক চেপে হলেও রান্না করে দিত। শাশুড়ির পোলাটাই বা কেমন? হাতে কইরা একমুঠা শাক আনতে পারল না? কষ্ট পাইও না। বাংলাদেশের ঘরে ঘরে এহনও এমনটাই চলে। কবে তারা বুঝবে বউ খাইলে শুধু বউ এরই খাওয়া হয় না। তাদের বংশধর যারা আসছে, তাদেরও খাওয়া হয়। রিষ্টপুষ্ট সুস্থ সন্তান জন্মায়। আলো নিভিয়ে সন্ধ্যা বেলায় বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছে নিশি। হাতে মোবাইল, কখন কবির ভাইয়ের ফোন আসবে। একটা রাত মিস গেলে কতটা ক্ষতি, ঘর ভাড়া মায়ের অসুখের টাকা, বাবার স্বল্প আয়ের সংসার দেখা, ছোট ছোট ভাইবোনগুলোর ক্লিষ্ট মুখ। কবিরকেও দিতে হয় টাকা। খদ্দের তো ওই জুটায়। কবিরের ফোন আসে। নিশি চলে আয়। বড় বোয়াল পাওয়া গ্যাছে। ঠিকমতো খুশি করতে পারলে ত্যালে-ঝোলে ক’দিন থাকবি ভাল। এই এরিয়ায় পদ্মকেও একটা জুটিয়ে দিয়েছি। নিশি পদ্ম এসব ওদের বানানো নাম। নিজেদের নাম বাবা মায়ের কাছে রেখে এসেছে। দুজনার গলায় গলায় বেশ ভাব। এক সঙ্গেই কাজ করে বেশি। সুখ-দুঃখের গল্প করে। খদ্দেরদের নিয়ে হাসাহাসি করে। এক রকম শাড়ি, ব্লাউজ, থ্রি-পিছ কেনে। এমন কি মাঝে মধ্যে খদ্দের ধরতেও দুজন দুজনকে সাহায্য করে। আজ নিশি যে, বাসায় এসেছে, সে বাসার খদ্দেরের মুখটা কেমন যেন চিন্তিত এবং লজ্জিত। নিশি নির্লজ্জ, লজ্জা থাকলে এ লাইনে চলবে কেমন করে? বাঁকা ঠোঁটে হেসে বলে স্যার কি এ লাইলে নতুন নাকি? বলতে পার তা-ই। অনেকদিন ধরে এসব থেকে দূরেই ছিলাম। আসায় ছিলাম বউটা ভাল হবে কিন্তু কিছুই হোল না। নানা রকম মেয়েলি রোগে ভুগে শরীরটা শেষ হয়ে গিয়েছে। দিনে দিনে শারীরিক সবলতাও হারিয়ে ফেলেছে। বিছানায়ই একমাত্র আশ্রয়। প্যারালাইসেন্স আক্রান্ত। আমাকে এন্টারটেন করতে পারে না। আমি তো সুস্থ সবল পুরুষ। আমার চাহিদা থাকাটাই তো স্বাভাবিক। তাই আমার স্ত্রীর অনুরোধেই তোমাকে ডাকা। কিন্তু আমি তাকে কিছুই জানাব না। সে তো বেঁচে থেকেই মরে আছে। মুখে সে যতই আমায় এগিয়ে দিক, মন কিন্তু দেবে না। বুক ফেটে যাবে। এত বড় কষ্ট আমি তাকে দিতে পারব না। নিশিও সতর্ক হয়ে উঠে। এতটুকু আওয়াজ বা তার উপস্থিতি যেন ওই অসুস্থ বউটা টের না পায়। লোকটার প্রতি নিশির শ্রদ্ধা জেগে উঠে। সব পুরুষরা তো বউকে ভয় পেয়ে এসব গোপন করে, অথচ এই লোকটি ভালবেসে গোপন করছে। সন্ধ্যায় নিশি রাতের সাজ পোশাক ঠিক করছিল। কি পরে যাবে। আজ ডাক পড়েছে ওই প্রৌঢ়র কাছে। এরই মধ্যে দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে খুশি। মাথা কুটে কাঁদতে কাঁদতে বলে ও বুয়া হুনছোনি হারাম জাদা, বেঈমানের ঘরে বেঈমানডা হরছে কি? এই কি সইয্য অয়? কি হইছে খুইলা বল না। কি কমু নিশি বু বলে কান্নার সুরে সুর করে টেনে টেনে বলে সোয়ামি আমার বউ লইয়া আমার ঘরের সামনে দিয়া রঙ্গ কইরা হাইট্যা যায়, ও বুয়া বুকটা যে, ফাইট্ট্যা