ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

রিফাত কান্তি সেন

মুক্তিযোদ্ধাদের রান্না করে খাওয়াতেন তিনি

প্রকাশিত: ০৯:১০, ২৩ মে ২০১৯

 মুক্তিযোদ্ধাদের রান্না  করে খাওয়াতেন তিনি

সময়টা ছিল বাঙালী জাতির জন্য খুবই দুঃসময়ের। পাক হানাদার বাহিনীর নির্মম নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছিল গোটা জাতিকে। ১৯৭১ সাল। বাঙালী ঝাঁপিয়ে পড়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে। বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ভাষণে পুরো জাতি যেন একই সুতোয় গেঁথে যান। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় এদেশ থেকে প্রায় এক কোটি লোক পালিয়ে ভারতে যায়। তাঁদের আমরা শরণার্থী হিসেবেই জানি। ভারতের কলকাতার শরণার্থী শিবিরের কথা অনেকেরই জানা। সেখানে ছিল যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা। আবার যারা দেশের জন্য যুদ্ধ করতে ভারতে ট্রেনিং এ গিয়েছিল তারাও সেখানে ছিল। তাঁদের সেবার দায়িত্বে ছিলেন অনেকেই। তাঁর মধ্যে একজন দুঃসাহসী দেশ প্রেমীক বাঙালী নারী ছিলেন, তিনি মায়া ঘোষ। পৃথিবীর মায়া ছেড়ে তিনি এখন দূর আকাশের তারা। নিঃস্বার্থ এ মানুষটি দেশ সেবার যে ব্রত পালন করেছিলেন তাতে তিনি সফলতাও অর্জন করেছেন। দেশের সূর্য সন্তানদের তিনি রেঁধে খাইয়েছিলেন। ভাত রেঁধে খাওয়াতেন মুক্তিযোদ্ধাদের। দিনের পর দিন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তিনি যে ত্যাগ স্বীকার করে গেছেন এটা তাঁর জন্য এক অনবদ্য ভালবাসা আর দেশ প্রেমের গল্প। যেখানে মিশেছিল হৃদয়ের গহীনের জমানো ভালবাসা। দেশের জন্য যারা প্রাণপণে লড়ে যাচ্ছেন তাঁদের ভাত রান্না করে দিতে পেরে বেশ প্রফুল্ল বোধ করতেন মায়া ঘোষ। মায়া ঘোষকে এ যুগের ছেলেমেয়েরা হয়ত অভিনয় শিল্পী হিসেবেই চিনে। ছোট বড় মিলিয়ে সব পর্দায়ই ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ। বর্ণাঢ্য তাঁর অভিনয় জীবনে তিনি দু’শতাধিক ছবিতে অভিনয় করায় বেশ আলোচিত এবং পরিচিত মুখ ছিলেন। মাত্র আট বছর বয়সে অভিনয় জগতে আসা মায়া ঘোষের চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন বেশ দেরিতে। ১৯৮১ সালে ‘পাতাল বিজয়’ ছবির মধ্যে দিয়ে তাঁর অভিষেক হয় চলচ্চিত্রে। দীর্ঘ তার চলচ্চিত্র জীবনে ভক্তদের ভালবাসাও পেয়েছেন বেশ। কিন্তু অনেকেই জানেন না টিভি পর্দায় অভিনয় করা মায়া ঘোষ একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ভাত রেঁধেছিলেন। যুদ্ধাহতদের সেবা করে সুস্থ করার জন্য। মঞ্চনাটক থেকে শুরু করে টিভিনাটক সব ক্ষেতেই ছিল তাঁর অসামান্য অবদান। কিন্তু দেশ সেবার যে ব্রত তিনি পালন করেছেন সে অবদান চোখ বন্ধ করলে অনুভব করা যায়। একাত্তরের এ বীর মুক্তিযোদ্ধা অন্যকে সেবা করে সুস্থ করে তুললেও জীবন যুদ্ধে তিনি ঠিকই হেরে গেছেন। মরণব্যাধি ক্যান্সারকে জয় করতে পারেননি। ২০০০ সালে মরণব্যাধি ক্যান্সার শনাক্ত হয় তার দেহে। ২০০১ সালে কলকাতার সরোজগুপ্ত ক্যান্সার হাসপাতালে চলে তার চিকিৎসা। ২০০৯ সালে তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন। প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসে তার মাঝে। কিন্তু হঠাৎ আবার ২০১৮ সালের অক্টোবর মাসের দিকে তার শরীরে আবারও ক্যান্সার ধরা পড়ে। চলতি বছর তাকে আবারও নেয়া হয় কলকাতায়। কিন্তু অবস্থার অবনতি দেখে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে যশোর কুইন্স হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগত হারালো একজন গুণী অভিনেত্রীকে দেশ হারালো একজন ভাল মানুষকে যিনি কিনা দেশের জন্য প্রাণপণে লড়েছিলেন একাত্তরে। বাঙালী আজীবন স্মরণ করবে এ গুণী অভিনেত্রীকে। মৃত্যুকালে এ মুক্তিযোদ্ধা ও চলচ্চিত্র অভিনেত্রীর বয়স হয়েছিল সত্তর বছর। সর্বশেষ তাকে ২০১৬ সালে ছোট পর্দায় দেখা গিয়েছিল।
×