ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

হ্যালুসিনেসন

প্রকাশিত: ০৮:৫৭, ২১ মে ২০১৯

হ্যালুসিনেসন

রাস্তায় হঠাৎ একটা রিক্সার চাকা বার্স্ট করল- সবাই হুড়োহুড়ি দৌড়াদৌড়ি শুরু করল- ভাবল ককটেল ফেটেছে। বা চাঁদের আলোয় পথ চলতে গিয়ে হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন- বুক কাঁপতে শুরু করল- সামনে একটা লোক কালো চাদর মুড়ি দিয়ে ঘাপটি মেরে বসে আছে- লুট করার জন্য। ভালভাবে চোখ কচলে আবার তাকালেন- স্পষ্ট হলো ওটা আসলে একটা ছোট ঝোপ। এই যে চাকা বার্স্ট হওয়ার আওয়াজকে ককটেল আর ঝোপকে দুর্বৃত্ত ভাবা, এসব হলো ইল্যুসান। এখানে উদ্দীপক- আওয়াজ বা ঝোপকে ভুলভাবে অন্য কিছু মনে করা হচ্ছে। কিন্তু যদি এমন হয় আপনি একাকী একটা খোলা মাঠের মাঝখানে দাঁড়িইয়ে আছেন, অথচ কানে শুনছেন দুজন লোক আপনার বিষয়ে কথা বলছেন। অথবা একজন লোক সাপ সাপ বলে চিৎকার করছে- বাসার সবাই ছুটে এসে দেখে ফকফকা ফর্সা পরিষ্কার মেঝে- সবাই লোকটাকে বকা ঝকা শুরু করল- ঢাকা শহরের ফ্ল্যাট বাড়িতে তুমি সাপ পাচ্ছ কোথায়? লোকটা কিন্তু সাপ সাপ চিৎকার করেই চলেছে, তার চোখে সাপ-দেখা ভীতসন্ত্রস্ত ভাব। এই যে একাকী মাঠে দাঁড়িয়ে কানে আওয়াজ শোনা বা পরিষ্কার মেঝর ওপর সাপ দেখা -এসব হচ্ছে হ্যালুসিনেসন। এখানে কোন ধরনের উদ্দীপক ছাড়া একা একাই কানে আওয়াজ শোনা আর সাপ দেখা যাচ্ছে। চোখ কান নাক জিহ্বা ত্বক এই পঞ্চইন্দ্রিয়ের সবকটাতে হ্যালুসিনেসন হতে পারে। মানসিক রোগের ক্ষেত্রে কান আর ত্বক (শব্দ ও স্পর্শ)-এর হ্যালুসিনেসন বেশি দেখা গেলেও যে কোন ইন্দ্রিয়ের হ্যালুসিনেসন হতে পারে। হ্যালুসিনেসন শব্দের উৎস থাকা সত্ত্বেও ব্যক্তি কানে আওয়াজ শুনতে পায়। রোগভেদে কানে হ্যালুসিনেসনের ধরন আর বক্তব্য পাল্টে যায়, যেমন- কানে গায়েবী আওয়াজ শুনছে বললেই আমরা জিজ্ঞেস করি- কজনে কথা বলছে, তারা নিজেরা নিজেরা কথা বলে না আপনার সঙ্গে কথা বলে, কি বিষয়ে কথা বলে- কোন আদেশ নির্দেশ দেয়, নিষেধ করে ইত্যাদি। রোগভেদে এসব প্রশ্নের উত্তর হয় আলাদা আলাদা। সিজোফ্রেনিয়ার রোগীরা কানে দু’তিন জনের কথা শোনে, তারা নিজেরা নিজেরা কথা বলে, রোগীকে নানা ধরনের আদেশ নির্দেশ দেয়, ভয়ভীতি দেখায়, নানা বিষয়ে নিষেধ করে। ওদিকে ম্যানিয়া আক্রান্ত রোগীরা সাধারণত এক দু’জনের কথা শোনে- তারা কখনও কখনও নিজেরা নিজেরা কথা বলে, কখনও কখনও রোগীর সঙ্গে কথা বলে। এ রোগে রোগীর মন খুব উৎফুল্ল থাকে, রোগী নিজেকে বড় কিছু মনে করে। সাধারণত গায়েবী আওয়াজের কথাগুলোও রোগীর মনের উৎফুল্ল ভাব আর নিজেকে বড় মনে হওয়ার বোধকে চাগিয়ে দেয়। ওদিকে