যায়। ফাইট্ট্যা যায়। নিশি খুশিকে থামাতে চেষ্টা করে বলে, কি হইছে? বুঝাইয়া বল না। আমার স্বামী আমারে ফালাইয়া নিহা হইরা বউ লইয়া ওই কোনার ঘরে উঠছে। মোরে কয় তোর ঘরে তুই থাকপি ওর ঘরে অয় থাকপে। শরিয়ত মোতাবেক ভরণপোষণ পাইলেই তো অইছে। পছন্দ অইলে থাক, না অইলে ভাগ, তোর হাত- পাওতো বাইন্দা রাহি নাই। নিশি মুখের কথা হারায়। দু-হাতে খুশিকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে সান্ত¦না দেয়ার চেষ্টা করে। নিশি আজ রাতে এসেছে প্রৌঢ়র ঘরে। সে আজ মহা খুশি। নিশিকে বলে, শোন নিশি কন্যা আজ বিষাক্ত সর্পের ফণা দেখাব প্রস্তুত আছ তো? আরে দাদু এত বিষ কইথিকা পাইলা? ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলাম, ওষুধ টোষুধ নিয়ে এসেছি। ওষুধ আনছ, তো তোমার আমেরিকার মানুষ আইলেই আনতা। থামত, ঐটা একটা বিরক্তকর মহিলা। সন্দেহ কাতর, মাকাল ফল যারে বলে ডাল ভাত ডাল ভাত ও না। ডালভাত তাও মজা দায়ক। ঐটা একাটা পান্তাভাত। নতুনত্ব মুগ্ধতা কোনটাই নাই। তোমাদের মতো নিশিকন্যাদের সঙ্গে নিশি যাপন করে নানা শরীরে বিচরণ করে সেই আকুলতা বোধ করি, সেটা তো ওর কাছে করি না। বুঝ এবার। নিশি দেয়ালে টাঙ্গানো পৌঢ়র সুন্দরী বউয়ের দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফ্যালে। নিশির আজ মন ভাল নেই। খুশির কান্না বার বার চোখে ভেসে উঠছে। বুড়ো চাপাগলায় গজয়ায় দেখ টাকা হালাল করে নিবি। কাজে ফাঁকি নিবি না। ফুল নাইটের কন্ট্রাক। নিশি খিলখিলিয়ে হেসে বলে। আমি ফাঁকি দিব কি? তুমি নিজেই তো ফাঁকির বস্তা। বাকাচোরা হয়ে যাও খাড়াও দাঁড়ানোর আগেই ত্যাল যায় ফুরাইয়া, বাত্তি যায় নিভিয়া আবার চাও ফুল নাইট? ত্যাল শেষে তো নাক ডাইকা হা কইরা ঘুমাইবা। আমি কি করমু? বইসা বইসা তোমার দাঁত গুনমু? তা-ও যদি থাকত দুই একটা সোনা দিয়া বান্দানো। সব তো রুট ক্যানেল করা, শিকড়-বাকড় কিছু নাই ফাঁপা। ওইগুলো নিয়া লাভ কি আমার? আমেরিকা থিকা এইবার আমারে একটা ডায়মন্ডের আংটি আইনা দিও। দেখবা খুশির ঠ্যালায় এক নিশি সাত নিশি হইয়া গ্যাছে। দেখবা সাত নিশি তোমারে কেমন পঁচিশের যুবক বানাইয়া দ্যায়। পৌঢ় নিশিকে কাছে টেনে যুবক হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। মাস শেষে ঘর ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় নিশির হাত ধরে কাঁদতে কাঁদতে খুশি বলে পারলাম না, সতীনের সঙ্গে স্বামী লইয়া সংসার করতে। বাসি গোসল কইরা গামছায় চুল ঝাড়তে ঝাড়তে যখন আমার দুয়ারের সামনে দিয়া যায় তহন মনে অয় বুহের উরপে দিয়া বুলডোজার ডইলা যায়। ওরা তো নতুন পানির খইলসা মাছের মতো খলবলায়। আমি ভ্যাদামাছ অইয়া মাটির ভেতরে চোখমুখ গুইজা বইসা রইছি। সামনে জইলা পোড়ার চেয়ে দূরে গিয়া জ্বলি। তুমি ভাল থাইকো নিশি বু। খুশির ছেড়ে