১৯৭১ সালের ২১ মে, দিনটি ছিল শুক্রবার। সারা বাংলাদেশে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। সব রীতিনীতি বিসর্জন দিয়ে পৈশাচিক শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে সাড়ে সাত কোটি বাঙালীকে সর্বপ্রকার অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখতে বদ্ধপরিকর পাকবাহিনী। সমগ্র পৃথিবী স্তম্ভিত। সামরিক শক্তির এহেন জঘন্যভাবে প্রয়োগ পৃথিবীর ইতিহাসের আর দ্বিতীয় নজির নেই। সারাদেশ সামরিক শক্তির দাপট এবং নারকীয় হত্যাকান্ডে ক্ষতবিক্ষত। ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় স্বাধীন বাংলার মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচন্ড আক্রমণে হানাদারের দল দিশেহারা হয়ে পড়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশ সময়ের ব্যাপার মাত্র! এই দিন কুমিল্লার দক্ষিণে গৌড়িপুর নামক স্থানে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডোরা পাকসেনাদের ওপর অকস্মাৎ আক্রমণ চালায়। এতে পাকবাহিনীর ৯ জন সৈন্য নিহত হয়। মুক্তিবাহিনীর একটি গেরিলা দল দেবীদ্বার থানা আক্রমণ করে। এ অভিযানে ছয়জন দালাল পুলিশ নিহত হয়। মুক্তিবাহিনীর অপর গেরিলা দল হাজীগঞ্জ থানা আক্রমণ করে। এ অভিযানে একজন পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর ও দুজন দালাল পুলিশ নিহত হয়। কুমিল্লার শালদা নদী এলাকায় পাকবাহিনী রেশন ও এমুনিশন-বাহী একটি রেলওয়ে ট্রলির ওপর মুক্তিযাদ্ধারা আক্রমণ চালায়। এতে মুক্তিযোদ্ধারা বেশকিছু অস্ত্রশস্ত্র দখল করে। পাকবাহিনীর বেপরোয়া গুলিবর্ষণসহ ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগের মধ্য দিয়ে ঝালকাঠির রমানাথপুর এলাকা আক্রমণ করে। পাক বর্বরদের পৈশাচিকতায় আবদুল মাঝি, আহম্মদ মাঝি, আঃ হালিম মাঝি, এনাজুদ্দিন মাঝি, তককি মাঝিসহ অনেক গ্রামবাসী নিহত হয়।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান করাচীতে এক বিবৃতিতে বলেন, গোলযোগপূর্ণ পূর্ব পাকিস্তান থেকে যেসব পাকিস্তানী নাগরিক দেশত্যাগ করেছেন আমি তাদের রাষ্ট্রবিরোধী ব্যক্তিদের মিথ্যা প্রচারণায় বিভ্রান্ত না হয়ে নিজ নিজ বাড়িঘরে ফিরে এসে স্বাভাবিক কাজকর্ম শুরু করার জন্য আহ্বান জানাচ্ছি। আমার বিশ্বাস, পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে বিঘ্নিত করার উদ্দেশ্যে ভারত তাদের দেশত্যাগে প্রলুব্ধ করে। তিনি আরও বলেন, দেশের পূর্বাংশে আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং জীবন যাত্রা দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে আসছে। খুলনার প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী খান এ সবুর, প্রাক্তন প্রাদেশিক মন্ত্রী এসএম আমজাদ হোসেন ও প্রাক্তন জাতীয় পরিষদ সদস্য একেএম ইউসুফ এক যৌথ বিবৃতিতে বলেন, আমাদের সেনাবাহিনী আওয়ামী লীগের জাতীয় সংহতিবিরোধী কার্যকলাপ ব্যর্থ করে দিয়েছে। আমরা রাষ্ট্রদ্রোহীদের নির্মূলের কাজে নিয়োজিত পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা করার জন্য প্রদেশের জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানাই। ঢাকাস্থ চীনের কনসাল জেনারেল চ্যাং ইং বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটেছে তা পাকিস্তানের ঘরোয়া ব্যাপার। সাবেক প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ও পিডিবির যুগ্ম সম্পাদক শামসুর রহমান মাদারীপুর সফর করে সেখানকার শান্তি কমিটির সদস্যদের বলেন, পাকিস্তানের অখ-তা রক্ষা করতে ঐক্যবদ্ধভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের ধ্বংস করতে হবে। কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির সদস্য ও কৃষক-শ্রমিক পার্টির সভাপতি এএসএম সোলায়মান পিরোজপুরে শান্তি কমিটির সভায় মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে সজাগ দৃষ্টি রাখার আহ্বান জানান। আবুল হোসেনকে সভাপতি ও আবদুল খালেককে সম্পাদক করে বরিশাল জেলা শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। দেশের বিভিন্ন এলাকায় স্বাধীনতাবিরোধীরা শান্তি কমিটি গঠন করে। শান্তি কমিটিগুলো হচ্ছে- ময়মনসিংহ জেলা-সাবেক মন্ত্রী ফখরুদ্দিন আহমদ ও সাবেক সদস্য এমএ হান্নান, নেত্রকোনা মহকুমা- এ্যাডভোকেট ফজলুল হক, কিশোরগঞ্জ মহকুমা- মাওলানা মোসলেহউদ্দিন, আবদুল আওয়াল জান, সাবেক এমএনএ শরিফ উদ্দিন, মাওলানা আতাহার আলী, টাঙ্গাইল জেলা- হাকিম হাবিবুর রহমান, হালুয়াঘাট থানা- সাবেক এমপি এ আবদুল জলিল মিয়া ও আবদুল হান্নান দাদুমিয়া, কক্সবাজার থানা- এ্যাডভোকেট মইদুর রহমান, সাবেক এমপি এ জাফর আলম চৌধুরী, ফতুল্লা থানা- পান্ডে আলী মিয়া ও এমএ খালেক, হিজলা থানা- মোহাম্মদ ইসমাইল খান ও ডাঃ এ মুকিত খান। ২০ মে চুকনগর গণহত্যা চালানোর পূর্বে সেখান থেকে কিছু শরণার্থী পরিবার ভারতে যাওয়ার জন্য খুব ভোরে বের হয়ে যশোরের কেশবপুরের প্রায় ১২-১৩ কি.মি. পশ্চিম দিকে ত্রিমোহিনী নামক জায়গায় রাত যাপন করে। এদিন ভোরবেলা আবার যাত্রা শুরু করে। সরসকাঠি, ধানদিয়া, ক্ষেত্রপাড়া জনপদ পেরিয়ে তারা সাতক্ষীরা জেলার সদর উপজেলার ঝাউডাঙ্গা বাজারে এসে পৌঁছায়। অন্যদিকে খুলনার দাকোপ উপজেলার বাজুয়ায়, বটিয়াঘাটা উপজেলার বাদামতলা বাজারে, ডুমুরিয়া উপজেলার চুকনগরে ব্যাপক গণহত্যা ও লুটপাটের হাত থেকে বেঁচে যাওয়া খুলনার বটিয়াঘাট, ডুমুরিয়া, যশোরের মনিরামপুর, বাগেরহাটের ফকিরহাট, রামপাল ও পিরোজপুর অঞ্চলের হাজার হাজার শরণার্থী ভারতে যাওয়ার জন্য ঝাউডাঙ্গা উপকণ্ঠে ভারতের কাছাকাছি এসে পৌঁছায়। শরণার্থীরা যখন সাতক্ষীরার ঝাউডাঙ্গা বাজারের পূর্বপাশে পাথরঘাটা গ্রামের ওপর দিয়ে যশোর-সাতক্ষীরা মহাসড়ক অতিক্রম করছিল, তখন যশোর থেকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর দুটো ট্রাক সাতক্ষীরার দিকে যাচ্ছিল। পাকিস্তানী বাহিনীর গাড়ি দেখে শরণার্থীরা ভয়ে আশপাশের দোকানের ভেতরে, বাজারের বিভিন্ন জায়গায় এবং ঝাউডাঙ্গা গ্রামে গিয়ে পালানোর চেষ্টা করে। ঝাউডাঙ্গা বাজার অতিক্রম করে ট্রাক দুটো বাজারের দক্ষিণ দিকে ছোট ব্রিজের ওপরে থামে। স্থানীয় প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, ‘ঝাউডাঙ্গা বাজারের পূর্বপাশে পাথরঘাটা গ্রামের মতিয়ার রহমান পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর চলন্ত ট্রাক ব্রিজের ওপরে থামায়।’ মতিয়ার রহমান পাকিস্তানী সেনাদের বোঝায় যে, ‘এরা ভারতের দালাল। এদের মধ্যে মুক্তিবাহিনীর লোক আছে এবং এরা অস্ত্র, প্রচুর টাকা-পয়সা ও স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে ভারতে পালিয়ে যাচ্ছে। মতিয়ার রহমানের কথা শুনে পাকিস্তানী সেনারা রাস্তার পাশে গাড়ি থামিয়ে দ্রুত নেমে মহাসড়কের পশ্চিম দিকের মাঠের ভেতর দিয়ে দৌড়ে গোবিন্দকাঠি গ্রামের দিকে, ঝাউডাঙ্গা বাজারের আধা কি.মি. দূরে কালভার্টের ওপরে গিয়ে অবস্থান নেয়। মহাসড়ক থেকে পাকিস্তানী সেনাদের আসতে দেখে শরণার্থীরা পালানোর চেষ্টা করে। বিলের মধ্যে ছোটাছুটি করা লোকজনদের পাকিস্তানী সেনারা ধরে এনে কালভার্টের ওপর একত্রিত করে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে। অন্যদিকে সেনাবাহিনীর গাড়ি চলে গেছে ভেবে গোবিন্দকাঠির রাস্তা ধরে শরণার্থীরা এগোতে থাকে। কিছুদূর গিয়ে তারা দেখতে পায় পাকিস্তানী বাহিনী মানুষদের ব্রাশফায়ার করছে। ভয় পেয়ে সবাই রাস্তার পাশে ছোট ছোট গর্তের আড়ালে শুয়ে পড়ে। দিনের বেলা ফাঁকা বিলের মধ্যে, রাস্তার পাশে, রাস্তার ওপরে, ছোট কোন গাছের আড়ালে থাকা মানুষদের হত্যা করতে পাকিস্তানী সেনাদের কোন অসুবিধা হয়নি। পাকিস্তানী সেনারা ওইদিন তরুণ ও যুবক পুরুষদের বেশি হত্যা করে। অল্প সময়ের মধ্যে পাকিস্তানী সেনারা প্রায় তিন শতাধিক মানুষকে হত্যা করে। প্রত্যক্ষদর্শী জ্ঞানানন্দ বিশ্বাস বলেন, মাত্র কয়েকঘণ্টার মধ্যে ৫-৬ জন পাকিস্তানী সৈন্য শত শত মানুষকে হত্যা করেছিল। প্রথমে তারা মেশিনগান দিয়ে ব্রাশফায়ার করেছিল। তারপর তারা রাস্তার দুই পাশের ঢালুতে আত্মরক্ষার জন্য শুয়ে থাকা মানুষদের এক এক করে গুলি করে হত্যা করে। আনুমানিক মিনিট বিশেক পর পাকিস্তানী বাহিনী স্থানটি ত্যাগ করে দ্রুত চলে যায়।
ফিন্যান্সিয়াল টাইমস তাদের বিশেষ সংবাদদাতা হার্ভে স্টকউইনের একটি আর্টিকেল প্রকাশ করে। তিনি পাকিস্তান সরকার অনুমোদিত পূর্ব পাকিস্তান পরিদর্শনের সাংবাদিক টিমের অন্যতম একজন সদস্য। এই মাসের শুরুতে তারা এই অনুমতি পেয়েছিলেন। তিনি তার সফর সম্পর্কে লিখেছেন। তিনি মনে করেন সেখানে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। এবং দুর্ভিক্ষ অবশ্যম্ভাবী। তিনি বলেন বাঙালী ২৫ মার্চের আগে অতি আত্মবিশ্বাসী ছিল। শেখ মুজিব মনে করেন বাঙালীর আকাক্সক্ষার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার জন্য মূল্য দিতে হবে। তিনি দ্বিধান্বিত এবং রাজনৈতিকভাবে সরল ছিলেন। স্টকউইন বিশ্লেষণ করে দেখেছেন আন্দোলনের পেছনে বাঙালীর প্রবল আবেগ এবং তাদের ভেতরের প্রচন্ড ইচ্ছাশক্তিও তিনি দেখেছেন। তাদের নিজেদের ওপর প্রচন্ড আত্মবিশ্বাস রয়েছে। এই বিশ্বাস