ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অস্ট্রেলিয়ার নির্বাচন ॥ মুক্ত সমাজের জয়জয়কার

প্রকাশিত: ০৮:৪৪, ২১ মে ২০১৯

 অস্ট্রেলিয়ার নির্বাচন ॥ মুক্ত  সমাজের জয়জয়কার

ঢাকঢোল পেটানো ছাড়াই শেষ হয়ে গেলো প্রশান্তপারের নির্বাচন। গণতন্ত্রে উদারতা আর সমাজ ভাবনায় নতুন কিছু এসেছে কি না জানি না। তবে ফল চমকপ্রদ। নির্বাচন হয়ে গেল অস্ট্রেলিয়ায়। প্রশান্তপারে নির্বাচন দেখতে অভ্যস্ত আমার জন্য এটা নতুন কিছু নয়। ভোট না দিলে নগদ জরিমানা থাকায় ভোট দেয়া বাধ্যতামূলক। অথচ এমন উত্তাপহীন সাধারণ পরিবেশ না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। এখানে প্রার্থীরা যে কেমন বিপদে থাকেন সেটাও দেখার মতো। ভোরবেলা ঘুম ভেঙ্গে তাদের ছুটতে হয় ট্রেন বাস স্টেশনে। যেখানে মানুষ সেখানেই তারা। তাদের হাতে হাতে লিফলেট। কচিৎ দু-একজন সঙ্গে থাকলে আছে নয়ত একাই দাঁড়িয়ে থাকেন। প্রকৃত গণতন্ত্রের হয়ত এটাই নিয়ম। জনগণের সেবক যদি হবে তাহলে এমন করাই কি ন্যায়সঙ্গত নয়? আমাদের সমাজে রাজনীতিবিদরা এখনও প্রভু। তাদের চ্যালা থাকে, সমর্থক আছে, আছে ক্যাডার। এই ক্যাডার বিষয়টা এখানে কোনকালে কেউ দেখেনি, শোনেওনি। দু-চারজন নিরীহ কর্মী ভোটের দিন একগাদা লিফলেট নিয়ে কাঁচুমাচু মুখ করে ভোটকেন্দ্রের সামনে দাঁড়িয়ে থাকেন। ভোটারদের জামাই আদর সেদিন। আছে কোন মিছিল-মিটিং, না উত্তেজনা। ভোট শেষ হওয়ার মানে যেন সেদিনের অফিস শেষ করা। রাতে ভোট গণনাও তেমন বৈকি। গতকাল রাতে আমরা গিয়েছিলাম থাই রেস্তরাঁয়। সেখানে টিভি পর্দায় ভোটের খবর চলছিল বটে, তেমন কোন আগ্রহ দেখিনি কারও। এর মানে এই না যে আগ্রহ নেই। আসলে যা নেই তা হলো আতিশয্য। সবাই মনে মনে ঠিকই জানে বাড়িতে গিয়েই জেনে যাবে ফলের খবর। কারচুপি বলে কোন শব্দ নেই। ভোট চুরি, ভোট ডাকাতি বলে কোন কিছুর অস্তিত্ব নেই এ সমাজে। তাই উদ্বেগ বা আশঙ্কাও নেই। আজ যখন এই লেখাটি লিখছি গত কালকের ভোটযুদ্ধের পর ফল বেরিয়েছে। আবার পুরোটা এখনও আসেনি হাতে। কিন্তু ইতোমধ্যে জানা হয়ে গেছে লিবারেল পার্টি সরকার গঠন করতে চলেছে। চাইলে আজকেই পুরো ফল দেয়া যেত। কিন্তু তা হলো না রবিবার বলে। রবিবার দ্বিগুণ-তিনগুণ ডলার দিয়ে কাউকে নিয়োগ করা যেমন না জায়েজ, তেমনি বিবেচনায় আছে একদিনের ছুটির বিষয়। তাই আর গণনা চলেনি। তবে এটা নিশ্চিত লিবারেলই জিতেছে। আগে ভাগে দেয়া ভোটগুলো আর পোস্টাল ভোট ছাড়াই যাচাই পুল সবকিছু মিথ্যা প্রমাণ করে স্কট মরিসনের লিবারেল জিতে গেছে। এই ফিরে আসার কারণ কি? বললে যারা তর্ক করেন বা তত্ত্ব আওড়ান তাদের বলি, দলে দলে লেবারে যোগ দিয়ে আওয়াজ তুলে দেশী ভাইয়েরা জোট বেঁধেছেন, এ দেশের লোকজন বসে থাকবে? তারা এভাবে নিঃশব্দে জোট বাঁধে। নিরাপত্তা, সামাজিক উদারতা আর স্পিরিটের কাছে জলবায়ু ইস্যু থেকে ওয়েলফেয়ারের মতো ইস্যুও মার খেয়ে গেছে। আমরা এসব দেশে এসেছি সুন্দর নিরাপদ গণতান্ত্রিক জীবনের জন্য। কিছু বছর পর নিজেদের