ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সংগ্রহ নীতিমালায় কৃষকের প্রাধান্য না থাকায় সুযোগ নিচ্ছেন মধ্যস্বত্বভোগী

কৃষক বাঁচাতে সরাসরি চালের বদলে ধান কেনার সুপারিশ

প্রকাশিত: ১১:২০, ২২ মে ২০১৯

কৃষক বাঁচাতে সরাসরি চালের বদলে ধান কেনার সুপারিশ

রশিদ মামুন ॥ খাদ্য মজুদ ক্ষমতা অপ্রতুল আর সংগ্রহ নীতিমালায় কৃষকের প্রাধান্য না থাকায় সুযোগ নিচ্ছেন মধ্যস্বত্বভোগী। বছরের পর বছর ধরে বঞ্চিত হচ্ছেন কৃষক। মৌসুমের শুরুতে ধানের দাম পড়ে গেলে কৃষক অশ্রুতে চোখ ভাসায়। বছর ঘুরতেই আবার একই চিত্র ফুটে উঠে। কিন্তু কৃষকের সমস্যা সমাধানে বাস্তবমুখী কার্যকর কোন পদক্ষেপ না নেয়ায় কৃষক আর কৃষি প্রতিনিয়ত সমস্যার মধ্যেই ঘুরপাক খায়। চলতি মৌসুমেও উচ্চমূল্যে ধান চাষ করে বাজার দর ভাল না পাওয়ায় হতাশ কৃষক ধানে আগুন দিচ্ছেন। সেই হতাশা থেকে বলছেন আর করব না ধান চাষ, দেখব তোরা কি খাস। কৃষক বাঁচাতে চালের বদলে প্রতি বছর সরাসরি ধান সংগ্রহের সুপারিশ করছেন সংশ্লিষ্টরা। প্রকৃত কৃষকের তালিকা তৈরি করে সরাসরি তাদের কাছ থেকে ধান কেনার কথাও বলছেন বিশেষজ্ঞরা। একই সঙ্গে খাদ্য শস্য মজুদ ক্ষমতা বৃদ্ধি করার কথাও বলছেন তারা। প্রতি কেজি চালের উৎপাদন খরচ ২২ থেকে ২৩ টাকা। সরকার দাম দিচ্ছে ৩৬ টাকা। অর্থাৎ প্রতি কেজি চালে লাভ হচ্ছে সর্বোচ্চ ১৪ টাকা করে। এভাবে এক মণ চালে লাভ হচ্ছে ৫৬০ টাকা। কৃষক ধান বিক্রি করছেন প্রতি মণ ৫২০ টাকায়। সরকার কৃষি আর কৃষকের জন্য ভর্তুকি দিলেও তা চলে যাচ্ছে চাল কল মালিকদের পকেটে। সরকার এ বছর বাজার থেকে ১৩ লাখ টন খাদ্য শস্য কিনতে যাচ্ছে। এর মধ্যে ১১ লাখ ৫০ হাজার টন চাল আর মাত্র দেড় লাখ টন ধান। সেই হিসেবে প্রতি উপজেলায় মাত্র ৩১১ টন ধান সংগ্রহ করা হবে। খাদ্যশস্য সংগ্রহ নীতিমালাতে বলা হয়েছে একজন কৃষক এক মৌসুমে সর্বোচ্চ তিন টন বা ৭৫ মণ ধান সরবরাহ করতে পারবেন। সাদাচোখে দেখলে প্রতি উপজেলায় মাত্র ১০৩ জন থেকে সর্বোচ্চ ১৫০ জন কৃষককে এই সুবিধা দেয়া সম্ভব। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে একটি উপজেলায় কি এত অল্পসংখ্যক কৃষক ধান চাষ করেন। তাহলে বাকিদের কি হবে! খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, সীমিতসংখ্যক কৃষককেও এই সুবিধা দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা বছর শেষে ধান সংগ্রহের যে তালিকা করেন সেই তালিকা ধরেই ধান কেনে উপজেলা খাদ্য গুদামগুলো। কিন্তু তালিকাটি করা হয় রাজনৈতিক প্রভাবে। স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিরা যাদের নাম বলেন, উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাধারণত তাদের নামই তালিকা করে পাঠান। কর্মকর্তারা বলছেন, তালিকাকে কৃষকের নাম এবং তার কার্ড নাম্বার এবং ব্যাংক হিসাব নাম্বার থাকে। যার সব কিছুই ভাড়া করা হয় এক থেকে ২ হাজার টাকায়। আর এর আড়ালে থাকেন রাজনৈতিক এক বা একাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তি। তিনি আবার স্থানীয় কোন ফড়িয়ার কাছে পুরো প্রক্রিয়াটি বিক্রি করে লাভের টাকা বুঝে নিয়ে সরে পড়েন। ধান পাকলেই সক্রিয় হয় এই চক্র। যার ধারে কাছেও ভিড়তে পারেন না কৃষক। কিন্তু সবাই জানলেও প্রমাণ করা দুঃসাধ্য এখানে কৃষক সুবিধা পাচ্ছেন না। আবার কেন কৃষক সরাসরি ধান নিয়ে গেলেও ধানের মধ্যে জলীয় অংশের (মশ্চেয়ার) পরিমাণের দোহায় দিয়ে কৃষকের কাছ থেকে ধান নেয়া হচ্ছে না। নীতিমালায় বলা হয়েছে ধানের মধ্যে সর্বোচ্চ ১৪ ভাগ মশ্চেয়ার থাকার বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। কিন্তু কৃষকের ধানের মধ্যে এর চেয়ে বেশি জলীয় অংশ থাকে। খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, মশ্চেয়ার ১৬ ভাগ থাকলেও কোন ক্ষতি নেই। কারণ ধান সংগ্রহ করে