এই রোগীই যখন বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হয় তখন তার কানে আশা গায়েবী আওয়াজ তাকে দোষারোপ করতে থাকে, তাকে বদলোক হিসেবে উল্লেখ করতে থাকে, কখনও কখনও তাকে আত্মহত্যা করতে প্ররোচিত করতে থাকে। শব্দের হ্যালুসিনেসনে অনেক সময় একই শব্দ বা বাক্য বা নির্দিষ্ট স্মৃতি-সম্পর্কিত বাক্যাবলী/শব্দাবলী বারবার শোনা যেতে পারে। কখনও কখনও স্মৃতিসম্পর্কিত পুরোটা এমনভাবে পুনরাবৃত্তি হতে থাকে যেন ব্যক্তি এখনও ঐ ঘটনার মধ্যেই আছে। পোস্টট্রমাটিক স্ট্রেস ডিস অর্ডারে, যেমন- রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার প্রাপ্ত কোন ব্যক্তি যে মানসিক রোগ দেখা যাবে, এমন জীবন্ত স্মৃতির পুনরাবৃত্তি দেখতে পাওয়া যায়। কখনও কখনও কথা বা অন্য কোন শব্দ নয় বরং কোন গান বা যন্ত্র সঙ্গীতের অংশ বিশেষ বারবার কানে আসতে পারে। উপরোল্লিখিত রোগগুলো ছাড়া মৃগী, ব্রেন টিউমার, মাইগ্রেন, অ্যালঝেইমার ডিজিজ, লিউ বডি ডিমেনসিয়া, পারকিনসন্স ডিজিজ-এ শব্দের হ্যালুসিনেসন হয়ে থাকে। কোকেইন এম্ফিটামিন ইত্যাদি মাদকদ্রব্য গায়েবী আওয়াজের কারণ হতে পারে। শব্দের হ্যালুসিনেসনে অনেক সময় একই শব্দ বারবার শোনা যেতে পারে। কখনও কখনও একই স্মৃতির (কথা-শব্দ) পুরোটাই এমনভাবে পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে যেন ব্যক্তি তখনও ঐ ঘটনার মধ্যেই আছে। পোস্টট্রমাটিক স্ট্রেস ডিস অর্ডারে এমন জীবন্ত স্মৃতির পুনঃরাবৃত্তি দেখতে পাওয়া যায়। এসব মানসিক অসুস্থতা ছাড়াও কিছু কিছু সময় স্বাভাবিক অবস্থাতেও কেউ কেউ গায়েবী আওয়াজ শুনতে পায়। যেমন- বন্ধুর জন্য অপেক্ষমাণ একটা ছেলে মিছিমিছি ওর বন্ধুও ডাক বা দরজার খটখট শুনতে পারে। সন্তান-শোককাতর মা প্রায়শই তার সদ্য প্রয়াত সন্তানের ডাক শুনতে পান। তীব্র আকাক্সক্ষা থেকে মানুষ এ ধরনের আওয়াজ শুনতে পান। কিছুদিনের মধ্যে আপনা আপনি এ আওয়াজ বন্ধ হয়ে যায়। ঘুমাতে যাওয়ার সময় এবং ঘুম থেকে ওঠার সময় যখন মানুষ ঘুম আর জাগরণের মাঝামাঝি থাকে তখন সে কানে আওয়াজ শুনতে পেতে পারে। ত্বকের হ্যালুসিনেসন সাধারণত নেশার কারণে হয়। যেমন- কোকেইন সেবনকারীরা অনেক সময় তাদের চামড়ার নিচে কীট হাঁটছে এমন মনে করে। একে বলে ফরমফিকেশন। তারা খামছে আঁচড়ে সেই কীট বের করার জন্য ত্বকে ক্ষত তৈরি করে ফেলে। একে বলে একবম সিন্ড্রম। আরেক ধরনের রোগী পাওয়া যায় যারা আসলে ডিল্যুসনাল ডিস অর্ডারের রোগী, তারাও তাদের চামড়ার নিচে পোকার হাঁটা চলা টের পায়। পোকাগুলো তাদের চামড়া ছিদ্র করে বাইরে চলে আসে বলে অনুভব করে এবং তারা সেই সব কাল্পনিক পোকা ধরে