ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

গণহত্যা জাদুঘর এবং ...

প্রকাশিত: ০৮:৪৩, ২৪ মে ২০১৯

 গণহত্যা জাদুঘর এবং ...

সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের তত্ত্বাবধানে দেশের প্রথম গণহত্যা জাদুঘর প্রতিষ্ঠার প্রকল্প নিয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। খুলনার সাউথ সেন্ট্রাল রোডে পুরনো গণহত্যা জাদুঘর ভেঙ্গে নির্মিত হচ্ছে সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা সংবলিত অত্যাধুনিক এই জাদুঘর। মুুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা ও নির্যাতনের ইতিহাসকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন ২০১৪ সালে দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম গণহত্যা জাদুঘর গড়ে তুলেন খুলনায়। শুরু থেকেই আমি এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম। খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করেছি কি পরিমাণ একাগ্রতায় অধ্যাপক মামুন তিলে তিলে এই জাদুঘরটি গড়ে তুলেছেন। খুলনার ময়লাপোতায় একটি ভাড়া বাড়িতে অধ্যাপক মামুন গণহত্যা-নির্যাতনের মাত্র কয়েকটি ছবি দিয়ে শুরু করেছিলেন এর যাত্রা। এরপর শুরু হয় সংগ্রাম। একদিকে জাদুঘরের বিভিন্ন সরঞ্জাম সংগ্রহ, গণহত্যার দলিল-দস্তাবেজ স্মারক সংগ্রহ, অন্যদিকে জাদুঘরটিকে একটি স্থায়ী রূপ দেয়ার প্রচেষ্টা। অনেক প্রতিকূলতা পেরিয়ে অধ্যাপক মামুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে খুলনা শহরে জাদুঘর প্রতিষ্ঠার জন্য একটি পরিত্যক্ত বাড়ি চেয়ে আবেদন করলেন। শুরু হলো নানা ধরনের প্রশাসনিক জটিলতা, খুলনার তৎকালীন বিভাগীয় কমিশনার সেই আবেদন আটকে রাখলেন অনেকদিন। পরবর্তী সময়ে তৎকালীন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ও গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশারফ হোসেনের হস্তক্ষেপে ফাইল এলো মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দফতরে। এক সপ্তাহের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণহত্যা জাদুঘরকে সাউথ সেন্ট্রাল রোডে একটি বাড়িসহ জমি প্রদান করলেন। নতুন উদ্যমে শুরু হলো গণহত্যা জাদুঘরের অগ্রযাত্রা। অধ্যাপক মামুন সুষ্ঠুভাবে জাদুঘর পরিচালনার জন্য একটি ট্রাস্টি বোর্ড গঠন করলেন। গণহত্যা জাদুঘর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরুর পর নতুন নতুন স্মারক ও সামগ্রী সংযোজিত হতে লাগল জাদুঘরে। খুলনার খালিশপুরের ভৈরব নদীর তীরে অবস্থিত প্লাটিনাম জুবিলী জুট মিলটি ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর ভয়াবহ নির্মমতার এক নাম। এই জুট মিলের জ্বলন্ত বয়লারে একাত্তরে মানুষ পুড়িয়ে মারা হতো। বিভিন্ন সময়ে এখানে মিলের প্রচুর শ্রমিককে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল। একাত্তরের গণহত্যা-আর নির্যাতনের সাক্ষী সেই বয়লারটির অংশবিশেষ সংরক্ষণ করা হয়েছে গণহত্যা জাদুঘরে। গণহত্যা-নির্যাতনে ব্যবহৃত নানা স্মারকে একাত্তরের সেই দুর্বিষহ দিনগুলোকে, নির্মমতাকে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে এই জাদুঘরে। জাদুঘরের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সংগ্রহ প্রদর্শিত হচ্ছে ‘শহীদ বুদ্ধিজীবী সংগ্রহশালায়’। শহীদ সম্পাদক সেলিনা পারভীন যে কলম দিয়ে ১৯৭১ সালে যুদ্ধ করেছেন সেই কলম এবং তার পরনের শাড়ি সংরক্ষণ ও প্রদর্শিত হচ্ছে গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘরে। চোখের চিকিৎসক শহীদ বুদ্ধিজীবী আলীম চৌধুরীর চিকিৎসা সরঞ্জাম ল্যাম্প, তুলার প্যাড, ফরসেপ, ব্যান্ডেজ, ঝাঝরি, কটনবাড, কেঁচি, স্ট্যাম্প, সিরিঞ্জ, ডায়রি, কলম ও ভিজিটিং কার্ড প্রদর্শিত হচ্ছে জাদুঘরে। এ কক্ষে রয়েছে শহীদুল্লাহ কায়সারের ব্যবহৃত ডায়েরি, শহীদ বুদ্ধিজীবী ড. মুনীর চৌধুরী পাঞ্জাবি, শহীদ সাংবাদিক সিরাজুদ্দিন হোসেনের পাঞ্জাবি, বিবিসির সংবাদদাতা শহীদ নাজিমুদ্দিনের ব্যবহৃত কোটসহ শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নানা স্মারক। “জোহরা পারলে সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর সাথে মিলে যেয়ো। ঐ মতো ব্যবস্থা (দুই)” প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সেই বিখ্যাত চিঠি। মুক্তিযুদ্ধে যাওয়ার প্রাক্কালে স্ত্রীর জন্য এই চিরকুটটি পাঠান তিনি, যেটি ওই সময়ের জনপ্রিয় সিগারেট কিং-স্ট্রোক (বক মার্কা) সিগারেটের প্যাকেটের উল্টো দিকে লেখা। অনেক কাঠখড় পেরিয়ে সেটিও সংগ্রহ করা হয়েছে জাদুঘরে। সংগ্রহ করা হয়েছে নিয়াজির গণহত্যার ব্লুপ্রিন্ট। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশনামা, বিভিন্ন জেলার শান্তি কমিটির মিটিং-এর মিনিটস, শান্তিসেনার হলফনামা, জেনারেল নিয়াজী কর্তৃক বাঙালীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের এক অমূল্য দলিল, রংপুরের কুখ্যাত পাকিস্তানী যুদ্ধাপরাধী জেনারেল খটকের দুষ্কর্মের দলিল। এছাড়া রয়েছে বাগেরহাট জেলার বিখ্যাত রাজাকার রজব আলী ফকিরের হাতে লেখা চিঠি যেখানে স্থানীয়দের শান্তি কমিটি বা রাজাকার বাহিনীতে যোগ দেয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। রয়েছে একাত্তরের গণহত্যার স্মৃতিময় গুলির খোসা, শহীদের ব্যবহার্য জিনিসপত্র, ট্রানজিস্টরসহ নানা স্মারক। কয়েকশ’ দুর্লভ গণহত্যার আলোকচিত্রে প্রত্যেকটি গ্যালারিতে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে গণহত্যা-নির্যাতন। রয়েছে গণহত্যার প্রায় পঞ্চাশটি শিল্পকর্ম। বিভিন্ন মোটিফে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে একাত্তরের টর্চার সেল, কারাগার, নির্যাতিতা নারীর অবয়ব। অমিয় তরফদারের একটি বিখ্যাত ছবি ‘রিক্সায় পড়ে থাকা মৃত মানুষের লাশ’। বিশে^র কাছে বাংলাদেশের গণহত্যা-নির্যাতনের করুণ ইতিহাসকে প্রতিনিধিত্ব করে এই ছবি। বলা চলে বাংলাদেশের গণহত্যার প্রতীক এই ছবি। তারই ছায়া অবলম্বনে বিখ্যাত শিল্পী/ভাস্কর হামিদুজ্জামান খান নির্মাণ করেছেন ‘গণহত্যা ১৯৭১’ শিরোনামে একটি ভাস্কর্য। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যায় শত শত মা তার সন্তানকে হারিয়েছেন। সে সব মাকে স্মরণ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের অধ্যাপক শিল্পী রোকেয়া সুলতানা ‘জননী ও শহীদ সন্তান’ শিরোনামে মিশ্র ধাতুর তৈরি একটি ভাস্কর্যটি নির্মাণ করেছেন। জাদুঘরের মূল ভবনের সামনে ভাস্কর্য দুটি স্থাপন করা হয়েছে। গণহত্যার স্মৃতি সংরক্ষণে এই জাদুঘর নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে প্রশংসনীয় উদ্যোগ গণহত্যার স্মৃতি সংরক্ষণ ও নতুন প্রজন্মের সামনে গণহত্যার ইতিহাস তুলে ধরতে স্মৃতিফলক নির্মাণ। এর আওতায় খুলনা, রাজশাহী ও পঞ্চগড়ে নির্মিত হয়েছে স্মৃতিফলক। গণহত্যা জাদুঘরের বহুবিধ কার্যক্রমের একটি গণহত্যা ‘নির্ঘণ্ট সিরিজ’ বা ‘জেনোসাইড ইনডেক্স’। দেশের আনাচে-কানাচে রয়েছে অসংখ্য বধ্যভূমি ও গণকবর। নির্যাতনের শিকার বহু নারী-পুরুষ এখনও রোমহর্ষক স্মৃতি রোমন্থন করেন। সেসব গণহত্যার বৃত্তান্ত, বধ্যভূমি ও গণকবরের কথা, এমন কী নির্যাতনের কথা বিজয়ের গৌরব-ভাষ্যে উপেক্ষিত থেকে গেছে। উপেক্ষিত সেই ইতিহাস তুলে ধরতে অধ্যাপক মামুন উদ্যোগ নিলেন গণহত্যা নির্ঘণ্ট প্রকাশের। ইতোমধ্যে এই সিরিজে ৮০টি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। গণহত্যার সংখ্যাতাত্ত্বিক বিতর্ক বহুদিনের। এই বিতর্কের অবসান ঘটানো ও গণহত্যায় শহীদের সংখ্যা, বধ্যভূমি, গণকবর, গণহত্যা ও নির্যাতন কেন্দ্র খুঁজে বের করতে কেন্দ্র সারা বাংলাদেশে জেলাওয়ারি জরিপ পরিচালনা করছে। গণহত্যা জাদুঘরের উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধ-গণহত্যা নির্যাতন বিষয়ে পিজিটি কোর্স চালু করা হয়েছে। ইতোমধ্যে খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল ও দিনাজপুরে চারটি প্রশিক্ষণে প্রায় ৩০০ প্রশিক্ষণার্থী অংশ নিয়েছেন। এছাড়া নির্মাণ করা হয়েছে বেশ কয়েকটি ডকুমেন্টারি। জাদুঘরে বিপুল তথ্য নিয়ে গড়ে উঠেছে ডিজিটাল আর্কাইভ। সংগ্রহ করা হচ্ছে একাত্তরের গণহত্যার দেশী-বিদেশী দলিল, পত্র-পত্রিকা। দুষ্প্রাপ্য প্রায় ৬০০০ গণহত্যার ছবি সংগ্রহ আছে আর্কাইভে। গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও শক্তি তৃণমূল পর্যায়ে ছড়িয়ে দিতে কাজ করছে জাদুঘর টিম। স্কুলগুলোতে নানা ধরনের ইন্টারেকটিভ প্রোগ্রাম চালু করা হয়েছে। আমাদের নানামুখী উদ্যোগে বদলে যাচ্ছে গণহত্যা-নির্যাতনের প্রতিষ্ঠিত ইতিহাস, বদলে যাচ্ছে খুলনার সাংস্কৃতিক পরিম-ল। গত এক বছরে প্রায় ৫০০০ স্কুল শিক্ষার্থী জাদুঘরটি পরিদর্শন করেছেন, প্রত্যক্ষ করেছেন গণহত্যা আর বর্বরতার ইতিহাস। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের নেতৃত্বে গণহত্যা জাদুঘর পাল্টে দিচ্ছে বাংলাদেশের গণহত্যা-মুক্তিযুদ্ধের প্রচলিত ধারণা। প্রকাশিত হচ্ছে নতুন নতুন গবেষণা। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সারাদেশে অধ্যাপক মামুন প্রায় তিনশ’ নতুন গবেষক তৈরি করেছেন। যারা স্থানীয় পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে কাজ করছে। ফলে সারাদেশ থেকে আমরা তথ্য পাচ্ছি, উঠে আসছে নিত্যনতুন ন্যারেটিভ। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন অনেক জাদুঘর প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। গড়ে তুলেছিলেন ঢাকা নগর জাদুঘর, জাতীয় বিশ^বিদ্যালয়ের মুক্তিযুদ্ধ ইনস্টিটিউট। বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, টাকা জাদুঘরের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় গড়ে তুললেন গণহত্যা জাদুঘর। যার মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ, নতুন গণহত্যার প্রমাণ খুঁজে বের করে, সারাদেশকে জরিপের আওতায় আনা, নতুন গবেষক সৃষ্টি, আন্তর্জাতিক সেমিনারের মাধ্যমে বাংলাদেশের গণহত্যা সম্পর্কে আগ্রহ সৃষ্টি করার মতো জাতীয় দায়িত্ব পালন করছেন। সবচেয়ে বড় কথা অধ্যাপক মামুন মুক্তিযুদ্ধ গবেষণায় পদ্ধতিগত পরিবর্তনের সূচনা করছেন এবং একদল নতুন মুক্তিযুদ্ধ গবেষক সৃষ্টি করছেন যারা এ চেতনা শুধু ধারণ নয় বিকশিত করবেন। এ কাজটি আগে কখনও হয়নি। অধ্যাপক মামুন জাদুঘরটি শুরু করেছেন। এটি কিন্তু এটি বিকশিত হতে সময় লাগবে। এর জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত প্রচেষ্টার আর এ দায়িত্ব একা মুনতাসীর মামুনের না, দেশের ও দেশের বাইরের মুক্তিযুদ্ধের সকল সুহৃদের। তাই সবার শর্তহীন সহযোগিতায় জাদুঘরের কার্যক্রম আরও বিস্তৃত হবে এবং একে প্রাতিষ্ঠানিক পূর্ণরূপ দেয়া সম্ভব হবে। আজ ২৪ মে গণহত্যা জাদুঘরের স্বপ্নদ্রষ্টা অধ্যাপক মুনতাসীর মামুনের ৬৮তম জন্মদিন। শুভ জন্মদিন স্যার। লেখক : ট্রাস্টি, গণহত্যা জাদুঘর
×