ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

রেজা সেলিম

ইউটিউবের বিষয়বস্তু সবই সঠিক নয়!

প্রকাশিত: ০৮:৪১, ১৯ মে ২০১৯

 ইউটিউবের বিষয়বস্তু সবই সঠিক নয়!

দুনিয়াজুড়ে ইন্টারনেট কন্টেন্ট বা ইন্টারনেটে প্রকাশিত বিষয়বস্তু নিয়ে নানারকম বিতর্ক আছে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেসব কথা প্রচার হয় বা লেখা হয় সবই বিশ্বাসযোগ্য নয়। নানারকম গবেষণায় দেখা গেছে যারা এসব নেতিবাচক কাজ করেন তাদের অনেকেই করেন বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে, কেউ করেন নিজের অজান্তে বা অজ্ঞতায়। সর্বশেষ এপ্রিলের ২ তারিখে যুক্তরাষ্ট্রের নামী প্রতিষ্ঠান ব্লুুমবার্গ যে গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছে তাতে সরাসরি ইউটিউবের কন্টেন্ট প্রচার নিয়ে বড় রকমের অভিযোগ তোলা হয়েছে। বিশেষ করে ইউটিউবের প্রধান নির্বাহী সুজান ওজকিকি সব জেনে বুঝেও ভিডিও ভিউ বা দর্শনের ঘণ্টা হিসাব করছেন তা মানবজাতির জন্য কল্যাণকর হোক বা না হোক। ব্লুমবার্গ সবচেয়ে বেশি আপত্তি করেছে এর আপত্তিকর অপপ্রচারের, ইন্টারনেট এসবের বাহন হতে পারে না। ব্লুমবার্গের এই প্রতিবেদনের অনেক আগে থেকে ইন্টারনেট কন্টেন্ট নিয়ে আলোচনা-বিতর্ক চলছিল। এই নিয়ে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক অনেক প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে। বাংলাদেশ বিভিন্ন সময় ইউটিউবের কন্টেন্ট নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছে এবং এখনও করছে। অতি সম্প্রতি প্যারিসের ইয়েলো ভেস্ট আন্দোলনে ইউটিউবের মাধ্যমে অপপ্রচার নিয়ে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, এমনকি সুইডেনের উন্নয়নমন্ত্রী পর্যন্ত সরাসরি ষড়যন্ত্রের প্রমাণ হাজির করেছেন; কিন্তু ইউটিউবের কর্তাব্যক্তিদের এই নিয়ে কোনই মাথাব্যথা নেই। ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনে বাংলাদেশেও নানারকম ছবি তৈরি করা হয়েছে ও ইউটিউবসহ নানা সামাজিক মাধ্যমে প্রচার করা হয়েছিল, যেগুলো পরে মিথ্যা ও বানানো বলে প্রমাণসহ আপত্তি করা হয়েছিল। কিন্তু এখনও সেগুলোর সব অপসারণ করা হয়নি। ইউটিউব পরিচালনার নেতৃবৃন্দ কেন এখনও বিশ্বব্যাপী এসব উদ্বেগে কান দিচ্ছেন না তা নিয়ে ব্লুমবার্গ প্রতিবেদনের মাধ্যমে এখন বড় লড়াই শুরু হয়েছে বলে সবাই মনে করছেন। তথ্যসূত্রগুলো বলছে- ইউটিউবের সব ভিডিও মিলে দৈনিক কয়েক বিলিয়ন ঘণ্টা প্রদর্শিত বা ভিউ হয়। এসব প্রদর্শনে ইউটিউব বিজ্ঞাপন প্রচার করে বিশ্বের বিজ্ঞাপনী ব্যবসার বিশাল অংশ ইতোমধ্যে দখল করে ফেলেছে। ফলে, পুঁজির যে বিকাশ ইউটিউবের মাধ্যমে বিকশিত হয়েছে তার অঙ্ক এর সহযোগী মালিক গুগল বা প্রধান মালিক এলফাবেটও সরাসরি প্রকাশ করে না। ২০১৭ সালের তথ্য অনুযায়ী প্রতি মিনিটে ইউটিউবে ৪০০ ঘণ্টার কন্টেন্ট আপলোড করা হয়। ২০১৮ সালে ইন্টারনেট শিল্পের নামকরা বিশ্লেষক সংস্থা এলেক্সোর হিসাবে সে বছর ইউটিউব ইন্টারনেট সার্চ জগতে ২য় স্থানে আছে। এর চ্যানেল সংখ্যা এখন ২৩ মিলিয়ন ও প্রতিবছর এটা বাড়ছেই। ইউটিউব যেসব চ্যানেল কর্মসূচী পরিচালনা করে তার মধ্যে অন্যতম হলো উচ্চমানসহ নানা মানের ভিডিও, মিউজিক ও টিভি। বাংলাদেশে ইউটিউব ইতোমধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়েছে বিশেষ করে মোবাইল ফোনে অল্প টাকায় ইন্টারনেট কিনে ইউটিউব দেখা বা শোনা এখন ঘরে ঘরে নৈমিত্তিক বিষয় হয়েছে। আর বিপত্তি সেখানেই। আমরা যা পাচ্ছি তা-ই দেখছি আর বিশ্বাস করে ফেলছি। রান্নাবান্না থেকে শুরু করে লেখাপড়া, চিকিৎসা, বাসাবাড়ির খবর, প্রযুক্তি ব্যবহার, কার্টুন, সিনেমা, শালীন বা অশালীন এমন কোন বিষয় নেই যা ইউটিউবে পাওয়া যায় না। ইতোমধ্যে ধর্মীয় উস্কানিমূলক বক্তব্য ও আরও কিছু অপ্রীতিকর বিষয়বস্তু নিয়ে সরকার সতর্ক হয়েছে। কন্টেন্ট ফিল্টারিং করার উদ্যোগও নেয়া হয়েছে; কিন্তু এর মধ্যে সবচেয়ে জরুরী হলো আমাদের নিজেদের সতর্ক হওয়া। বিশেষ করে স্বাস্থ্যসেবায় এমন সব টোটকা চিকিৎসা ও ভুলে ভরা পরামর্শ প্রচার করা হচ্ছে যা কোনভাবেই কাম্য নয়। এসব পরামর্শ শুনে সাধারণ মানুষ প্রভাবিত হতে পারে যা ভয়াবহ সমস্যারও সৃষ্টি করতে পারে। তাই কোনভাবেই এসব কন্টেন্ট ইউটিউবে থাকা উচিত নয়, যা সচেতন ব্যবহারকারীরা সরাসরি রিপোর্ট করতে পারেন। যাচাই-বাছাই করে সেগুলো সরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ তখন সরকার ও ইউটিউব মিলে করতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হলো- ইন্টারনেট যে অবারিত জ্ঞানের জগত উন্মুক্ত করে দিয়েছে সেখানে এরকম ভুলে ভরা তথ্য দিয়ে আমরা দেশের মধ্যে মাতৃভাষায় কেন এসব কন্টেন্ট তৈরি করছি? এই নিয়ে আমাদের চিন্তা করা দরকার। আমাদের কম্পিউটার সাক্ষরতা এখনও তেমন উল্লেখযোগ্য নয়। ফলে এর স্থান নিয়ে নিয়েছে স্মার্ট মোবাইল ফোন। আমরা কখনও ভাবিনি মোবাইল ডিভাইসের সুফল আমাদের জন্য কোন খারাপ বার্তা নিয়ে আসতে পারে কি-না। দেশের বেশিরভাগ মানুষ প্রযুক্তি জ্ঞানের বাইরে। কিন্তু যাদের এই শিক্ষা-সচেতনতার কাজটি সমাজের কাছে পৌঁছে দেয়া দরকার ছিল তাদের বুঝে ওঠার আগেই বাণিজ্য বুদ্ধির লোকজন এই ব্যবসাটা খুব ভালভাবে করে ফেলেছে। আমাদের পণ্ডিত প্রযুক্তিবিদরা সেমিনারে আর ক্লাসে বক্তৃতা দিয়ে দায়িত্ব শেষ করেছেন। মোবাইল ফোনের এমন অপারেটরও আমাদের দেশে ব্যবসা করতে এসেছে যারা আমাদের ছেলেমেয়েদের রাতের ঘুম হারাম করে সারারাত সস্তায় ইন্টারনেট দিয়ে টাকা নিয়ে নেয়ার ফন্দি করেছে, নানা চৌকস বুদ্ধি খাটিয়ে আধুনিকতার নামে হাবিজাবি শব্দের ডিজুস সংস্কৃতি চালু করেছে; কিন্তু কেউ টু শব্দটি করেনি। ফলে এই খাতে কোন রাজকতা আমরা প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। যে যা খুশি তা-ই করছে আর আমাদের সরকার একটু শক্ত হলেই তাদের শত কোটি টাকা জরিমানা করতে পারছে। এ থেকেই বোঝা যায় প্রযুক্তি জগতের এসব ব্যবসা বুদ্ধির লোকজন কত অনিয়ম নিজেদের মধ্যে চালু রেখেছে। ফলে ইন্টারনেট সুবিধা পেয়ে অরাজক সংস্কৃতি চালুর একটা মওকা পেয়েছে এক শ্রেণীর মানুষ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ইউটিউবের