ধরে কৌটার মধ্যে ভরে দেখানোর জন্য চেম্বারেও নিয়ে আসে। সিজোফ্রেনিয়ার রোগীরা কখনও কখনও ত্বকে, বিশেষত জননাঙ্গে সুড়সুড়ি অনুভব করতে পারে। একটা বিশেষ ধরনের হ্যালুসিনেসনের নাম ফ্যান্টম লিম্ব বা ‘ভুতুড়ে অঙ্গ’- এক্ষেত্রে কোন কারণে অঙ্গহানি ঘটার পর ব্যক্তি অঙ্গের হারানো অংশে চুলকানি বা ব্যথা অনুভব করতে পারে। দৃষ্টির হ্যালুসিনেসনে ব্যক্তি এমন কিছু দেখতে পায় যা আসলে চোখের সামনে নেই। তারা চোখে কোন বস্তু, ডিজাইন, মানুষ বা আলো ঝলকানি দেখতে পায়। দৃষ্টির হ্যালুসিনেসন সাধারণত ব্রেনের অর্গানিক সমস্যার কারণে হয়ে থাকে। যেমন : ব্রেন টিউমর হওয়া। কিছু কিছু মৃগী রোগী ফিট আসার আগে চোখে ঝিলিমিলি আলো দেখতে পায়। মাইগ্রেন মাথাব্যথার রোগীদের অনেকেই মাথাব্যথা আসার আগে এ রিকম আলো দেখতে পায়। এ্যালকোহল আসক্ত ব্যক্তি মদ গ্রহণ থেকে বিরত থাকলে উইড্রল সিন্ড্রম হিসেবে দৃষ্টির হ্যালুসিনেসনে আক্রান্ত হয়। এরা সাধারণত ছোট ছোট মানুষ দেখতে পায়। গন্ধের হ্যালুসিনেসন খুব কমই পাওয়া যায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের স্নায়ুতন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হলে এ ধরনের হ্যালুসিনেসন হয়। গন্ধের হ্যালুসিনেসন সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায় মৃগী রোগে। মৃগী রোগীরা খিঁচুনি আসার আগ মুহূর্তে নাকে রাবার পোড়া গন্ধের মতো বিশ্রী গন্ধ পায়। অবশ্য কেউ কেউ সুগন্ধও পায়। ভাইরাস সংক্রমণ, ব্রেন টিউওমার, ব্রেনে আঘাত লাগা বা ব্রেন অপারেশনের ফলে ঘ্রানের হ্যালুসিনেসন হতে পারে। কোন কোন ওষুধ বা রাসায়নিক দ্রব্য ঘ্রাণের হ্যালুসিনেসন সৃষ্টি করতে পারে। অতি আবেগপ্রবণ সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ সিনেমায় রোমান্টিক দৃশ্যে নায়ক নায়িকার খোঁপায় গোলাপ পরিয়ে দিতে দেখে গোলাপের গন্ধ পেতে পারে। এটা হ্যালুসিনেসন। আবার কোন কোন তীব্র অসুস্থতার ক্ষেত্রে কেউ কেউ দৃশ্যমান রঙের গন্ধ পান বলে জানিয়েছেন। স্বাদের হ্যালুসিনেসনে জিভ ও মুখের ভেতর কোন কিছু না থাকা সত্ত্বেও স্বাদ গ্রহণের অনুভূতি হয়। সাধারণত ব্রেনের টেম্পোরাল অঞ্চল থেকে উৎপন্ন মৃগী রোগে এ ব্যাপারটা ঘটে। খিঁচুনি হওয়ার আগ মুহূর্তে মুখের ভেতর অদ্ভুত ধরনের স্বাদের অনুভূতি হয়। মানসিক রোগের ক্ষেত্রে এ ধরনের অনুভূতি খুব কমই হয়। তবে সিজোফ্রেনিয়া রোগীদের শতকরা ২০ ভাগ এ ধরনের অনুভূতি পেয়ে থাকে। কখন চিকিৎসা নেবেন?