থেকেই আন্দোলন ত্বরান্বিত হয়েছে এবং আইয়ুব খানের পতন হয়েছে। আর্মি পূর্ব বাংলার জনগণকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। স্টকউইনের মতে নির্বাচনের পরেও পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া ভাল ছিল। পুরো নির্বাচন চলাকালীন সময়ে তারা অনেক শান্ত ছিল। এমনকি নির্বাচন পরবর্তী মুহূর্তেও। কিন্তু যখন শেখ মুজিব পূর্ব বাংলার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তখন ছাত্রদের চরম আন্দোলনে সেনাবাহিনী চরম ভয়ঙ্কর রূপে আবির্ভূত হতে থাকে। তিনি দেখেছেন আন্দোলন কীভাবে দেশ ভাগের আন্দোলনে মোড় নেয়। এদিন পিটিআইয়ের বরাতে দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় ‘গেরিলা বাহিনীর হাতে ৬১ জন পাকসেনা খতম’ শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলদেশের বিভিন্ন জায়গায় পাকসৈন্যদের সঙ্গে মুক্তিফৌজের গেরিলাবাহিনীর সংঘর্ষে ৬১ পাকসৈন্য খতম হয়েছে বলে বিভিন্ন সূত্রে খবর পাওয়া গেছে। বাংলেদেশের কুষ্টিয়া জেলার দর্শনায় মুক্তিফৌজ কমান্ডোদের আক্রমণে দুজন পাকসৈন্য নিহত হয়েছে। উত্তরবঙ্গে মুক্তিফৌজ আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে এবং পাঁচগড় ও অমরখানায় পাকবাহিনীর ওপর বেশ কয়েকবার অতর্কিত আক্রমণ চালিয়েছে। পাকসৈন্যরা আতঙ্কিত হয়ে শিবির থেকে বেরিয়ে আসতে অনিচ্ছা প্রকাশ করছে। একটি সূত্র থেকে জানা গিয়েছে, পাকসেনারা দিনাজপুরের বিভিন্ন পুকুরে সাঁতার শিখছে। ঠাকুরগাঁয়ে অবস্থিত পাকসেনারা একটি গীর্জা বাড়িকে রান্নাঘরে পরিণত করেছে। দৈনিক হিন্দুস্তান স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকায় ‘সব শরণার্থীদের ফিরে যাওয়া নিশ্চিত করতে হবে’ শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, অসম ও পশ্চিমবঙ্গের বাংলাদেশ শরণার্থী শিবিরগুলোতে সফর শেষে কেন্দ্রীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম রবিবার বিকেলে বনগাঁর কাছে পেট্রাপোল এ সাংবাদিকদের বলেন বিশ্ববাসীকে ‘নজিরবিহীনভাবে’ বাংলাদেশ থেকে ভারতে শরণার্থী প্রবেশের ব্যাপারে কি ব্যবস্থা নেয়া যায় সেটা বের করে এই সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নিতে হবে। তিনি বাংলাদেশের জনগণের প্রতি পাকিস্তান সরকারের কাজকে ‘বর্বরোচিত’ হিসেবে মন্তব্য করে বলেন এটি ‘সমগ্র মানব ইতিহাসে একটি বড় কলঙ্কজনক ঘটনা।’ মন্ত্রী বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যে পূর্ববাংলায় অমানবিক কর্মকান্ড থামানোর জন্য পাকিস্তান সরকারের প্রতি অনুরোধ করার ব্যাপারে বিশ্ববাসীর শরণাপন্ন হয়েছি। এরপর তিনি আরও বলেন, যদি পাকিস্তান ‘তার বর্বরনীতি চালিয়ে যায়, যার দরুন লাখ লাখ নারী-পুরুষ ও শিশুরা নিরাপত্তার জন্য ভারতে ঢুকতে থাকে, তাহলে বিশ্ববাসীকে এই সমস্যার সমাধান করতে জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে।
লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
[email protected]
শীর্ষ সংবাদ: