ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নীল আলোর দংশন, ফসলের মাঠ থেকে পোকা সাফ

প্রকাশিত: ০৯:১৩, ২১ মে ২০১৯

নীল আলোর দংশন, ফসলের মাঠ থেকে পোকা সাফ

সমুদ্র হক ॥ ফসলের মাঠে পোকার অত্যাচারে অতিষ্ঠ কৃষক মাহমুদ এখন খুব খুশি। নীল আলোর দংশনে পোকা উড়ে পালাতেও পারেনি। গামলার পানিতে পড়ে মরেছে। তার প্রায় ৮ বিঘা জমির ফসল ক্ষতিকর পোকার থাবা থেকে রক্ষা পেয়েছে। প্রতি বছর উৎপাদিত ফসলের অন্তত ১৫ শতাংশ নষ্ট হতো শুধু পোকার আক্রমণে। বগুড়ার নুনগোলা ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের প্রায় ৪শ’ বিঘা জমিতে এখন আর পোকা বসতে পারে না। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) উদ্ভাবিত সৌরশক্তির নীল আলোর ফাঁদ পোকার আক্রমণ থেকে ফসল রক্ষা করছে। কৃষকের অনেক সাশ্রয় হয়ে বাড়তি ফসল উৎপাদিত হচ্ছে। কৃষকরা জানান, একেক ফসলের একেক রকম পোকা দমনে কীটনাশক প্রয়োগ করতে হতো। কীটনাশক মূলত পোকা দমনের বিষ। যা পরোক্ষভাবে খাদ্যে যুক্ত হয়। কীটনাশক স্পে করার সময় কৃষক মুখ ঢাকা গামছা সরিয়ে নিলে শ^াস প্রশ^াসও বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়। বলা যায় খাদ্য ও কৃষক স্লোপয়জনিংয়ের মধ্যে পড়ে। একটা সময় কৃষক ফসলের মাঠে হারিকেন জ্বালিয়ে পোকা নিধনের চেষ্টা করেছে। এই প্রচেষ্টা কিছুটা সুফল এনে দিলেও তা ততটা কার্যকর ছিল না। ব্রি গবেষকগণ কয়েক মাসের গবেষণায় পোকা দমনে সৌরশক্তির মাধ্যমে রাতের অনেকটা সময় ফসলের মাঠে নীলবাতি জ্বালিয়ে সব ধরনের পোকা দমনে সুফল পেয়েছেন। এতে খরচ অনেক কম। সাশ্রয়ী প্রযুক্তি। ব্রির কীটতত্ব বিভাগের সহযোগিতায় ফার্ম মেশিনারী এ্যান্ড পোস্টহারভেস্ট টেকনোলজি (এফএমপিএইচটি) বিভাগ সৌরশক্তির আলোর ফাঁদ উদ্ভাবন করে। গবেষণায় ছিলেন ড. মোঃ দুররুল হুদা, ড. মোঃ গোলাম কিবরিয়া ভূঞা, বিধান চন্দ্র দাস, ড. মোঃ পান্না আলী, ড. মুহাম্মদ আব্দুর রহমান। প্রযুক্তিতে দরকার একটি ১৬ দশমিক ৮ ভোল্ট/২০ ওয়াটের সোলার প্যানেল, ডিসি ১২.৮ ভোল্ট/ ৭.৫ এ্যাম্পেয়ার পি ০৪ টাই পলিথিয়াম আয়রন ফসফেট ব্যাটরি, ডিসি ১২ ভোল্টের একটি কন্ট্রোলার, ডিসি ১২ ভোল্ট ৮ ওয়াটের একটি বৈদ্যুতিক বাতি ও একটি প্লাস্টিকের গামলা। এমএস পাইপের একটি স্ট্যান্ডে ফ্রেমের ওপর একটি সোলার প্যানেল উত্তর-দক্ষিণ কোণে স্থাপনের পর প্যানেলের নিচে থাকবে একটি নীল বাতি। বাতিটি ঢাকনার নিচে রাখতে হয় যাতে বৃষ্টির পানি না পড়ে। বাতির নিচে রাখতে হয় পানি ভর্তি একটি গামলা। পোকা উড়ে এসে দুর্বল হয়ে গামলায় রাখা পনিতে ডুবে মরে। এই বাতি ব্যাটারি, কন্ট্রোলার ও ইনভার্টারের (ডিসিকে এসিতে) মাধ্যমে পরিচালিত হয়। যা দিনের বেলা স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে সৌরশক্তি সঞ্চয় করে সন্ধ্যা থেকে রাতের অনেটা সময় ফসলের মাঠে নীল বাতি জ¦লে। ব্যাটারি ও বৈদ্যুতিক বাল্বের মেয়াদ দুই বছর। সৌর প্যানেলের মেয়াদ বিশ বছর। নীল বাতি ব্যবহারের বিষয়ে গবেষকগণের কথা : যে কোন ধরনের আলোতেই পোকা আকর্ষিত হয়। তীব্রতা ও রঙের ওপর আকর্ষণের মাত্রা কম বেশি হয়। তিনটি রঙের ওপর পোকার আকর্ষণ বেশি। নীল, হলদেটে ও ফিকে সবুজ। এর মধ্যে সোলার লাইট ট্র্যাপে নীল রঙের বাতির প্রতি পোকার আকর্ষণ বেশি। ফসলের মৌসুম শেষে এই ফাঁদটি মাঝে মাঝে চার্জ দিয়ে ব্যাটারি সচল রাখতে হয়। যে পোকামাকড় উড়ে উড়ে বিচরণ করে এবং নিশাচর এই পোকার মথকে নীল অলোর দংশনে দমন করা যায়। ফসলের মাঠে রোগ বিস্তারকারী নানা ধরনের পোকা মাকড়ের বাস। অনেক পোকা ও পোকার মথ ভাইরাস ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাকের মতো রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু বহন করে। এই ফাঁদ এ ধরনের পোকামাকড় দমন সম্ভব। ধানের মাজরা, কাইচথোর কালিন যাবতীয় ফড়িং, বাদামি গাছ ফড়িং, সবজির ফল ছিদ্রকারী শোষক পোকা, চিবানো পোকার আক্রমণ দেখা মাত্র এই ফাঁদ বসাতে হবে। প্রথম দিকে পোকামাকড় বেশি মড়বে। পরে তা কমতে থাকবে। প্রতি একর জমিতে পৃথক আলোর ফাঁদ বসাতে হবে। পুকুরে মাছ চাষের সময় এই ফাঁদ বসানো যায। মরা পোকা পুকুরে পড়ে মাছের সম্পূরক খাবার তৈরি হয়। বগুড়ার কৃষকরা বলছেন, ধান ছাড়াও দানাদার ফসল, সবজি যেমন শিম বরবটি বেগুন করলা নানা ধরনের সবজির পোকা দূর করা যায়। আগে কীটনাশক ছিটানোতে বাড়তি শ্রম দিতে হতো। এখন নীল বাতি যথেষ্ট। কৃষি বিভাগ জানায়, বগুড়া নগরী থেকে ৯ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে নুনগোলা, গোকুল, সাবগ্রামে ৪টি করে ১২টি সৌরশক্তির নীল ফাঁদ স্থাপিত হয়েছে। এর আগে পাইলট প্রকল্পের আওতায় স্থাপিত এই ফাঁদে কৃষকরা উপকৃত হয়েছে। ব্রির গবেষকগণ জানান, প্রতি বছর ফসলের অন্তত ১৫ শতাংশ পোকায় খেয়ে ফেলে। পোকা দমনে প্রতি বছর প্রায় ১৫ হাজার টন কীটনাশক ব্যবহার হরা হয়। এই কীটনাশকের মূল উপাদান আমদানি করতে বিপুল বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করতে হয়। নীল বাতির এই ফাঁদ ব্যবহারে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে। তারা জানান, বর্তমানে খাদ্যে বিষক্রিয়া নিত্য ঘটনা হয়েছে। দেশের প্রত্যেক মানুষ এই দুর্যোগের শিকার। কীটনাাশক প্রয়োগের ২১ দিনের মধ্যে ফসল ব্যবহার না করার পরামর্শ দেয় কোন কোম্পানি। এ থেকে পরিষ্কার বুঝে নেয়া যায় এই ফসলে বিষ আছে। কোন কোন কৃষক না বুঝেই ২১ দিনের আগে ফসল বিক্রি করে। পোকাকে নীল দংশনের এই বাতি বিষমুক্ত খাবারের নিশ্চয়তা দেবে। প্রযুক্তিটি দ্রুত মাঠ পর্যায়ের পৌঁছে দিয়ে প্রয়োগের আহ্বান জাানিয়েছেন ব্রির গবেষকরা।
×