- প্রথমেই মনে রাখতে হবে হ্যালুসিনেসন কোন রোগ নয় এটা রোগের একটা উপসর্গ। যেই রোগের উপসর্গ হিসেবে হ্যালুসিনেসন দেখা দেয় হ্যালুসিনেসনের পাশাপাশি সেই রোগের অন্যান্য উপসর্গ উপস্থিত থাকে। সামগ্রিকভাবে সেই অসুস্থতাটি ব্যক্তির পারিবারিক সামাজিক ব্যক্তিগত পেশাগত জীবনকে উল্লেখযোগ্যভাবে ব্যাহত করে, তাহলে সেই অসুস্থতার চিকিৎসা নিতে হবে। মূল অসুস্থতার চিকিৎসা করলে হ্যালুসিনেসন আপনিতেই চলে যাবে। হ্যালুসিনেসনের কারণ যদিও আমরা বলি বাইরের উদ্দীপকের উপস্থিতি ছাড়া হ্যালুসিনেসনগুলো ‘এমনি এমনি’ হয়, আসলে ব্যাপারটা এ রকম নয়। বাইরের কোন উদ্দীপক না থাকলেও ব্রেনের ভেতর এমন কিছু পরিবর্তন হয় যা হ্যালুসিনেসনের জন্ম দেয়। এই পরিবর্তনগুলোর মধ্যে প্রধানত আছে ব্রেনের ডোপামিন নামক রাসায়নিক পদার্থের মাত্রাতিরিক্ত বৃদ্ধি ঘটা। ব্রেনের স্নায়ুকোষগুলো পরস্পরের মধ্যে উদ্দীপনা আদান প্রদানের জন্য অনেক রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে। ডোপামিন তাদের মধ্যে অন্যতম। বিশেষ রোগগ্রস্ততার সময় ও মাদকগ্রহণের ফলে ব্রেনে ডোপামিনের পরিমাণ বেড়ে যায়, ফলাফল- হ্যালুসিনেসন। ব্রেনের একটা অংশের নাম থেলামাস। পঞ্চইন্দ্রিয়ের অনুভূতি মধ্যে চোখের চোখের সৃষ্ট সিগনাল ছাড়া অন্যসব অনুভূতির সিগনাল থেলামাসের মধ্য দিয়ে যায়। আমাদের অনুভূতির প্রথম উদ্দীপনা থেলামাসেই সৃষ্টি হয়। প্রাপ্ত সিগনালগুলোকে যথাযথভাবে প্রক্রিয়াজাত করে থেলামাস ওগুলোকে গুরু মস্তিষ্কে পাঠায়। গুরু মস্তিষ্ক সেই সিগনালগুলোকে সঞ্চিত পূর্ব অভিজ্ঞতার সঙ্গে সাদৃশ্য সৃষ্টি করে পূর্ণাঙ্গ অনুভূতি ও তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আবেগ সৃষ্টি করে। অসুস্থতা ও মাদক গ্রহণের ফলে থেলামাস অতিমাত্রায় সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং নিজে নিজেই সিগনাল উৎপন্ন ও প্রেরণ করতে থাকে। ফলাফল- হ্যালুসিনেসন। শব্দের হ্যালুসিনেসনের ক্ষেত্রে ব্রেনের একটা বিশেষ সমস্যা দেখতে পাওয়া যায়। কথার ‘ভাব’ উৎপাদন ও তা শব্দ আকারে প্রকাশ করার ক্ষেত্রে আমাদের বাম মস্তিষ্ক সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। ডান মস্তিষ্ক এক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় থাকে। কিন্তু যাদের মধ্যে শব্দের হ্যালুসিনেসন হয় তাদের ডান ও বাম মস্তিষ্কের মধ্যে কাজের এই নির্দিষ্টতা দেখা যায় না। এদের ক্ষেত্রে ডান বাম উভয় মস্তিষ্ক সমান সমান মাত্রায় ক্রিয়াশীল থাকে। ডান মস্তিষ্কের অযাচিত সক্রিয় শব্দের হ্যালুসিনেসনের একটা কারণ। ডাঃ জিল্লুর কামাল মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ চেম্বার : মনের ঠিকানা ৪৩৫ বড় মগবাজার, ওয়্যারলেস রেলগেট, ঢাকা ০১৭১১ ৭১৯৫৩৭ [email protected]
×