ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মাশরাফিই অনুপ্রেরণা

প্রকাশিত: ১০:৩৩, ২০ মে ২০১৯

মাশরাফিই অনুপ্রেরণা

মোঃ মামুন রশীদ ॥ প্রথম যখন অধিনায়ক হয়েছিলেন দলকে নেতৃত্ব দেয়ারই সুযোগ পাননি। ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে প্রথম ম্যাচ খেলতে নেমেই ইনজুরিতে পড়ে ছিটকে গিয়েছিলেন মাশরাফি বিন মর্তুজা। ইনজুরি ক্যারিয়ার থেকে অনেক কিছুই কেড়ে নিয়েছে। হয়তো ২০০৯ থেকে নিয়মিত অধিনায়কত্ব করতে পারলে বাংলাদেশ দলকে কোন টুর্নামেন্টের শিরোপা জেতার জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা করতে হতো না। কারণ মাশরাফি মানেই দলের জন্য বাড়তি অনুপ্রেরণা। তা তিনি প্রমাণ করেছেন ২০১৪ সালের শেষদিকে পুনরায় ওয়ানডে ও টি২০ দলের অধিনায়ক হয়ে। একেবারে বিপর্যস্ত দল দারুণভাবে ঘুরে দাঁড়িয়ে সুংসহত হয়েছে, ওয়ানডে র‌্যাঙ্কিংয়ে নিজেদের সেরা অবস্থান ৭ নম্বরে এসেছে। মাশরাফির অধীনে সবমিলিয়ে ২০১৬ থেকে আয়ারল্যান্ডের ত্রিদেশীয় সিরিজ পর্যন্ত মোট ৪ ফাইনাল খেলে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয়েছে টাইগাররা। দলের সঙ্গী হিসেবে দীর্ঘদিন পর থাকা ফরহাদ রেজা কোন ম্যাচ না খেলেই ফিরে এসে জানিয়েছেন মাশরাফির অনুপ্রেরণাতেই ভাল কিছু করার তাগিদ অনুভব করেছে ক্রিকেটাররা। প্রস্তুতি ম্যাচে আয়ারল্যান্ড উলভসের কাছে হারের পরই সবাইকে আরও বেশি সাহস জুগিয়েছেন এবং তারই ফল হিসেবে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে দুর্বার বেগে আবির্ভূত হয়ে ‘নড়াইল এক্সপ্রেস’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন। ক্রমেই অপরিহার্য ক্রিকেটারে পরিণত হন মাশরাফি। দীর্ঘ ৮ বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার পর সব ফরমেটে জাতীয় দলের অধিনায়ক হয়েছিলেন। ২০০৯ সালের জুলাইয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে প্রথম টেস্টে নেমেছিলেন অধিনায়ক হিসেবে। কিন্তু ৬.৩ ওভার বোলিং করেই থেমে গেছে তার নেতৃত্ব দেয়ার অভিযান। মারাত্মক ইনজুরি নিয়ে ছিটকে গিয়েছিলেন আর টেস্টে ফিরতে পারেননি। ওই বছর পরবর্তীতে মোহাম্মদ আশরাফুলের নেতৃত্বে খেলে ঘরের মাটিতে ত্রিদেশীয় সিরিজ, ২০১২ সালের এশিয়া কাপে মুশফিকুর রহীমের নেতৃত্বে এশিয়া কাপ, ২০১৮ সালে টি২০ নিদাহাস ট্রফিতে সাকিব আল হাসানের নেতৃত্বে ফাইনাল খেলেও শিরোপা জিততে পারেনি বাংলাদেশ দল। ২০১৪ সালে বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে বাজে সময় গেছে গত কয়েক বছরের মধ্যে। শেষ পর্যন্ত ইনজুরি থেকে পুরোপুরি ফিরে আসা মাশরাফির কাঁধেই আবার ন্যস্ত হয় ওয়ানডে ও টি২০ নেতৃত্ব। কারণ মাশরাফি সবাইকে চাঙ্গা করে তুলতে পারেন তার কাজে এবং সবচেয়ে সিনিয়র ক্রিকেটার হওয়াতে। অমায়িক, বন্ধুবৎসল আর অনেক বেশিই আন্তরিক হওয়ার কারণে মাশরাফিকে সব ক্রিকেটার মেনেও চলেন যে কারও চেয়ে বেশি। তাই অমানিশার মধ্যে পড়ে যাওয়া দলকে আলোর পথে আনতে মাশরাফির কাঁধেই দেয়া হয় নেতৃত্ব ভার। মাশরাফি পুনরায় অধিনায়ক হওয়ার পর থেকেই পুরোপুরি পাল্টে যায় বাংলাদেশ দলের চেহারা। টানা ৬টি ওয়ানডে সিরিজ জেতে তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ দল। ২০১৫ সালে বিশ্বকাপের ইতিহাসে সেরা সাফল্য পায় কোয়ার্টার ফাইনালে উঠে। ২০১৭ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতেও পায় সেরা সাফল্য, ওঠে সেমিফাইনালে। ২০১৬ টি২০ এশিয়া কাপে ফাইনালে ওঠে দল। সেটি ছিল প্রথম কোন টি২০ আসরে বাংলাদেশ দলের ফাইনাল। নিজেদের সেরা র‌্যাঙ্কিং ৭ নম্বরে উঠে আসে টাইগাররা। একেবারে মুষড়ে পড়া দলকে