ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ইটভাঁটির ধোঁয়ায় পুড়ছে ৩শ’ একরের ফসল

প্রকাশিত: ০৯:২৭, ২৩ মে ২০১৯

ইটভাঁটির ধোঁয়ায় পুড়ছে  ৩শ’ একরের ফসল

সাজেদুর রহমান শিলু, দিনাজপুর ॥ জেলার প্রায় ৫শ’ কৃষকের স্বপ্ন পুড়েছে ইটভাঁটির কালো ধোঁয়া ও গ্যাসের প্রভাবে। জেলার খানসামা, চিরিরবন্দর, বীরগঞ্জ ও সদর উপজেলায় ভাঁটির প্রভাবে নষ্ট হয়েছে ক্ষেতের ফসল। এই চার উপজেলায় পৃথক পৃথক ইটভাঁটির প্রভাবে প্রায় ৩শ’ একর জমির ধান, ভুট্টা, টমেটো ক্ষেত, লিচু, আম, কলাসহ অন্যান্য ফসল পুড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ার মতো অবস্থা হয়েছে পাঁচ শতাধিক কৃষকের। এসব কৃষক পরিবারের আশঙ্কা, যদি এসব ফসলের ক্ষতিপূরণ পাওয়া না যায়, তাহলে পরিবার-পরিজন নিয়ে তাদের না খেয়ে দিন কাটাতে হবে। তবে কৃষকদের ক্ষতির বিষয়গুলো নিয়ে উপজেলা প্রশাসন কাজ করছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক। জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের তথ্যমতে, দিনাজপুর জেলায় মোট ইটভাঁটি রয়েছে ২শ’ ৫২টি। এর মধ্যে সদরে ২৬, চিরিরবন্দরে ৩৯, খানসামায় ৬ ও বীরগঞ্জে ২৯টি। এছাড়াও ফুলবাড়ীতে ১১, বিরলে ১৭, ঘোড়াঘাটে ৮, পার্বতীপুরে ৪৩, নবাবগঞ্জে ৩৩, বিরামপুরে ১০, কাহারোলে ৮, বোচাগঞ্জে ২১, চিরিরবন্দরে ৩৯ ও হাকিমপুরে একটি ইটভাঁটি রয়েছে। এর প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে খানসামা উপজেলার ভাবকী ইউনিয়নের কুমড়িয়া গ্রামে। সেখানকার এসএইচএস এবং টু-স্টার নামে দুটি ইটভাঁটির বিষাক্ত ধোঁয়ায় ওই এলাকার প্রায় ২শ’ একর জমির বোরো ধান, আম, কাঁঠাল, লিচুসহ পুড়ে গেছে বাঁশঝাড়। শুধু তাই নয়, বিষাক্ত গ্যাসের কারণে মারা গেছে খামারের চার শতাধিক মুরগি। ওই দুটি ইটভাঁটির কারণে পার্শ্ববর্তী চিরিরবন্দর উপজেলার নশরতপুর এলাকারও প্রায় ২০ একর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দিনে দিনে আক্রান্ত এলাকার পরিমাণও বাড়ছে। জানা গেছে, এ বছর ২৮ ও ২৯ এপ্রিল এসএইচএস এবং টু-স্টার ভাঁটিতে ইট তৈরির কার্যক্রম স্বাভাবিক নিয়মেই বন্ধ করে দেয়া হচ্ছিল। বন্ধ করার সময় হঠাৎ ভাঁটির চিমনি দিয়ে বিষাক্ত এবং দুর্গন্ধযুক্ত ধোঁয়া বের হয়। এর ফলে এলাকার কুমড়িয়ার আলমপাড়া, ম-লের বাজারসহ প্রায় তিন কিলোমিটারজুড়ে বোরো ফসল নষ্ট হয়ে যেতে শুরু করে। বিষয়টি কৃষকরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে অবহিত করলে প্রশাসনের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। কুমড়িয়া আলমপাড়ার রবিউল ইসলাম জানান, তার ৪৫ শতক জমিতে তিনি বোরো করেছেন। কিন্তু কয়েকদিন আগে দেখেন গাছে আসা ধান সব কালো হয়ে পুড়ে গেছে। ভেতরে নেই কোন চাল, এখন সবচেয়ে বড় চিন্তা, ধান না হওয়ায় একদিকে লোকসান অন্যদিকে পরিবারের সদস্যদের না খেয়ে থাকতে হবে। লিচু বাগান ব্যবসায়ী ফজির আলী জানান, ভাঁটির প্রভাবে গাছে আসা লিচুও ঝরে