যাওয়া ঘরখানায় নতুন ভাড়াটিয়া এসেছে। মধ্য বয়সের জোবেদা। বাসায় কাজ করে। ছেলে পঁচিশ ছাব্বিশের মালেক। বিছানার চাদর, থ্রি-পিছ মাথায় নিয়ে ফেরি করে। দশ বছরের মেয়ে হাসি, ঘরে থেকে টুকটাক কাজ করে। মাঝে মাঝে মায়ের সঙ্গে বাসায় যায়। নিশির দরজা বরাবর ওদের দরজার সুবাদে ভাবসাব ভালই হয়েছে। মালেকের সঙ্গে ইয়ার্কি ঠাট্টা মশকরার মাঝে কখন যে প্রেম দশা হয়েছে নিশির, নিজেরা বোঝার আগে প্রতিবেশীরা বুঝে নিয়েছে ঠিকঠাক মতোই। জোবেদা আর হাসি জানতে পেরে সায়ই দিয়েছে, মেয়ে বেশ চটপটে, সুন্দরী হাসিখুশি, চাকরিও করে ভাল, ব্যবহারও ভাল অসুবিধার তো কোন মানেই নাই। নিশি সবার কাছে বলে রাতের চাকরি। অসুস্থ এক ধনী মহিলার দেখাশোনা করতে হয়। যাকে বলে নার্সিং। নিশি যে নিশি রাতে নিশিপদ্ম হয়ে পুরুষের ঘরে ফোটে এ কথা তো কাউকে বলা যায় না। বাড়িওয়ালা জানলে ঘর থেকে তাড়াবে। পুরুষরা জানলে সবার সামনে খানকি বেশ্যা বলে গালি দিয়ে ছি: ছি: করবে আর গোপনে কুকুরের মতো জিবের লালা ছড়াতে ছড়াতে হেদিয়ে মরবে, আর তাদের বউয়েরা যদি জানে, ঝাটা হাতে টহল পুলিশ হয়ে উঠবে। মালেকের কাছে তো ভাল মতোই গোপন করে গেল তার পেশার কথা। মালেক আশ্বাস দিয়েছে বিয়ের পর মন দিয়ে ঘর-সংসার করবা। কাজ করতে হবে না। যা করার আমিই করব। নিশি তো এ রকম জীবনই চেয়েছিল। এসএসসি পাস করে, চাকরির জন্য ঢাকায় এসে মানুষ নামের অমানুষদের হাতে ধর্ষিত হয়ে শেষ পর্যন্ত এ পথেই পা রেখেছিল। এই করে কি আর জীবন চলবে? বয়স বলে কথা। তখন কি হবে? তাই তো বড় আশায় ঘর বাধার স্বপ্ন দেখতে দেখতে বিহ্বল হয়ে পড়ে। মাস ছয়েক পরে এক সন্ধ্যায় কোর্টম্যারেজ করে সবাইকে মিষ্টি খাইয়ে বাসরযাপন করে সংসার শুরু করে তারা। নিশির কাজ বন্ধ। খরচ বাচাতে নিশির ঘরখানা ছেড়ে একরুমেই মা, বোনের সঙ্গে থাকা শুরু করে তারা। মর্জিনার ভরন্ত পেটের অবসান ঘটিয়ে ফুটফুটে এক ছেলে সন্তানের জন্ম দিয়ে এ্যাকলামশিয়ায় পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিল চিরতরে। নিশি ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকে। তারও যে তিন মাস চলছে। জোবেদা বাসাবাড়ি হতে যা পায় ব্যাগ ধরে বউকে দিয়ে বলে খা, মা প্যাটের টাকে বাড়তে দিতে হবে। তোর শরীরেও রক্তের দরকার। নইলে মর্জিনার মতো যদি হয়। নিশি খুশি হয়। নামাজ পড়ে আল্লাহকে বলে এমন সুখের সংসার দিছো তা যেন টিকাতে পারি সেই তৌফিক দিও। নয় মাস পার করে ভালোয় ভালোয় নিশির কোলজুড়ে আসে এক পুত্রসন্তান আদরে আল্লাদে সবার সঙ্গে বড় হতে লাগল সে। সাত মাসের সময় ঠাণ্ঠা জ্বরে আক্রান্ত হয় ছেলেটা। নিশি, হাসি দুজনে মিলে বাচ্চাটাকে নিয়ে যায় ডাক্তারের চেম্বারে। ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ কেনার সময় দেখতে পায় পদ্ম কন্ট্রাসেপটিকের প্যাকেট কিনছে। দুজনার চোখাচোখি হতেই পদ্ম এসে নিশিকে জড়িয়ে ধরে বলে সেই যে গেলি আর কোন যোগাযোগই রাখলি না। কেমন আছিস? কোথায় থাকিস? এই বাচ্চাটা কে? নিশি ইচ্ছে করেই পুরনো সবার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করেছিল। সেটা এড়িয়ে বলল, সংসারের ঝামেলায় হয়ে ওঠে নাই। এটা আমার ছেলে। বাসার ঠিকানাটা বলার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু হাসি সেটা বলে দিল। নিশি যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়ে বলল, আসিরে তুই বাসায় আসিস। এরপর মাঝে মাঝেই পদ্ম আসে নিশির বাসায়। গল্প গুজব খাওয়া দাওয়া করে চলে যায়। কিন্তু আজ বিকেলে আসার পর থেকেই পুব হাওয়ায় এক টানা ঝড়, সঙ্গে মুষুলধারে বৃষ্টি। ক্ষণে ক্ষণে বিদ্যুত চমক আর গুরুগুরু মেঘের ডাক। বাইরে স্নায়ু বিবশ্ম করা অন্ধকার। এ রকম দুর্যয়ময়ী রাতে বাইরে যাওয়ার উপায় নেই। তাই রাতটুকু বাধ্য হয়েই থাকতে হয় পদ্মকে। সারারাত বৃষ্টি পড়ে সকালের দিকে ধরে আসে, যদিও ছিচকাদুনে ভাবটা চলতেই থাকে। এ রকম পরিবেশে কাঁথা গায়ে ঘুমতে কার না ভাললাগে? যতই ভাল লাগুক কর্মক্ষেত্রে ঝড় জল মাথায় নিয়েই ছোটে কর্মজীবীরা। সকাল বেলায় জোবেদা আর হাসি মাথায় পলিথিন কাগজ পেঁছিয়ে চলে গেছে কাজে। বাচ্চাটা ঘুমে থাকতে নিশি রাতের এটো থালাবাসন নিয়ে কলতলায় গেছে ধুতে মালেকের ফেরির কাজ বাধাধরা সময় নেই। এক সময় গেলেই হলো। সে নাক মুখে কাথায় ঢেকে গভীর ঘুমে আচ্ছাদিত। ছোট কাঠের চকিটায় পাশে ছোট ছেলেটাও ঘুমন্ত। ঘরের আরেক কোনায় ফ্লোরে মা, মেয়ের সঙ্গে শুয়েছিল পদ্ম । সেও গভীর নিদ্রায় নিমগ্ন। কোলাহল মুখর কলতলায় কাজে গেলে যে এক ঘণ্টার আগে ঘরে ফেরে না নিশি। সেটা ভাল করেই জানে মালেক। কিন্তু নিশি পানির কলসটা নিতে ভুলে গিয়েছিল। সেটা নেয়ার জন্য দশ মিনিটের মধ্যে ঘরে ঢুকে যা দেখল নির্বাক হয়ে চেয়ে রইল। মালেক এক ঝাটকায় উঠে দাঁড়িয়ে পরনের বেসামাল কাপড় সামাল দিতে গিয়ে আরও বেসামাল করে ফেলল। নিশি তার শরীর মনের সকল ক্রোধ আর শক্তি দিয়ে পদ্মের অর্ধ উলঙ্গ দেহটাকে, লাথি, কিল, ঘুষি দিতে দিতে বলল শেষ পর্যন্ত তুই আমার ঘরে ব্যবসা করলি? তোরে বিশ^াস করার ফল এই দিলি? তুই আসলেই একটা বেশ্যা। নিশির হাত হতে নিজেকে ছাড়িয়ে গায়ের কাপড় ঠিক করতে করতে পদ্ম বলে, দেখ নিশি বেশি সতী সাজিস না। তুই ওতো আমার মতো শরীর বেইচ্যা খাইছোস, মা বইনেরে খাওয়াইছোস। তুই কাম ছাড়ছোস, আমি ছাড়ি নাই, এইটুকুই তো ফারাক, তাই এত বড় বড় কথা? আহারে ধোয়া তুলসি পাতা, আমারে বেসি ঘাটাইস না, তাইলে মাথার থেইকা পাও পর্যন্ত সকল গীত গাইয়া দিমু। পদ্মের মুখে এসব কথা শুনে মালেক বড় বড় চোখ করে ধপাস করে মাটিতে বসে পড়ে। আর নিশি নির্বাক হয়ে চেয়ে থাকে চকিতে শোয়া শিশু পুত্রের দিকে।
×