মতো নিজেদের কালচারের নামে অসহিষ্ণু আর একরোখা মনোভাব চাপিয়ে দিতে দিতে ইউরোপ-আমেরিকার পর এদের মনেও ভয় ধরিয়ে দেয়ার কাজ চলছে। সে কারণে অতি উগ্র বর্ণবাদী দলও এখন তুমুল জনপ্রিয়। কিছু কি শিখছি আমরা? এই যে আমরা লেবার লেবার বলে গলা ফাটাই, তাদের নেতা এক ঘণ্টাও দেরি করেননি পরাজয় স্বীকার করে সরে দাঁড়াতে। চমৎকার ভাষণে দুঃখ আড়াল করে দলকে নতুন নেতার কাছে সঁপে দেয়ার কথা জানিয়ে বিদায় নেয়া বিল সর্টেন- কে কাছ থেকে দেখেছি আমি। অর্ককে লেবার দলের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেয়া হয়েছিল। সে অনুষ্ঠানে তিনি কথা বলেছিলেন। লেবার প্রধান বিল বসেছিলেন আমাদের সারিতে। অন্যদিকে অর্কের সঙ্গে থাকা দুই তারকা তিনজন মিলে মঞ্চে। এমন ভাবতে পারি আমরা? ক’টা মাথা ঘাড়ে যে নেতাকে মঞ্চে না বসিয়ে পারব? কার এমন বুকের পাটা যে বলবে, দল জেতেনি, এবার তবে আপনি যান। এর নাম গণতন্ত্র। আবারও প্রধানমন্ত্রী হতে চলা মরিসন কি বললেন? তাঁর দলের পরাজিত প্রার্থী প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী টনির কথা টেনে এনে টনিকে স্যালুট জানালেন বিজয়ী ভাষণে। আমাদের দেশ ও সমাজে এসব ভাবা বিপজ্জনক। জীবন আমাকে কি দেয়নি তার হিসাব রাখি না। কি দিয়েছে তার হিসাব করলে দেখি অসাধারণ এক সুন্দর, চমৎকার পরিবেশময় উদার সমাজে বসবাস করতে দিয়েছে। যেখানে কোন চাকরিতে প্রশ্ন করেনি, আমি কি হিন্দু না মুসলমান। কেউ জানতে চায় না আমি কি ঈশ্বরে বিশ্বাসী না নাস্তিক? আমি খোলা গায়ে থাকলেও যেমন, পুরোটা ঢেকে গেলেও তেমনই কদর। বিকিনি সর্ট ঢাকা অঢাকা ঈশ্বর অঈশ্বর মিলিয়ে যে উদার দেশ আমি তার পক্ষে ভোট দেই। যে দেয় না তার ভোটও চুরি হয় না। ফলাফল নিয়ে কেউ কারও চৌদ্দ পুরুষ উদ্ধার করে না। এসব সমাজে এমন কোন বিরোধী দল নেই যার ভয় আর আতঙ্কে মানুষ ঘর থেকে বের হতে পারে না। তাদের নেতা ভোটে হারলে অন্য দলকে দোষারোপ করার পরিবর্তে নিজে দায়িত্ব কাঁধে নিয়ে সরে যায়। জানিয়ে দিতে ভোলে না পরাজয়ের কারণ তার ব্যর্থতা। এই নিয়ম কি কোনদিন শিখতে পারব আমরা? আমরা যারা আগুন সন্ত্রাস আর ভোটচুরির সমাজ থেকে এসেছি, আমরা এই গণতন্ত্র আর নিরাপদ নির্বাচন দেখেও কি কারণে অন্ধ থাকি? কি কারণে চাই আমাদের দেশের মতো নানা আপদে ভরা থাক এ দেশের সমাজও? আমাদের এই দূরভিসন্ধি বা এড়াতে না পারা মানসিকতাই মূলত নির্বাচনকে প্রভাবিত করছে এখন। শুধু কি তাই? যেসব এলাকা লেবার দলের বলে পরিচিত সে সব সাধারণ কর্মজীবী মানুষের এলাকায়ও জিতেছে কনজারভেটিভ দল লিবারেল। যার মূল কারণ একটি উদার মুক্ত প্রাণময় সমাজ। যা আছে বলেই আমরা এখানে শান্তিতে বেঁচে আছি। আমাদের যত উদ্বিগ্নতা আর আশঙ্কা তা মনোজাগতিক। সাদারা খুব ভালই জানে তারা কি করছে। কি চায় তারা। তাই যাদের আতে আগামী নিরাপদ তাদের কাছেই দিয়েছে দেশ শাসনের ভার। অস্ট্রেলিয়া লেট আস রিজয়েস ফর উই ইয়াং এ্যান্ড ফ্রি... মুক্ত জীবন দীর্ঘায়ু হোক দেশে দেশে।
×