যাচ্ছে। আম, কাঁঠালেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এখন আমরা চাই আমাদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হোক। এর আগেও এই ধরনের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু ভাঁটিগুলো বন্ধ বা সরিয়ে নেয়ার কোন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। চিরিরবন্দর নশরতপুর এলাকার কৃষক সিরাজুল ইসলাম জানান, ওই ভাঁটির গ্যাসের কারণে তারও ৫০ শতক জমির ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। খানসামার ভাবকী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সফিকুল ইসলাম বলেন, কৃষকদের ক্ষতিগ্রস্ত ফসল আমি নিজে পরিদর্শন করেছি। প্রশাসনের কর্মকর্তারাও পরিদর্শন করেছেন। আমি চাই কৃষকদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ প্রদান করা হোক। এই ঘটনায় এসএইচএস ভাঁটির মালিক মান্নান সরকার ও মোজাফফর সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা এ বিষয়ে কোন বক্তব্য দিতে রাজি হননি। তবে ভাঁটির সহকারী ম্যানেজার আব্দুর রহিম জানান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ভাঁটিতে এসেছিলেন। তার সিদ্ধান্ত ও নির্দেশনা মোতাবেক ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে। টু-স্টার ভাঁটির মালিক সাইফুর রহমান জানান, আমার ভাঁটির বিষাক্ত ধোঁয়ায় যাতে কোন ক্ষতি না হয় সে ব্যবস্থা আছে। এরপরও যদি আমার ভাঁটি থেকে এটি হয়, তাহলে আমি ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি আছি। খানসামা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আহমেদ মাহবুব-উল ইসলাম জানান, ভাঁটির কারণে কৃষকদের ফসলের ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা করা হচ্ছে। ভাঁটি মালিকদের সঙ্গেও ক্ষতিপূরণের ব্যাপারে আলোচনা চলছে। একই অবস্থা দিনাজপুর সদর উপজেলার পূর্ব রামনগর এলাকার প্রায় ৫০ একর জমির। গাছে ধরা ছোট ছোট আম-লিচু ঝরে যাচ্ছে, ঝলসে যাচ্ছে ক্ষেতে আসা ভুট্টার মোচা। মরে যাচ্ছে টমেটোর গাছ। কৃষকরা দাবি করেছেন, ফসলি জমির পাশেই গড়ে ওঠা ‘আরইবি’ নামে একটি ইটভাঁটির ধোঁয়ার কারণেই ফসলের এমন ক্ষতি হচ্ছে। আর তাই নষ্ট হয়ে যাওয়া ফসলের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দাবি করেছেন কৃষকরা। অভিযোগ পাওয়ার পর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন ৪নং শেখপুরার চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম। তিনি বলেন, ভাঁটিার ধোঁয়ার কারণেই ফসলের ক্ষতি হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গরিব কৃষকরা কষ্ট করে আবাদ করে। তাই সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে কৃষকদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার দাবি জানাই। আরইবি ভাঁটির ম্যানেজার সুনীল কুমার রায় বলেন, আমাদের ভাঁটিটি জিকজ্যাক। এই ভাঁটির ধে৭ায়া দিয়ে ফসল ক্ষতি হওয়ার কথা নয়। আম-লিচুতে অধিক মাত্রায় কীটনাশক