সঙ্গে সঙ্গেই মাড়াই করতে দেয়া হয়। কোন গুদামে ধান সংগ্রহ করা হয় না। কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক বলছেন, রাজনৈতিক প্রভাবের কারণেই কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনা যাচ্ছে না। মন্ত্রী জানিয়েছেন সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে চিন্তা ভাবনা করা হচ্ছে। সরকারও বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত। খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, চালের বদলে ধান কিনলেই কৃষক বাঁচানো সম্ভব। তারা বলছেন এই প্রক্রিয়া শুরু করা উচিত ধান রোপণের সময় থেকে। এই সময় উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার অফিসের ব্লক সুপারভাইজাররা গ্রামে গ্রামে গিয়ে কৃষকের তালিকা করবেন। ধান ওঠার আগেই সেই তালিকা খাধ্য অধিদফতরের মাধ্যমে উপজেলাগুলোতে হস্তান্তর করা হবে। ধান কাটার শুরুতেই যাতে প্রকৃত কৃষকের তালিকা ধরে ধান সংগ্রহ করা যায় সেই ব্যবস্থা করা হবে। আর তা যদি নাও করা হয় তাহলে শুধু চালের বদলে ধান সংগ্রহের ঘোষণা দিলেও কৃষক সুবিধা পেত। খাদ্য বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, বাজার থেকে ধান কেনার পর পর সরাসরি তা মিল মালিকদের কাছে দিয়ে দেয়া হয়। মাড়াই করে গুদামে চালই সংরক্ষণ করা হয়। তিনি প্রশ্ন তোলেন তাহলে ধান কিনতে সমস্যা কোথায়। ওই কর্মকর্তা ২০১৬ সালের কথা উল্লেখ করে বলেন, ওই বছর বাজার থেকে ২৪ টাকা প্রতি কেজি দরে ৮ লাখ টন ধান সংগ্রহ করা হয়। যা মাড়াই করে সাড়ে চার লাখ টন চাল গুদামে সংরক্ষণ করা হয়। তিনি বলেন, ২০১৬ সালে এতে করে মোটা ধানের দাম মণপ্রতি ৮০০ টাকা হয়েছিল। কৃষক খুশি ছিল। খাদ্য বিভাগের পরিচালক (সংগ্রহ) জুলফিকার রহমান বলেন, সরকার যেভাবে নীতিমালা তৈরি করে সেইভাবেই আমরা সংগ্রহ অভিযান পরিচালনা করি। এটা সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্তের বিষয়। তবে তিনি মনে করেন সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনা হলে বাজারের পরিস্থিতি ভাল হতো। তিনি জানান, সরকার যে ১৩ লাখ টন খাদ্য শস্য সংগ্রহের ঘোষণা দিয়েছে। যা সংগ্রহ করে রাখার জায়গাই নেই। ফলে শেষ পর্যন্ত অর্ধেক পরিমাণ খাদ্য শস্যও বাজার থেকে কেনা সম্ভব হবে বলে মনে করেন তিনি। খাদ্য অধিদফতর সূত্র বলছে, এখন দেশের গুদামগুলোতে মোট ধারণ ক্ষমতা ২১ লাখ টন। এর মধ্যে ১৮ লাখ টন চাল এবং ৩ লাখ টন গম। ১৮ লাখ টন চালের গুদামে এখনই মজুদ রয়েছে ১১ লাখ টন। আর সর্বোচ্চ বাজার থেকে সাত লাখ টন চাল কেনা যেতে পারে। অর্থাৎ ঘোষিত সংগ্রহ অভিযানের চেয়ে এই পরিমাণ আরও ৬ লাখ টন কম। তিনি জানান, এবার বাম্পার ফলনের ফলে ২ কোটি টন চাল উৎপাদন হয়েছে। এছাড়া আমন মৌসুমের ধানও মিল মালিকদের কাছে রয়ে গেছে। এ ছাড়া কিছু আমদানি করা চালও আমদানিকারকদের কাছে রয়েছে। সব মিলিয়ে বাজারে চালের চাহিদা কম থাকায় ধানের নাম উঠছে না। প্রখ্যাত কৃষি বিষয়ক সাংবাদিক শাইখ সিরাজ বলেন, দেশে প্রতি বছর খাদ্য শস্য উৎপাদন হয় তিন কোটি টন। আর সরকারী গুদামে ধারণ ক্ষমতা মাত্র ২১ লাখ টন। সরকার যদি বাজার নিয়ন্ত্রণে পুরো ২১ লাখ টনই ক্রয় করে মজুদ করে তারপরও তিন কোটি ৩০ লাখ টন খাদ্য সশ্য সরকারী গুদামের বাইরে থাকে। তার মতে এত অপ্রতুল মজুদ দিয়ে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। তিনি মনে করেন কৃষকের সমস্যা সমাধান করতে হলে সরকারী গুদামের ধারণ ক্ষমতা হওয়া উচিত অন্তত ৫০ লাখ টন। তিনি বলেন, সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে কখনওই ধান কেনা হয় না। কৃষকের ধানে বেশি জলীয় অংশ থাকার কথা বলে চাতাল মালিকদের কাছ থেকে ধান কেনা হয়। এতে সরকার খাদ্য শস্য উৎপাদনে যে ভর্তুকি দেয় তা চলে যায় চাতাল মালিকদের পকেটে।
×