ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে রেলওয়ের বিশেষ উদ্যোগ

প্রকাশিত: ১০:১৮, ২০ মে ২০১৯

 ঈদযাত্রা নির্বিঘ্ন করতে রেলওয়ের বিশেষ উদ্যোগ

মশিউর রহমান খান ॥ আসন্ন ঈদ-উল ফিতরে ট্রেন যাত্রীদের ভয়াবহ গরমের হাত থেকে রক্ষা করে নির্বিঘ্নে সেবা দিতে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে রেলওয়ে। যে কোন ট্রেনের পাওয়ারকার নষ্ট হলে যাত্রীরা যেন গরমে কষ্ট না পান সেজন্য তাৎক্ষণিক পাওয়ারকার সংযোজন করে যাত্রা যেন নির্বিঘ্ন করা হয় সে বিষয়ে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। একইসঙ্গে প্রতিবছরের মতো এবারও ঈদে ট্রেনের ইঞ্জিন সঙ্কট দূর করতে ভারত-বাংলাদেশে চলাচলকারী মৈত্রী ট্রেন বন্ধ ও ভিভিআইপিদের জন্য সেলুনকার সার্ভিস বাতিল করে সেসব ট্রেনের ইঞ্জিন ঈদসেবায় নিয়োজিত ট্রেনে সংযোজনেরও নির্দেশ দিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। জানা গেছে, জ্যৈষ্ঠের গরমে স্বাভাবিকভাবেই ট্রেনের অভ্যন্তরের এয়ারকন্ডিশনার ও পাখার ব্যবহার বাড়বে। ফলে ট্রেনের পাওয়ারকারের ওপর চাপ পড়বে। এরই অংশ হিসেবে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ যাত্রাপথের বিভিন্ন স্থানে অতিরিক্ত পাওয়ারকার রাখার নির্দেশ দিয়েছে। একইসঙ্গে ঈদের আগেই সব পাওয়ারকার মেরামত করে সম্পূর্ণ ব্যবহার উপযোগী রাখারও নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অপরদিকে পুরনো ও মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিন নিয়ে সমস্যা থাকায় ঈদের রেলযাত্রা স্বাভাবিক রাখতে সব ইঞ্জিন সার্ভিসিং করে ব্যবহারোপযোগী করতে ও সমস্যাসমূহে কঠোর নজরদারি রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তা কর্মচারীদের বিশেষ নির্দেশ দিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। প্রতিবছরই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পুরনো ইঞ্জিন দিয়ে ট্রেন পরিচালনা করায় বিভিন্ন স্থানে পাওয়ারকার নষ্ট হয়ে যেতে দেখা যায়। ফলে বন্ধ ট্রেনে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পর্যন্ত যাত্রীরা গরমে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েন। বিশেষ করে বৃদ্ধ নারী ও শিশুদের অবস্থা করুণ হয়ে পড়ে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য যে কোন ট্রেনের পাওয়ারকার নষ্ট হলেই অতি দ্রুততার সঙ্গে কিভাবে ওসব ট্রেনে পাওয়ারকার চালু করে কম সময়ে যাত্রীদের কষ্ট লাঘব করা য়ায় সেজন্য এই উদ্যোগ নিয়েছে রেল কর্তৃপক্ষ। আশপাশের যে কোন স্টেশনে বা গুরুত্বপূর্ণ স্থানে যে কোন ট্রেনে পাওয়ারকার সংযোজন করতে পারে ও এর মাধ্যমে কোন যাত্রী যেন গরমে কষ্ট না পান সেজন্য বাড়তি সতর্কতা হিসেবে এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে ঈদের সময় বৃদ্ধ-নারী-শিশুসহ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে রেলপথেই বাড়ি যেতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন যাত্রীরা সেজন্যই এই বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। সূত্র জানায়, পাওয়ারকারের সমস্যা সমাধানে এরই মধ্যে রেলের উভয় অঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক, প্রধান যন্ত্র প্রকৌশলী, প্রধান বিদ্যুত প্রকৌশলী ও বিভাগীয় রেলওয়ে ম্যানেজারদের রেলভবন থেকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ৯ মে পাঠানো ওই নির্দেশনায় এয়ারকন্ডিশন্ড কোচগুলোর এসি সর্বক্ষণ সচল রাখা এবং পথিমধ্যে পাওয়ারকার বিকল হওয়া থেকে রক্ষা করতে ঈদের আগেই বিশেষ ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। তারপরও কোন পাওয়ারকার নষ্ট হয়ে গেলে পথিমধ্যে প্রতিস্থাপনের সুযোগ রাখতে বিভিন্ন সেকশনে স্পেয়ার পাওয়ারকার রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তবে এ উদ্যোগ পুরোপুরি বাস্তবায়ন কতটুকু সম্ভব তা নিয়ে কিছুটা সংশয়ও রয়েছে। রেলের পরিবহন বিভাগ জানায়, কোচ ও ইঞ্জিনের পাশাপাশি এ বছর পাওয়ারকার নিয়েও শঙ্কায় আছেন তারা। গরমের কারণে এবার ট্রেনের বৈদ্যুতিক পাখা ও এসির ব্যবহার বেড়ে যাবে। এছাড়া ট্রেনগুলোয় স্ট্যান্ডার্ড কম্পোজিশনের চেয়েও অতিরিক্ত কোচ সংযোজনের ফলেও বাড়তি চাপ পড়ছে পাওয়ারকারের ওপর। ফলে যাত্রাপথে যেকোন সময় পাওয়ারকার বিকল হয়ে পড়ার আশঙ্কা থেকে যায়। এছাড়া বিশেষ চাহিদা পূরণের জন্য পাওয়ারকারেরও সঙ্কট রয়েছে। সূত্র মতে, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ ঈদ পূর্ব ও পরবর্তী সব স্বাভাবিক নিয়মে চলা ট্রেন ও ঈদের বিশেষ ট্রেন সার্ভিস পরিচালনায় ৯ মে একটি বৈঠক করে। বৈঠকে স্বাভাবিক ট্রেন সার্ভিসের পাশাপাশি সারাদেশে আট জোড়া বিশেষ ট্রেন সার্ভিসের প্রস্তাব করা হয়, যা পরবর্তীতে এই ঈদে পরিচালনা করা হবে বলে ঘোষণা দেন রেলমন্ত্রী। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ইঞ্জিন সঙ্কটের কারণে এসব সার্ভিস নির্বিঘেœ চালানো যাবে কিনা তা নিয়ে সংশয়ে আছেন রেলের কর্মকর্তারা। রেল সূত্র জানায়, প্রতিবছরই ঈদের সময় অতিরিক্ত সার্ভিস চালুর পাশাপাশি ট্রেনে বাড়তি কোচ সংযোজন করে বাংলাদেশ রেলওয়ে। ফলে চাহিদার তুলনায় কোচ ও ইঞ্জিন সঙ্কটে পড়ে সংস্থাটি। বর্তমানে রেল বহরে থাকা কোচগুলো দিয়ে অধিক সংখ্যক সার্ভিস পরিচালনার সুযোগ থাকলেও ইঞ্জিনের অভাবে তা অনেক ক্ষেত্রে ব্যর্থ হচ্ছে। প্রতিবছর ঈদে যাত্রীর চাপ বেড়ে যাওয়ার সময় টানা এক সপ্তাহ রেলের ইঞ্জিনগুলো সার্ভিস প্রদান করতে থাকে। স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত চাপের ফলে অনেক সময় ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়। ফলে বিলম্বের কারণে নিরাপদ যাত্রা বিঘিœত হয়, ট্রেনের সিডিউল বিপর্যয় ঘটে। প্রতিবছর রোজা এলেই রেলওয়ের পক্ষ থেকে ঘটা করে বাড়তি কোচ সংযোজনের ঘোষণা দেয়া হয়। তবে কয়েক বছর ধরে বাড়তি কোচ সংযোজনের বিষয়টি নিয়ে সমালোচনা হওয়ায় এবার ঘোষণা দেয়া হয়নি। সূত্র মতে, প্রতিবছরের মতো এ বছর পূর্বাঞ্চলের ট্রেনগুলোয় প্রায় ৮০ এবং পশ্চিমাঞ্চলে ৩০ কোচ সংযোজন করবে রেলওয়ে। জানা গেছে, ঈদের আগে বিভিন্ন তুলনামূলক কম গুরুত্বপূর্ণ ট্রেন সার্ভিস বন্ধ রেখে বিশেষ ট্রেন সার্ভিস চালানো হবে। যাত্রী চাহিদার ওপর ভিত্তি করে এসব কোচ সংযোজন করা হবে বলে অন্যবারের মতো এ বছর কোন ঘোষণা দেয়নি রেল কর্তৃপক্ষ। রেলের পাওয়ার সেকশনের নথি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, পূর্বাঞ্চল রেলের দেড় শ’ ইঞ্জিনের মধ্যে প্রতিদিন ১শ’ এগারোটির চাহিদা থাকলেও নিয়মিত পাওয়া যায় এক শ’ থেকে ১০৩। রেলওয়েকে প্রতিদিন কমপক্ষে দশটি ইঞ্জিন ঘাটতি রেখে ট্রেন পরিবহন ব্যবস্থাপনার সিডিউল ঠিক করতে হয়। বর্তমানে রেলবহরে থাকা দেড় শ’র মধ্যে মাত্র সাতচল্লিশটি ইঞ্জিনের আয়ুষ্কাল ২০ বছরের মধ্যে রয়েছে। এছাড়া ২১ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে ৩৪ এবং ৩০ বছরের অধিক বয়সী ইঞ্জিন রয়েছে ৬৯। অর্থাৎ পূর্বাঞ্চলীয় রেলের মোট ইঞ্জিনের এক শ’ তিনটিই মেয়াদোত্তীর্ণ। এতে যাত্রীবাহী ট্রেনের সিডিউল কোন রকমে ঠিক রাখা হলেও রেলের জন্য লাভজনক মালবাহী ট্রেনগুলো বসিয়ে রাখা হয়। এছাড়া পশ্চিমাঞ্চলে ১২৪ ইঞ্জিন থাকলেও নিয়মিত সর্বোচ্চ এক শ’টি ইঞ্জিনকে ব্যবহার করা যায়। পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ৭০ শতাংশ ইঞ্জিন মেয়াদোত্তীর্ণ। তাই বিভিন্ন সময় নির্ধারিত সময়ে ট্রেন গন্তব্যে পৌঁছতে পারে না, এমনকি যাত্রাপথে প্রায়ই ইঞ্জিন বিকল হওয়ার ঘটনা ঘটে। এ বিষয়ে রেলপথ সচিব মোফাজ্জল হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, এ বছর ঈদযাত্রা স্বাভাবিক রাখতে এবং ভয়াবহ গরমের হাত থেকে যাত্রীদের বিশেষ করে নারী শিশু ও বৃদ্ধদের দুর্ভোগ লাঘবের উদ্যোগ নিয়েছি আমরা। যে কোন ট্রেনে বিশেষ করে এয়ারকন্ডিশন্ডযুক্ত কোচগুলোতে পাওয়ারকার সমস্যা দেখা দিলে যাত্রীদের গরমে অতিষ্ঠ হয়ে পড়তে হয়। ফলে যাত্রা আরামের চেয়ে কষ্টকর হয়ে যায়। তাই ঈদে পরিবার-পরিজন নিয়ে নির্বিঘ্নে বাড়ি যেতে দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অতিরিক্ত পাওয়ারকার রাখার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এতে রাস্তায় পাওয়ার কার নষ্ট হলেই অতি কম সময়ের মধ্যে এসব ট্রেনে পাওয়ারকার লাগানো হবে। রেলপথ সচিব বলেন, যাত্রীদের সুবিধার্থে রেলওয়ের সব ইঞ্জিন চালু রাখতে ও যাত্রাপথে যাতে নষ্ট না হয় সে জন্য ঈদের আগেই সার্ভিসিংয়ের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। একই ঈদে প্রতিবছরের মতো ট্রেনের ইঞ্জিন সঙ্কট দূর করতে এ বছর ভারত বাংলাদেশে চলাচলকারী মৈত্রী ট্রেন বন্ধ রাখা হবে। ভিভিআইপিদের সেলুনকার সার্ভিস বাতিল করে এসব ট্রেনের ইঞ্জিন ঈদ সেবায় নিয়োজিত ট্রেনে সংযোজন করতে নির্দেশ দিয়েছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। এর বাইরে সব সাধারণ ট্রেন সার্ভিস বন্ধ রেখে ঈদের বিশেষ সার্ভিস চালু রাখতে সব বন্ধ ট্রেনের ইঞ্জিন কাজে লাগানো হবে। মোটকথা ঈদযাত্রা নির্বিঘেœ আমরা সর্বোচ্চ সতর্ক রয়েছি।
×