প্রয়োগের কারণে এটি হতে পারে। এর পরও বিষয়টি পরীক্ষা করে দেখা হবে। সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ আকলিমুজ্জামান বলেন, ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ফসলের নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। ল্যাবের প্রতিবেদনে যদি ভাঁটির কারণে এমনটি হয়েছে বলে প্রমাণ হয়, তাহলে ক্ষতিপূরণ দেয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে প্রশাসনকে বিষয়টি অবহিত করা হবে। একই অবস্থা বীরগঞ্জ উপজেলার নিজপাড়া ইউনিয়নের নখাপাড়া এলাকায়। ‘এসবিএম’ নামের একটি ইটভাঁটির বিষাক্ত গ্যাসের কারণে সেখানকার প্রায় ৫০ একর জমির ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। বীরগঞ্জের নিজপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য ওবাইদুল হক জানান, কৃষিজমিতে ভাঁটির প্রভাবে ফসলি জমির ফসল নষ্ট হচ্ছে। তবে এর প্রতিকারে কৃষি কর্মকর্তারা কোন পদক্ষেপ নেননি। জেলা প্রশাসক মাহমুদুল আলম জানান, ভাঁটির কারণে যেসব এলাকায় ফসলের ক্ষতি হয়েছে, সেসব এলাকার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা কাজ করছেন। কৃষকরা যাতে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ পায় সে ব্যবস্থা করা হচ্ছে। . পঞ্চগড় স্টাফ রিপোর্টার পঞ্চগড় থেকে জানান, বোদার সাকোয়ায় একটি অটো ইটভাঁটির ধোঁয়ার সঙ্গে নির্গত বিষাক্ত গ্যাসে ঝলসে গেছে বোরো ধান ক্ষেত। মরে যাচ্ছে গাছপালা। বিষাক্ত গ্যাসে অসুস্থ হয়ে নানা রোগে ভুগছেন স্থানীয়রা। বোরো ক্ষেত ঝলসে যাওয়া কৃষকদের ক্ষতিপূরণের বদলে দেয়া হচ্ছে নানান হুমকি। নিরুপায় কৃষকরা প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করে লিখিত অভিযোগ করেছেন। স্থানীয়দের অভিযোগ, জনবসতি ও ফসলি জমিতে ইটভাঁটি স্থাপনে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও সকলকে ম্যানেজ করেই গড়ে ২০১৮ সালে সাকোয়ার কামাতপাড়ায় এএন্ডএ অটো ব্রিকস ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড নামে এই অটো ইটভাঁটি স্থাপন করা হয়। ভাঁটির মালিক পঞ্চগড়ের এইচ এম জাহাঙ্গীর আলম রানা। বিগত একবছর সরকারী কোন অনুমোদন ছাড়াই ইট উৎপাদন করে এলেও এর আনুষ্ঠানিক উদ্বাধন করেন এবছরের ১৪ এপ্রিল। ইটভাঁটি মালিক, জমি গ্রহণের সময় স্থানীয়দের জানিয়েছিল, পরিবেশের ক্ষতি হয় এমন কিছু তারা করবেন না। কিন্তু বর্তমানে এই অটো ইটভাঁটিতে স্থানীয়রা বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। পরিবেশবান্ধব বলা হলেও গোপনে গাছপালা কেটে পোড়ানোরও বিস্তর অভিযোগ উঠেছে। প্রতিদিন ভাঁটি থেকে নির্গত ধোঁয়ার সঙ্গে বিষাক্ত গ্যাস চারপাশে পরিবেশসহ ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করছে বলেও স্থানীদের অভিযোগে জানা গেছে। অভিযোগ মতে, একরের পর একর বোরো ধান ঝলসে গেছে। ধানের বের হওয়া শীষ কালো হয়ে গেছে। সেচ দিয়ে কষ্ট করে বোরো ধান করে ভাঁটির ধোঁয়ায় চোখের সামনে তা নষ্ট হতে দেখে মাথায় হাত পড়েছে কৃষকদের। এ পর্যন্ত ওই ভাঁটির চারপাশের ১৫/২০ একর জমির বোরো ধানের শীষ বের হতে না হতেই তা নষ্ট হয়ে গেছে। ইটভাঁটির চারপাশে গাছপালা এমনকি ঘাসও জ¦লে গেছে। ভাঁটির বিষাক্ত গ্যাসে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন স্থানীয়রা। বেশিরভাগ সময় রাতে গ্যাস ছেড়ে দেয়ার পরই শিশুসহ অনেকেরই বমি হয়। এছাড়া কাশি ও শ^াসকষ্টসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন স্থানীয়রা। ভাঁটির তাপে আশপাশে বসবাসরত মানুষজন প্রচ- গরমে ঘুমাতে পারেন না। কামাতপাড়া এলাকার কৃষক হাসিবুল ইসলাম বলেন, আমার ২ বিঘা জমির ধান ইট-ভাঁটির বিষাক্ত গ্যাসে পুড়ে গেছে। শীষগুলো বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঝলসে যায়। কত কষ্ট করে ধারদেনা করে, বর্গা নিয়ে এই বোরো ধান করেছি। এই ধান দিয়েই আমার পরিবারের কয়েক মাসের খাবার জোগান হয়। এখন আমি খাবার ধান কোথায় পাব। একই এলাকার আলম হোসেন জানান, ভাটির মালিক কৌশল করে রাতে বিষাক্ত গ্যাস ছেড়ে দেয়। যখনি গ্যাস ছাড়ে আমরা থাকতে পারি না। গরমে রাতে ঘুমানো যায় না। আমাদের কাশি ও শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগ হচ্ছে। এ বিষয়ে প্রতিবাদ করতে গেলেও তারা হুমকি দেয়। এলাকার শাহজামাল জানান, আমার ৯ বিঘা জমির ধান নষ্ট হয়ে গেছে। এই ভাঁটির ধোঁয়াও বিষাক্ত। তিনি বলেন, চারপাশের গাছপালা এমনকি ঘাসও মরে যাচ্ছে। আনিছুর রহমান নামে ওই এলাকার আরেক ব্যক্তি বলেন, এই অটো ভাঁটিতে মানুষ ও ফসলের ক্ষতি হচ্ছে না ঘরবাড়িরও ক্ষতি হচ্ছে। বাড়ির টিন মরিচা ধরে কয়েকদিন পর তা ফুটো হয়ে যাচ্ছে। পরিবেশবান্ধব কারখানা করবে এমন আশ্বাস দিয়ে মালিক জমি নিয়েছিল। এখন আমাদের সঙ্গে বেইমানি করে পরিবেশের ক্ষতি করে যাচ্ছে। জমিলা খাতুন নামের এক বৃদ্ধ জানান, জমির ধানগুলোতো সব নষ্ট হয়ে গেছে। স্থানীয় কৃষক নাদেরুল ইসলাম বলেন, এই ভাঁটিকে ওরা বলে পরিবেশবান্ধব। আসলে এই ভাঁটি ক্ষতিকর। আমনের সময়েও আমাদের ধান এই ভাঁটির গ্যাসে ঝলসে যাওয়ার পর ক্ষতিপূরণ দিতে ওচয়েছিল। কিন্তু কোন ক্ষতিপূরণ পাইনি। বোরো ধান ক্ষেতেরও একই অবস্থা। অবিলম্বে মানুষ ও পরিবেশের ক্ষতিকারক এই ইটভার উৎপাদন কার্যক্রম বন্ধের দাবি জানাচ্ছি। এএন্ডএ অটো ব্রিকস ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপক আজিজুল হক শফিক বলেন, একদিন ঝড়ের রাতে আমাদের জেনারেটর বন্ধ হয়ে গেছে। তখন গ্যাস বের হয়ে যায়। ফসলের কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। তবে আরও কতটা ক্ষতি হয় সেজন্য আমরা অপেক্ষা করছি। পঞ্চগড় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক আবু হানিফ বলেন, এ বিষয়টি আমাদের কৃষি কর্মকর্তারা মাঠ পর্যায়ে গিয়ে দেখেছে। জেলা প্রশাসক অফিসে অনুষ্ঠিত মাসিক সমন্বয় সভায় বিষয়টি উত্থাপন করে প্রশাসনকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেছি।
×