সঞ্জয় সরকার, নেত্রকোনা ॥ নন্দিত কথাসাহিত্যিক ও নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের একাধিক নাটক, চলচ্চিত্র ও বিজ্ঞাপনে অভিনয় করে এক সময় ব্যাপক খ্যাতি পেয়েছিলেন বাউল ইসলাম উদ্দিন। জনপ্রিয় এই লোকশিল্পী দীর্ঘদিন ধরেই অসুস্থ। কিন্তু অর্থাভাবে চিকিৎসা করতে পারছেন না। দিন দিন তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হচ্ছে। অর্থভাবে একমাত্র মেয়ের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। জরাজীর্ণ কুটিরে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে এই শিল্পীর পরিবারের সদস্যদের।
জানা গেছে, জনপ্রিয় এ বাউলশিল্পী প্রায় ১১ মাস আগে হঠাৎ প্যারালাইসিসে আক্রান্ত হন।
এরপর কিছুদিন ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নেন। চিকিৎসকরা উন্নত চিকিৎসার জন্য তাকে অন্যত্র স্থানান্তরের পরামর্শ দিলেও অর্থভাবে তা হয়ে ওঠেনি। এরপর থেকে বাড়িতে অবস্থান করছেন তিনি। চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী ওষুধ খাচ্ছেন। কিন্তু অনেক সময় টাকার অভাবে ওষুধও জোগাড় করতে পারছেন না। কারণ তার পরিবারে উপার্জন করার মতো কেউ নেই। বাস্তুভিটা ছাড়া আর কোন সহায় সম্পদও নেই তাদের। অর্থভাবে তার একমাত্র মেয়ের পড়ালেখাও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। স্বামীর চিকিৎসা, মেয়ের পড়ালেখা আর সংসারের খরচ চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন তার স্ত্রী লিয়া খানম।
সম্প্রতি খিদিরপুর গ্রামের বাড়িতে ইসলাম উদ্দিনের সঙ্গে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, হুমায়ূন আহমেদ থাকতে আমার খোঁজখবর নিতেন। বিভিন্ন সময়ে আর্থিকভাবে সাহায্য-সহযোগিতাও করেছেন। কিন্তু এখন আর কেউ তার তেমন খোঁজ নেয় না। আক্ষেপ করে বলেন, শুনেছি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অনেক শিল্পী-সংস্কৃতিকর্মীর চিকিৎসায় অর্থ-সহায়তা দিয়েছেন। তিনি যদি আমার প্রতি একটু সহায়তার হাত বাড়াতেন- তাহলে হয়ত আমি সুস্থ হয়ে আবার গানের আসরে যেতে পারতাম।
নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার সান্দিকোনা ইউনিয়নের খিদিরপুর গ্রামের বাউলশিল্পী ইসলাম উদ্দিন শৈশবকাল থেকে গানে মগ্ন। ছাত্রজীবনে মামা রঙ্গু মিয়ার কণ্ঠে গান শুনে গানের প্রতি আসক্ত হন। এর পর প্রখ্যাত বাউল আবেদ আলীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে বাউল গান ও বাউল শাস্ত্রের তালিম নেন। সুমধুর কণ্ঠ ও বিশেষ গায়কীর কারণে কৈশোরেই তিনি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। পরবর্তীতে লোকগানকেই বেছে নেন জীবিকার অবলম্বন হিসেবে। পূর্ব ময়মনসিংহ অঞ্চলে ‘মালজোড়া বাউল’ নামে জনপ্রিয় ধারাটিকে শেষ পর্যন্ত টিকিয়ে রেখেছিলেন যে কয়েকজন বাউলশিল্পী- ইসলাম উদ্দিন তাদের অন্যতম। বাউল শাস্ত্র ও বাউল তত্ত্ব সম্পর্কে অগাধ পান্ডি ত্যের অধিকারী তিনি। ১৯৯২ সালে কেন্দুয়ার কুতুবপুর গ্রামের এক আসরে বাউল গান গেয়ে তিনি জননন্দিত কথা সাহিত্যিক ও নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের দৃষ্টিকারেন। পরবর্তীতে তার ঘনিষ্ঠ সহচর হয়ে ওঠেন। হুমায়ূন আহমেদের ‘উড়ে যায় বক পক্ষী’, ‘চন্দ্র কারিগর’, ‘মন্ত্রী মহোদয়ের আগমন শুভেচ্ছা স্বাগতম’, ‘এনায়েত আলীর ছাগল’, ‘অদেখা ভুবন’, ‘চৌধুরী খালেকুজ্জামানের বিশ্ব রেকর্ড’, ‘চৌধুরী খালেকুজ্জামানের এভারেস্ট জয়’, ‘থ্রি-টু-ওয়ান জিরো এ্যাকশান’সহ ১৩টি নাটক, দুটি চলচিত্র ‘ঘেটুপুত্র কমলা’ ও ‘নয়ন নম্বর বিপদ সংকেত’ এবং তিনটি বিজ্ঞাপন চিত্রে গান ও অভিনয় করেছেন তিনি। এসব অভিনয়ের মধ্য দিয়ে নব্বই দশক ও তার পরবর্তী সময়ে দেশজুড়ে পরিচিতি পান তিনি। একাধিকবার গান করেছেন দেশের বাইরেও। জারিগানের বয়াতী হিসেবেও তিনি সুপরিচিত।
জানা গেছে, তেষট্টি বছর বয়সী বাউল ইসলাম উদ্দিন শুধু বাউল শিল্পীই নন। একাধারে গীতিকার, লেখক ও পল্লী সংস্কৃতি সংগ্রাহকও। তার রচিত প্রায় সহস্রাধিক গান আজও অপ্রকাশিত। গানের পাশাপাশি কয়েকটি গ্রন্থের পান্ডুলিপি প্রস্তুত করলেও অর্থাভাবে সেগুলো প্রকাশ করতে পারেননি। তার উল্লেখযোগ্য পা-ুলিপিগুলো হচ্ছে- ‘নেত্রকোনার লোকসাহিত্য’, ‘নেত্রকোনার আঞ্চলিক ভাষার অভিধান’, ‘শাফিউল মজনবীন’, ‘পদ্যাকারে মহানবীর জীবনী’ এবং নাটিকা ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’। তার গান ও লেখালেখি সবই আজ থেমে গেছে।
শীর্ষ সংবাদ: