ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

তামাক খাতে দুর্নীতিতে হারাচ্ছে কয়েক হাজার কোটি টাকার রাজস্ব

প্রকাশিত: ০৪:১৮, ২৩ মে ২০১৯

তামাক খাতে দুর্নীতিতে হারাচ্ছে কয়েক হাজার কোটি টাকার রাজস্ব

অনলাইন রিপোর্টার ॥ মূল্য সংযোজন কর না দিয়ে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল ক্রয়-বিক্রয়, সরকার নির্ধারিত মূল্য না মানা সহ বিভিন্ন রকম অনিয়ম ও দুর্নীতির জন্য তামাক খাত থেকে বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) গত জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আটমাসে ঢাকা অঞ্চলের নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, নারায়নগঞ্জ এবং কক্সবাজার ও রংপুর অঞ্চলের সিগারেট ও বিড়ি ফ্যাক্টরীর তথ্য সংগ্রহ করে তামাক খাতের এসব দুর্নীতি ও অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে। গত এপ্রিলে তিনটি প্রতিবেদনের মাধ্যমে এসব দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরা হয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কাস্টমস এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেটের ঢাকা (পূর্ব) অঞ্চলের ‘বিড়ি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সিগারেট/বিড়ি পেপার ক্রয়ের তথ্য যাচাই’ বিষয়ক এবং রংপুর অঞ্চলের ‘বিড়ি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের উপকরণের তথ্য যাচাই’ বিষয়ক প্রতিবেদন দুটির তথ্যানুযায়ী, ২৮টি বিড়ি ও সিগারেট ফ্যাক্টরী মূল্য সংযোজন কর না দিয়েই অবৈধভাবে নয় হাজার ৫১০ রিম সিগারেট বা বিড়ি পেপার কিনেছে। প্রতি রিমে ৬০ হাজার করে এই কাগজে ৫৭ কোটি ছয় লাখ শলাকা সিগারেট/বিড়ি তৈরি করা সম্ভব। অথচ আইন অনুযায়ী, মূল্য সংযোজন কর না দিয়ে তামাক, সিগারেট ও বিড়ি পেপার সহ বিভিন্ন উপকরণ ক্রয়-বিক্রয় দন্ডনীয় অপরাধ। এছাড়া ভ্যাট চালান ছাড়া অনেক ফ্যাক্টরী সিগারেটের লেবেল, ব্র্যান্ড ও ফিল্টার পেপার, পলিথিন টিস্যু সহ বিভিন্ন উপকরণ কেনার ক্ষেত্রেও মূল্য সংযোজন কর ফাঁকি দিয়েছে। এনবিআর-এর তথ্যানুযায়ী, প্রতি রিম লেবেল পেপারে তিন লাখ, বান্ডেল পেপারে দেড় হাজার এবং ফিল্টার পেপারে তিন লাখ ৩৩ হাজার ৫০০ শলাকা সিগারেট তৈরিতে ব্যবহার করা সম্ভব। এখান থেকেও বিশাল অংকের রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। সিগারেট/বিড়ির পেপার বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে- সৈকত পেপার মিল, মেসার্স সোহান এন্টারপ্রাইজ, করিম টোব্যাকো, জামান ট্রেডার্স, কর্ণফুলী কাটিং পেপার, মায়া প্রিন্টিং প্রেস, এবি ট্রেডিং কর্পোরেশন/ খবির এন্ড সন্স, আলী পেপার ইত্যাদি। এদিকে কক্সবাজারের ভ্যাট কমিশনারেটের ‘দেশীয় উৎপাদিত সিগারেটের স্থানীয় মজুদ ও বাজার মূল্য যাচাই’ বিষয়ক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, কক্সবাজার, কেরানীহাট, পদুয়া, লোহাগাড়া, চকরিয়া এলাকায় তিনটি প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সিগারেট সরকার নির্ধারিত মূল্য ৩৫ টাকার পরিবর্তে ১৪ থেকে ১৭ টাকা কমে খুচরা মূল্যে বিক্রয় করছে। এসব ব্র্যান্ডের মধ্যে রয়েছে- এস,এম ট্যোবাকো লিমিটেডের সেনর গোল্ড ওয়ান/ সেনর গোল্ড স্পেশাল, স¤্রাট ব্ল্যাক, তারা ইন্টারন্যাশনাল ট্যোবাকোর স্যানমার/ হিরো, হেরিটেজ ট্যোবাকো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের সিটি ব্ল্যাক, মার্বেল ও ইন্টারন্যাশনাল ট্যোবাকো ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের সাহারা। যেখানে ৩৫ টাকার এক প্যাকেট সিগারেটে সরকারকে ৭১ শতাংশ ট্যাক্স বাবদ ২৫ টাকা দিতে হয়, সেখানে ২০/২২ টাকায় সিগারেট বিক্রিই প্রমাণ করে এগুলো রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে তৈরি করা। বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত এসব কমদামী সিগারেট থেকে বছরে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। রাজস্ব ফাঁকি দিতে ক্রমান্বয়ে বড় হচ্ছে অবৈধ সিগারেটের এই বাজার। এ পরিস্থিতিতে তামাক খাত থেকে আইনানুগ রাজস্ব আহরণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বোর্ডের ভ্যাট বিভাগ গত ১৮ এপ্রিল সিগারেট ও বিড়ি পেপার ক্রয়-বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য তিনটি শর্ত আরোপ করে একটি গেজেট প্রকাশ করেছে। এসব শর্তের মধ্যে রয়েছে- মূল্য সংযোজন কর বিভাগ থেকে ইস্যু করা প্রত্যয়নপত্র দেখিয়ে ক্রয়কারী ও উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান সিগারেট/বিড়ি পেপার কিনতে পারবে, বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান মূল্য সংযোজন কর বিভাগীয় দপ্তরকে ক্রেতার নাম, মূসক চালান নম্বর, তারিখ, বিক্রি করা পণ্যের নাম এবং পরিমাণ উল্লেখ করে ইমেইল ও ডাকযোগে জানাতে হবে এবং মূল্য সংযোজন কর আহরণ নিশ্চিত করার জন্য কমিশনার তত্ত্বাবধান করবেন। এসব শর্তের কোনোরকম ব্যত্যয় হলে সংশ্লিষ্ট কমিশনার অনতিবিলম্বে আইনানুগ ব্যবস্থা নিবেন। এছাড়া বোর্ডের কর্মকর্তারা জানান, কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে ভ্যাট চালান ছাড়া বিড়ি, সিগারেটের মতো কোনো তামাক পন্যই সরবরাহ করা যাবে না। বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০৪০ সালের মধ্যে দেশকে তামাকমুক্ত করার লক্ষ্যে ও রাজস্ব আয় বাড়াতে সরকার সিগারেটের ওপর উচ্চহারে কর আরোপ করেছে ও দাম বাড়িয়েছে। কিন্তু কিছু অসাধু ব্যবসায়ী তামাক খাতের বিভিন্ন পর্যায়ে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে সরকারের লক্ষ্যকে একদিকে ব্যর্থতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে অন্যদিকে বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে দেশ। এই বিশাল ফাঁকি রোধে ও সরকারের লক্ষ্য অর্জনে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে একটি/দুটি এলাকায় নয়, দেশজুড়ে সব অবৈধ ও নকল সিগারেট ও বিড়ি ফ্যাক্টরি সহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য যাচাই-বাছাই করে অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। এনবিআরের প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, ভ্যাট বা মূসক চালানপত্র ছাড়াই অবৈধভাবে কাগজ কেনা ফ্যাক্টরিগুলোর মধ্যে রয়েছে- ঢাকা অঞ্চলের মেসার্স খালেক বিড়ি ফ্যাক্টরি, মেসার্স তাহরে বিড়ি ফ্যাক্টরি, মেসার্স গোলাপ বিড়ি ফ্যাক্টরি, ঝরনা বিড়ি ফ্যাক্টরি, নতুন বিড়ি, কৃষক বিড়ি, আজাদ বিড়ি ফ্যাক্টরি, শাকিল বিড়ি ফ্যাক্টরি, আসাদ বিড়ি ফ্যাক্টরি, মেসার্স যমুনা বিড়ি ফ্যাক্টরি, আনার বিড়ি ফ্যাক্টরি, স্বাধীন বিড়ি ফ্যাক্টরি, আমিন বিড়ি ফ্যাক্টরি, শরীফ বিড়ি ফ্যাক্টরি, শ্রমিক বিড়ি ফ্যাক্টরি, ১ নং পঁচা বিড়ি ফ্যাক্টরি, শাহীন বিড়ি ফ্যাক্টরি, লাকী বিড়ি ফ্যাক্টরি, মালা বিড়ি ফ্যাক্টরি, কপিকা বিড়ি ফ্যাক্টরি, সিরাজ বিড়ি ফ্যাক্টরি, আক্তার বিড়ি ফ্যাক্টরি এবং রংপুরের মেসার্স স্মৃতি বিড়ি ফ্যাক্টরি, মেসার্স হরিণ বিড়ি ফ্যাক্টরি, মেসার্স সোনার চাঁদ বিড়ি ফ্যাক্টরি, মেসার্স সহিদ বিড়ি ফ্যাক্টরি, মেসার্স জলিল বিড়ি ফ্যাক্টরি এবং মেসার্স সবুজ ও টাইগার বিড়ি ফ্যাক্টরি।
×