ভিউ বাড়িয়ে কেমন করে কিছু টাকা কামাই হয়। কারণ ইউটিউবের জন্য টাকা দেয়। আয় বাড়াবার জন্য উপযুক্ত সুযোগ হলেও এসব হীন কাজের আড়ালে অনেক ভাল কাজ হারিয়ে যাচ্ছে। দেশের তরুণদের সম্মিলিত সৃজনশীল প্রচেষ্টায় শিক্ষা ও পর্যটন খাতে অনেক ভাল কাজ ইউটিউবে হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অনেক উদ্যোগ হয়েছে; কিন্তু মানুষের দুর্নিবার আকর্ষণ ওইসব মিথ্যায় ভরা চটকদার সিনেমায়। যে কেউ মোবাইল ফোনের ক্যামেরা দিয়ে যখন-তখন ভিডিও বা ছবি তুলে কিছু একটা বানিয়ে ইউটিউবে দিয়ে দিচ্ছে। দেশে আইন থাকুক বা না থাকুক মনের আইনে এটা গর্হিত কিনা সে বিবেচনাটুকু আমাদের দেশে অনেকেই করতে পারছে না। প্রযুক্তি সেবায় নিজেদের সক্ষমতা বাড়াতে আমাদের ঘরে ও বাইরে ব্যাপক শিক্ষা সচেতনতা কর্মসূচী হাতে নেয়া দরকার। ইউটিউব তার নিজের ব্যবসা ফন্দিতে আমাদের দেশের সবাইকে যদি খুদে সিনেমা বানাবার পরিচালক আর নায়ক-নায়িকা-মডেল বানাবার ফাঁদ পাতে আমরাও তা আটকে দিতে পারি, যদি সচেতন হই কী করলে দেশের, আমার ও সমাজের ভাল হবে। মিথ্যা প্রচার শুনে আমাকেই বিচার করতে হবে আমার করণীয় কি? এর পাল্টা জবাবও দিতে হবে। যারা আগ্রহী তারা যদি শুধু নিজেদের পাড়ার, গ্রামের বা জেলার একটা করে ভাল খবরের, পর্যটনের, প্রকৃতি-নিসর্গের বা মুক্তিযুদ্ধের কোন ঘটনা নিয়ে খুদে সিনেমা বানায় আর তা ইউটিউবে দেয় এতে দেশের সম্মান বাড়বে। সেই তরুণ নির্মাতা তখন হতে পারেন শিক্ষক, ট্যুরিস্ট গাইড বা বার্তাবাহক। নিজেরা ডাক্তারি না করে একজন ডাক্তারের সঙ্গে আলাপ করে তৈরি করতে পারেন স্বাস্থ্য বিষয়ক শিক্ষার কাজ। সমস্যা সমাধানে যিনি সঠিক লোক তার সঙ্গে আলাপ করে নিলেই সেই সমস্যার আধুনিক ও যথাযথ উত্তর মিলবে ইউটিউবে। আমি না জেনে, না বুঝে নিজে কেন সেটা করতে যাব? আর আপনিইবা কেন তা বিশ্বাস করে নিজের বা অন্যের ক্ষতি করবেন? সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো যদি সংশোধনের জন্য নীতিমালা গ্রহণ করে তাহলে ভাল হয়। বিকশিত প্রযুক্তির এই সময়ে সবকিছু আইন করে ঠেকিয়ে দেয়া যাবে না। কার কি দায়িত্ব তাকে সেটা বুঝতে সময় দিতে হবে। গত কুড়ি বছরে মুনাফাকামী প্রযুক্তি ব্যবসার লোকজন আমাদের অনেক ঠকিয়েছে। শুরু থেকে আমরা সোচ্চার ছিলাম; কিন্তু তাদের সঙ্গে পেরে উঠিনি। এখন তো সরকার সেটা বুঝতে পারছে। ইউটিউব যেমন নিজের স্বার্থে ব্যবসা পরিচালনা করছে আমাদেরও সে সুযোগ নিতে হবে সঠিক, উপযোগী ও কার্যকর কন্টেন্ট তৈরি করার। সব ভাল কাজের প্রশংসা করেও সেটা করা যায়। এগিয়ে আসতে হবে তথ্য সমাজের পণ্ডিত মহলেরও। সরকার কন্টেন্ট ফিল্টারিং করার যে চিন্তা করছে সেখানে নানা বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের বিনা খরচে জ্ঞান ও তথ্য সম্পাদনার কাজ করে দিতে আহ্বান জানাতে হবে। না হয় যেভাবে ইউটিউব সর্বত্র যা খুশি ছড়াচ্ছে তার ক্ষতি থেকে জাতিকে মুক্ত রাখা সম্ভব হবে না। লেখক : পরিচালক আমাদের গ্রাম উন্নয়নের জন্য তথ্যপ্রযুক্তি প্রকল্প [email protected]
×