ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

তপন পালিত

তার চিন্তা ও কর্মের পরিধি ব্যাপক

প্রকাশিত: ০৮:৫৫, ২৩ মে ২০১৯

তার চিন্তা ও কর্মের পরিধি ব্যাপক

মানুষ আছে তার দুই ভাবকে নিয়ে, একটা তার জীবভাব, আর-একটা বিশ্বভাব। জীব আছে আপন উপস্থিতকে আঁকড়ে, জীব চলছে আশু প্রয়োজনের কেন্দ্র প্রদক্ষিণ করে। মানুষের মধ্যে সেই জীবকে পেরিয়ে গেছে যে সত্তা সে আছে আদর্শকে নিয়ে। এই আদর্শ অন্নের মতো নয়, বস্ত্রের মতো নয়। এ আদর্শ একটা আন্তরিক আহ্বান, এ আদর্শ একটা নিগূঢ় নির্দেশ। কবিগুরুর উপরের কথাগুলো একজন মানুষের ক্ষেত্রে খুবই প্রাসঙ্গিক আর তিনি হলেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের বঙ্গবন্ধু অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন। রাজপথের ঐতিহাসিক এই অধ্যাপক মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে বুকে ধারণ করে তা বিস্তারের জন্য অবিচল কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি একটি কথা সবসময় বলেন, ‘পথে না নামলে দাবি আদায় হয় না।’ এই বিশ্বাস থেকেই তিনি শিক্ষকতার পাশাপাশি সারাজীবন রাজপথে কাটিয়েছেন। দাবি আদায়ের জন্য তিনি লেখালেখি, সংগঠন প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি আদালতেরও দ্বারস্থ হয়েছেন অনেকবার। তিনি এমন একজন শিক্ষক যিনি ক্লাসরুমে শিক্ষকতার পাশাপাশি ইতিহাসকে ক্লাসরুমের বাইরে সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে গিয়েছেন। এ সম্পর্কে বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের একটি উক্তি প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেন, ‘তীব্র সমাজবোধ থেকে ইতিহাসকে কেতাব থেকে বের করে সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে গেছেন তিনি। মামুন একাডেমিক ইতিহাসের সঙ্গে লড়াই করে ইতিহাসকে সাধারণ মানুষের কাছে দায়বদ্ধ করে তুলেছেন এবং ইতিহাসকে জবাবদিহি করতে বাধ্য করেছেন সাধারণ মানুষের কাছে।’ উদারনৈতিক সমাজ গড়ার প্রত্যয়ে তিনি রাজনৈতিক ভাষ্যে এবং মৌলবাদ ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে রাজপথের লড়াইয়ের অগ্রণী সংগ্রামী হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছেন। মুক্তচিন্তা ও উদারনৈতিক সমাজ গড়ার সংগ্রামে তিনি বার বার সম্মুখীন হয়েছেন বৈরী শক্তির। মুক্তবুদ্ধির চেতনার জন্য অন্তত চারবার তাঁকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে, তিনবার ঘোষণা করা হয়েছে মুরতাদ। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সহ-সভাপতি হিসেবে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের আন্দোলনে পালন করেছেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকার্য শুরু হলে অনেক বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী যখন প্রাণের ভয়ে সাক্ষী দিতে রাজি হননি তখন তিনি এগিয়ে এসেছেন দায়িত্ববোধ ও আদর্শের টানে। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগে তিনি ছিলেন প্রথম সাক্ষী। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে কেন্দ্র করে শাহবাগে গণজাগরণমঞ্চ প্রতিষ্ঠিত হলে হেফাজতে ইসলাম ঢাকা দখলের হুমকি দেয়। নির্মূল কমিটির আহ্বানে সারাদেশে হরতাল চলকালে ২০১৩ সালের ৫ মে হেফাজতে ইসলাম ঢাকা আক্রমণ করে। ঢাকায় প্রবেশের পথে হেফাজতের কয়েক হাজার কর্মী মহাখালীতে নির্মূল কমিটির সমাবেশে আক্রমণ করে সভাস্থল চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেয়। তখন দেখেছি তিনি কতটা অবিচল থেকে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে পারেন। হেফাজতের তাণ্ডব থামানোর জন্য তিনি রাজপথে পিকেটিং করেছেন। কারণ, তখন তাঁর কাছে হেফাজতের তাণ্ডব থামানো জরুরী মনে হয়েছে। তারপরও হেফাজতের তাণ্ডব থামানো সম্ভব হয়নি। শাহরিয়ার কবিরকে সহযোদ্ধারা সরিয়ে নিলেও পুলিশ বা আমরা অনেক চেষ্টা করেও তাঁকে সভাস্থল থেকে সরাতে পারিনি। তিনি শুধু একটি কথা বললেন, ‘দাবি আদায়ের আন্দোলন করতে গিয়ে এই রাজপথেই একদিন আমার পাশেরজন গুলি খেয়ে মারা গেছেন। সেদিন আমিও মারা যেতে পারতাম। তাই ভয় পাওয়ার কিছু নেই।’ তাঁর এই অবিচল অবস্থান দেখে যেমন অবাক হয়েছি, তেমনি তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা বৃদ্ধি পেয়েছে হাজারগুণ। অনেকের মতো তিনি শুধু এসিরুমে বসে বক্তৃতা করে বা ক্লাস নিয়ে দায়িত্ব শেষ করেননি, বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে রাজপথে থেকে দাবি আদায়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি চিন্তা ও কর্মের পরিধি ব্যাপক। তিনি শুধু ইতিহাস ও সাহিত্যচর্চা তথা গ্রন্থ রচনার মধ্যে তাঁর কর্ম সীমাবদ্ধ রাখেননি। অধ্যাপনা ও গবেষণার পাশাপাশি সংগঠন গড়ে তুলেছেন, দেশের নানা বিদ্বৎ কাজে সম্পৃক্ত হয়েছেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি বাংলাদেশের প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত। স্বাধীন বাংলাদেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের তিনি ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। বাংলাদেশ লেখক শিবির ও বাংলাদেশ লেখক ইউনিয়নের তিনি অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও প্রথম যুগ্ম-সম্পাদক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেই স্থাপন করেছিলেন ইতিহাস চর্চা কেন্দ্র। এছাড়াও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর, ঢাকা নগর জাদুঘর, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তিযুদ্ধ বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ গবেষণা ইনস্টিটিউট, ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর বেঙ্গল স্টাডিজ (আইবিএস), বাংলাদেশ ব্যাংক ঢাকা জাদুঘর প্রতিষ্ঠায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। অসাম্প্রদায়িক গণমুখী ইতিহাস চর্চার জন্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনী। তাঁর নেতৃত্বে এই সংগঠনের উদ্যোগে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল পর্যায়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস পাঠ বাধ্যতামূলক করা হয়। খুলনায় তিনি গড়ে তুলেছেন ‘১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর’ নামে বাংলাদেশর প্রথম গণহত্যা জাদুঘর। দেশের বাইরে ত্রিপুরা রাজ্যের চোত্তখোলায় স্থাপন করেন মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত উদ্যান। এছাড়া তাঁর উদ্যোগে ত্রিপুরা রাজ্য সরকার জাতীয় জাদুঘরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরার ভূমিকার জন্য ‘মুক্তিযুদ্ধ ও ত্রিপুরা’ নামে একটি কর্নার প্রতিষ্ঠা করেছে। এভাবে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও ইতিহাসকে ছড়িয়ে দিতে প্রয়াসী হয়েছেন নানা ক্ষেত্রে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সমাজে জাগরুক রাখতে তিনি সদা জাগ্রত থেকে জনস্বার্থে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পেছনে ভুয়া মাজার সরানোর জন্য তিনি রিট করেন, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধী কারও নামে স্থাপনা না হওয়ার জন্য রিট করেন এবং রিট করেন বধ্যভূমি ও গণহত্যারস্থল সংরক্ষণের জন্য। এর প্রত্যেকটির পক্ষে তিনি রুল পেয়েছেন। যে কারণে খুলনার শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী খান এ সবুরের নামের সড়ক তার পূর্বতন নাম ‘যশোর রোড়’ ফিরে পেয়েছে। তিনি পত্রিকার পাতায় কলাম লিখে সাধারণ মানুষের সামনে তুলে ধরেন গোলাপ শাহ মাজার সত্যিকার অর্থে কোন মাজার নয়। তাঁর এই সাহসী পদক্ষেপ জনসমাজের অন্ধত্ব দূর করতে সহায়তা করে। এছাড়া ২০০১ সালের নির্বাচনের পর ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সন্ত্রাসীদের হামলার প্রতিবাদ করায় মিথ্যা মামলায় তাঁকে কারাবরণও করতে হয়েছে। কিন্তু তিনি রাজপথ থেকে ভয় পেয়ে সরে আসেননি। মুনতাসীর মামুন রচনাবলীর সম্পাদক মামুন সিদ্দিকী তাঁর সম্পর্কে একটি তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, ‘অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন লেখালেখি, সভা-সমিতি, সংগঠন প্রতিষ্ঠা এবং আন্দোলনের মাধ্যমে দীর্ঘ কর্মময় জীবনে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বিস্তারের মাধ্যমে যে শক্ত ভিত তৈরি করেছেন সে ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে আজ অনেকে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন।’ সে হিসাবে বলা যায়, তাঁর গবেষণাকর্ম, বক্তৃতা, বিবৃতি, চিন্তা-ভাবনা, সংগঠন প্রতিষ্ঠা সবই তো জাতির জন্য আলোকদিশারি। মনীষী আবুল ফজলকে বলা হতো জাতির বিবেক। সে অর্থে মুনতাসীর মামুনকে বলা যায় জাতির আলোকদিশারি। প্রজ্বলিত প্রদীপ হাতে তিনি এগিয়ে যাচ্ছেনÑ তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক ভূমিকা সেই ধারারই প্রবর্তক। তিনি এমনই একজন গুরু যিনি শিষ্যদের ইতিহাস চর্চার পাশাপাশি সত্য ও ন্যায়ের পথে অবিচল থেকে ক্লাসরুমের বাইরে এসে দাবি আদায়ে রাস্তায় নামতে শিখিয়েছেন। আজ তার ৬৮তম জন্মদিন। অনেক অনেক শুভেচ্ছা ও শুভকামনা তার প্রতি। লেখক : সহকারী অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
×