বিভিন্ন সময়ে কথায়, কাজে উজ্জীবিত করেছেন মাশরাফি। আবার কোন ক্রিকেটার খারাপ করতে থাকলে তাকেও অনুপ্রেরণা দিয়ে দৃঢ় মানসিক অবস্থানে নিয়ে এসেছেন। এর প্রমাণ অনেক ক্রিকেটারই বিভিন্ন সময়ে তাদের মন্তব্যে স্বীকার করেছেন। এবার আয়ারল্যান্ডে যাওয়ার আগে দলের অনেকগুলো ইনজুরি সমস্যা এবং সর্বশেষ নিউজিল্যান্ড সফরে একেবারে সদৃশ কন্ডিশনে ভরাডুবির কারণে সবাই খুব চিন্তিত ছিলেন টাইগারদের সাফল্য পাওয়া নিয়ে। ত্রিদেশীয় সিরিজে ভাল করা নিয়ে শঙ্কাটা ঘনীভূত হয় প্রস্তুতি ম্যাচে আয়ারল্যান্ড ‘এ’ দলের কাছে পরাজয়ের মাধ্যমে। তবে সেটিই নাকি অনুপ্রেরণা হিসেবে নিয়েছিলেন মাশরাফি। তার বিষয়ে ফরহাদ বলেন, ‘আসলে প্রথম থেকে তিন বিভাগেই আমরা খুব ভাল ক্রিকেট খেলেছি প্রস্তুতি ম্যাচ ছাড়া। প্রচন্ড ঠান্ডা ছিল, মানিয়ে নেয়া কঠিন ছিল। পরে মাশরাফি ভাই ড্রেসিংরুমে অনেক কথা বলেছেন, যেটা সবাইকে ড্রেসিংরুমে উজ্জীবিত ও প্রাণবন্ত করেছে। ফাইনাল ম্যাচে তো সবাই খুব ভাল করেছে।’ ফরহাদের কথাতেই বোঝা যায় অধিনায়ক হিসেবে কতটা তৎপর মাশরাফি। মাঠেও তার সেই তৎপরতা দেখা গেছে অনেকবার। ২০১৮ সালের এশিয়া কাপ ফাইনালে লিটন দাস বিধ্বংসী অর্ধশতক হাঁকানোর পর ড্রেসিং রুমে বুক থাবড়ে সাহস জোগানোর ইঙ্গিত দিয়ে ইনিংসটাকে আরও বড় করতে বলেছেন। এমন অনেক নজিরই আছে। পেস বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবে একটা সময় জাতীয় দলে বেশ গুরুত্ব পেয়েছিলেন ফরহাদ রেজা। কিন্তু সেভাবে আলো ছড়াতে পারেননি। বেশ কয়েকটি ওয়ানডে ও টি২০ খেলার পর দীর্ঘদিন জাতীয় দলের বাইরে ছিলেন। তবে এবার আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশীয় সিরিজে খেলার জন্য আবার ডাক পেয়েছিলেন ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত দুর্দান্ত নৈপুণ্য দেখানোর কারণে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য খেলা হয়নি। কারণ নিয়মিত যারা খেলছেন বর্তমানে তাদের পারফর্মেন্সে প্রথমবারের মতো কোন টুর্নামেন্টে শিরোপা জেতার গৌরব অর্জন করেছে বাংলাদেশ দল। অপরাজিত থেকে প্রতিপক্ষদের বিপর্যস্ত করে চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা সম্ভব হয়েছে মাশরাফির মতো অধিনায়কের কারণেই। তার জোগানো সাহস ২৪ ওভারে ২১০ রানের টার্গেট নিয়ে নামার পরও বাংলাদেশ দলের জন্য কতটা কার্যকর হয়েছে তা ৩২ বছর বয়সী ফরহাদের কথাতেই বোঝা যায়, ‘কখনও এক মুহূর্তের জন্য মনে হয়নি ম্যাচটা হারব আমরা। কারণ সবার মধ্যে জেতার জেদটা ছিল। ভাল সুযোগ দরজা থেকে যাতে ফিরে না যায়, তাই যেভাবেই হোক চেষ্টা করেছি ম্যাচটা জিততে।’ এই জিদ মাশরাফির ক্যারিয়ারে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে। পুরোপুরি ফিটনেস না নিয়ে, দুই পায়ে ৭টি অস্ত্রোপচারের পরও খেলা চালিয়ে যাওয়াতেই তা স্পষ্ট। আর সে জন্যই তার এই অবদানের জন্য সব ক্রিকেটার মান্য করেন তাকে। তাই বাংলাদেশ দলও তার অধীনে বড় বড় সাফল্য পাচ্ছে। এ জন্যই দীর্ঘ ৪ বছর পর জাতীয় দলের সঙ্গে থেকে খেলতে না পারলেও উপভোগ করেছেন ফরহাদ, ‘অনেকদিন পর গিয়েছি। সবার সঙ্গে মানিয়ে নেয়ার ব্যাপার ছিল। সব কিছুই ঠিকভাবে হয়েছে। খুব ভাল লেগেছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস আমরা যেভাবে খেলতে চেয়েছি ওভাবেই খেলতে পেরেছি।’ ১০ বছরের চেষ্টায় অবশেষে সেই মাশরাফির অধীনেই প্রথমবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ। ৭৭ ওয়ানডেতে ৪৪ জয় এনে দিয়ে ইতোমধ্যেই দেশের ইতিহাসে সেরা অধিনায়ক হয়েছেন। টি২০ ম্যাচেও ২৮টিতে নেতৃত্ব দিয়ে সর্বাধিক ১০ জয় এনে দিয়েছেন তিনি।
×