ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

নদীর মৃত্যু ও পরিবেশ

প্রকাশিত: ০৮:৩৯, ১৯ মে ২০১৯

 নদীর মৃত্যু ও পরিবেশ

নদ-নদী বহুল ইতিহাসখ্যাত বাংলাদেশকে আর বুঝি ‘নদীমাতৃক দেশ’ অভিধায় ভূষিত করা যায় না। কেননা, কালের প্রবাহে মানুষের অব্যাহত দখল-দূষণে অধিকাংশ স্রোতস্বিনী কল্লোলিনী নদ-নদীর অবস্থা মৃতপ্রায় অথবা জীবন্মৃত। ছোট ছোট নদীর কথা বাদ দিলেও বর্তমানে মেঘনা অববাহিকা বাদে একদা সুবৃহৎ কীর্তিনাশা প্রমত্তা পদ্মা-যমুনা-ব্রহ্মপুত্রের অবস্থাই বা কী? সে প্রেক্ষাপটে অন্য নদ-নদীর দুরবস্থা সহজেই অনুমেয়। বৃহস্পতিবারের জনকণ্ঠের প্রথম পাতার খবর- সুন্দরবন সংলগ্ন ২৩টি নদী বিলীন হওয়ার উপক্রম। অন্যদিকে ভারতের মেঘালয় সংলগ্ন তুরা পাহাড় পাদদেশীয় ১৭টি নদীর অবস্থাও রীতিমতো সঙ্গীন। সে সব নদীতে শুধু বৈশাখ মাসেই নয়, প্রায় সারা বছরই থাকে হাঁটু পানি। অন্যদিকে সুন্দরবন সন্নিহিত নদীগুলো প্রায় শুকিয়ে যাওয়ায় লঞ্চ-স্টিমার-কার্গো ভেসেল চলাচল প্রায় বন্ধ। ফলে দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ নৌবন্দর মংলার সঙ্গে অভ্যন্তরীণ নৌ যোগাযোগ বন্ধের উপক্রম হয়েছে। চলছে না ঢাকা-খুলনা ও ঢাকা বাগেরহাট লঞ্চ সার্ভিস। নদ-নদী শুকিয়ে যাওয়ায় চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে কৃষকের। বিরূপ প্রভাব পড়ছে প্রকৃতি ও পরিবেশে। মরে যাচ্ছে গাছপালা। হারিয়ে যাচ্ছে সবুজ নিসর্গ প্রকৃতি। রীতিমতো হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে মৎস্য প্রজাতি, প্রাণিকুল ও জীববৈচিত্র্য। উল্লেখ্য, বিশ্বব্যাপী প্রধানত উষ্ণতা বৃদ্ধিজনিত আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ এমনিতেই রয়েছে সমূহ ঝুঁকিতে। এমতাবস্থার নদ-নদীগুলোকে অন্তত সারা বছর ধরে নাব্য অর্থাৎ সচল রাখা সম্ভব না হলে মরুকরণ প্রক্রিয়া প্রতিরোধ করা যাবে না, যা শুরু হয়ে গেছে ইতোমধ্যে। তবে আশার কথা এই যে, বিলম্বে হলেও বোধোদয় ঘটেছে সরকার তথা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগের। চট্টগ্রামের কর্ণফুলীসহ রাজধানীর চারপাশের নদ-নদী সর্বোপরি দেশের সব নদী ও শাখা নদীকে দখল-দূষণমুক্ত করে সারা বছর ধরে নাব্য রাখার জন্য সরকার একটি মাস্টারপ্ল্যান তথা মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এতে একদিকে যেমন নদীমাতৃক বাংলাদেশের আবহমান চিরায়ত প্রকৃতি ও রূপ ফিরে আসবে, তেমনি নৌযান চলাচলের মাধ্যমে ব্যবসাবাণিজ্য সম্প্রসারণসহ মানুষের যাতায়াতের পথ সহজ, সুগম ও সুলভ হবে। সরকার যে দেশের নদ-নদীকে সারা বছর ধরে নাব্য, দখল ও দূষণমুক্ত রাখতে সচেষ্ট ও আন্তরিক, তা ইতোমধ্যেই দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে নানা কার্যক্রমের মাধ্যমে। তুরাগ, বুড়িগঙ্গা, বালু ও শীতলক্ষ্যায় প্রায় নিয়মিতই চলছে উচ্ছেদ অভিযান। রাজধানীর বাইরেও এই উচ্ছেদ অভিযান চলমান। নদী দখল ও দূষণ প্রতিরোধে সরকার ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করেছে। সারাদেশে নদীর নাব্য ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য দুই হাজার ৩৬৮ কিলোমিটার নৌপথ উদ্ধারে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। ২০১২ সালে একনেক কর্তৃক অনুমোদিত ১১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। ৫৩টি নৌরুটের ১২ হাজার কিলোমিটার নৌপথ খননের প্রথম পর্যায় ২৪টি এবং দ্বিতীয় পর্যায়ে ২৯টি নদী খননের পরিকল্পনা রয়েছে। এই মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে নৌপথ সচলের পাশাপাশি সারা বছর নদীর নাব্য রক্ষাসহ সেচ সুবিধা ও চাষাবাদ অপেক্ষাকৃত সহজ ও সম্প্রসারিত হবে নিঃসন্দেহে। ইলিশসহ মাছের উৎপাদনও বাড়বে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ৮ শতাধিক নদ-নদী এবং ৫৭টি আন্তঃদেশীয় সংযোগ নদী রয়েছে। এগুলোর সঙ্গে প্রতিবেশী দেশ ভারত, নেপাল, ভুটান, সিকিম, এমনকি চীনও জড়িত। সুতরাং আন্তঃদেশীয় পানি ব্যবস্থাপনা ও সুষম বণ্টনের ক্ষেত্রেও এসব দেশের সক্রিয় অংশগ্রহণ অপরিহার্য। পানিসম্পদের সুষ্ঠু ও সমন্বিত ব্যবস্থাপনার জন্য উন্নয়ন সহযোগী ১২টি দেশের সহযোগিতায় ‘বাংলাদেশ ডেল্টা প্ল্যান (বিডিপি) ২১০০’ নামে যুগান্তকারী একটি উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। দীর্ঘমেয়াদী সমন্বিত এই পানি ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনায় আগামী এক শ’ বছরে পানির প্রাপ্যতা, এর ব্যবহারসহ প্রতিবেশ ও পরিবেশগত বিষয়সমূহ বিবেচনায় রাখা হয়েছে। মনে রাখতে হবে যে, নদী না বাঁচলে বাঁচবে না বাংলাদেশও।
×