ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

এ্যাপ অচল দ্বিতীয় দিনেও ॥ অনেকে অবশ্য টিকেট পেয়ে খুশি মনে বাসায় ফিরেছেন

কমলাপুরে কাউন্টারে রাতজাগা মানুষের ভোগান্তি চরমে

প্রকাশিত: ১০:১৩, ২৪ মে ২০১৯

 কমলাপুরে কাউন্টারে রাতজাগা  মানুষের ভোগান্তি চরমে

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রেলওয়ের এ্যাপ থেকে এক ঘণ্টায় ২০ হাজার মানুষ সেবা নিতে পারেন। বুধবার থেকে ঈদের অগ্রিম টিকেট বিক্রি শুরু হয়েছে। বিক্রির প্রথম ঘণ্টায় এক দেড় লাখের বেশি মানুষ এ্যাপের মাধ্যমে টিকেট কাটার চেষ্টা করেছেন। এতে যা ঘটার তাই হয়েছে, এ্যাপ আর কাজ করে না। মোবাইলে মোবাইলে ঘুরছে এ্যাপ। কিন্তু পেজ ওপেন হওয়ার খবর দিতে পারেননি কোন টিকেট প্রত্যাশীই। আগাম টিকেট বিক্রির দ্বিতীয় দিন বৃহস্পতিবারও একই ধরনের অভিযোগ ছিল টিকেট প্রত্যাশীদের। এ দিনেও এ্যাপ ব্যবহার করে টিকেট সংগ্রহের নজির মেলেনি। তাই কষ্ট করে অনেককেই দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে টিকেট সংগ্রহ করতে হয়েছে। যদিও সংশ্লিষ্টরা এ্যাপের বেশিরভাগ টিকেট বিক্রির দাবি করছেন। এবারের ঈদে প্রথমবারের মতো ৫০ ভাগ টিকেট দেয়া হচ্ছে অনলাইনে। এ তো গেল ৫০ ভাগ এ্যাপ ভোগান্তির গল্প। বাকি ৫০ ভাগ টিকেট বিক্রি চলছে কমলাপুরসহ ঢাকার চার স্থান থেকে। সকাল নয়টায় ১ জুনের টিকেট বিক্রি শুরু হলেও ২৪ ঘণ্টা আগে লাইনে দাঁড়ান অনেকে। গল্প আড্ডায় কাটে দীর্ঘ সময়। তবে লাইনে সিন্ডিকেটের টিকেট কাটা, জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর দিয়ে টিকেট বিক্রি করায় কাউন্টারে দীর্ঘসূত্রতা, এসি কেবিন, চেয়ার না পাওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে দ্বিতীয় দিনেও। আছে উল্টোচিত্রও। দীর্ঘ আট ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে রীতিমতো লড়াই করে টিকেট পেয়ে একগাল হাসি হেসেছেন রুবিনা মোস্তফা। তিনি জানান, কষ্ট সার্থক। বাড়ি যাওয়া নিশ্চিত। টিকেট পেয়ে খুশি যেন তার ধরছিল না। দ্রুত খবর জানালেন বাবা-মাকে। তার মতো অনেকেই হাসতে টিকেট হাতে বাড়ি ফিরেছেন। আবার শূন্য হাতে ফেরার ঘটনাও কম নয়। আগাম টিকেট বিক্রির দ্বিতীয় দিন বিক্রি ২৫ হাজার ৫৭১ টিকেট বিক্রি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি তেরো আন্তঃনগর ট্রেনের অগ্রিম টিকেট বিক্রি হচ্ছে কমলাপুর স্টেশনে। তাই অন্য চার স্পটের চেয়ে কমলাপুরে মানুষের ভিড়ও ছিল তুলনামূলক বেশি। বেলা একটার দিকে ভিড় একেবারেই কমে যায়। সবচেয়ে কম ভিড় ছিল বনানী রেলস্টেশনে। ওখান থেকে নেত্রকোনার মোহনগঞ্জগামী মোহনগঞ্জ এক্সপ্রেস ও হাওড় এক্সপ্রেস নামে দুটি ট্রেনের টিকেট বিক্রি হয়েছে। সকাল দশটার মধ্যে অগ্রিম টিকেট কাটা লোকজন আসেন। বাকি সময় অগ্রিম টিকেট প্রত্যাশীদের খুব কমই দেখা গেছে। এখানে নিয়মিত টিকেট নেয়ার মানুষই ছিল বেশি। কাউন্টার সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দুটি কাউন্টার থেকে তারা টিকেট দিচ্ছেন। দুপুর পর্যন্ত দুই ট্রেনের ৮০ ভাগ টিকেট বিক্রি হয়েছে। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আজ ২৪ মে বিক্রি হবে ২ জুনের অগ্রিম টিকেট। যারা ২৫ মে সংগ্রহ করবেন তারা ৩ জুন, যারা ২৬ মে সংগ্রহ করবেন তারা পাবেন ৪ জুনের টিকেট। শুধু যমুনা সেতু দিয়ে পশ্চিমাঞ্চলগামী ট্রেনের টিকেট পাওয়া যাচ্ছে কমলাপুরে। মাসুম মিয়া জানান, খুলনার টিকেট সংগ্রহ করতে গতরাত থেকেই রেলসেবা এ্যাপ বারবার ওপেনের চেষ্টা করেছি, কিন্তু কাজ করে না। অন্তত দুইশবার চেষ্টা করেও এ্যাপটি ওপেন করা সম্ভব হয়নি। তাই টিকেট কাটতে কমলাপুরে এসেছি। দিনাজপুরের টিকেট প্রত্যাশী সুমি জানান, এবারের টিকেটকাটা খুব স্বাচ্ছন্দ্যে হবে আশা করেছিলাম। কারণ এ্যাপে ৫০ ভাগ টিকেট দেয়ায় আশা ছিল কমলাপুরে লাইনে দাঁড়ানোর ঝক্কি ঝামেলা আর সামলাতে হবে না। কিন্তু বিধি বাম। তিনি বলেন, অনেক চেষ্টার পর এ্যাপ থেকে টিকেট সংগ্রহ করতে না পেরে লাইনে দাঁড়াতে হয়েছে। জানি না টিকেট পাব কি-না। সিরাজগঞ্জের নুরুল ইসলাম জানালেন, আমি সিরিয়ালের ১৯ জনের পেছনে ছিলাম। কিন্তু এসি বা কোন রকম টিকেট পাইনি। শেষ পর্যন্ত শোভন নিতে হয়েছে। রাজশাহীগামী সিল্কসিটি এক্সপ্রেসের জন্য সেহরি খেয়ে ভোরে এসে লাইনে দাঁড়িয়ে কাক্সিক্ষত টিকেট না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন আরাফাত মিয়া। তিনি বলেন, বুধবার দিনভর চেষ্টা করেও এ্যাপে টিকেট পাইনি। তাই আজ ১ জুনের টিকেট কাটতে আসি। প্রথম থেকেই এ্যাপ বিষয়ে যাত্রীদের অভিজ্ঞতা সুখের নয়। এ্যাপসটি সঠিকভাবে কাজ করছে না জানিয়ে প্রথম থেকেই অভিযোগ জানিয়ে আসছেন তারা। ঈদ উপলক্ষে টিকেট বিক্রি কার্যক্রম পরিদর্শনে বুধবার কমলাপুর স্টেশন পরিদর্শনে এসে রেলমন্ত্রী বলেন, এ্যাপে টিকেট পেতে সাধারণ যাত্রীদের ভোগান্তির অভিযোগ আমরা শুনেছি। এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেব, পাশাপাশি এ্যাপের মাধ্যমে যেসব টিকেট বিক্রি হবে না, আমরা পরবর্তীতে তা কাউন্টারে বিক্রি করব। রেলসেবা এ্যাপের মাধ্যমে যদি টিকেট কাটতে যাত্রীরা ব্যর্থ হন তাহলে বিকল্প ব্যবস্থা নেয়ার কথা উল্লেখ করে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, রেলসেবা এ্যাপ নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান সিএনএস যদি কাক্সিক্ষত সার্ভিস না দিতে পারে, সেটা তাদের যেমন ব্যর্থতা, তেমনি ব্যর্থতা আমাদেরও। প্রয়োজনে তাদের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করা হবে। অন্যদিকে কেন মানুষ অনলাইনে টিকেট পাচ্ছে না, তা পরিদর্শনে কমলাপুরের সার্ভার রুমসহ অন্যান্য স্থান পরিদর্শন করে বুধবার দুদক টিমও। রেলভবন সূত্রে জানা গেছে, অনলাইনে ঈদের সময় একসঙ্গে প্রায় দেড় লাখ হিট পড়ে। তবে সিএনএসবিডির যে সামর্থ্য তাতে মাত্র ২০ হাজার লোড নিতে পারে, যে কারণে মানুষ এ্যাপের মাধ্যমে টিকেট পেতে কিছুটা ভোগান্তিতে পড়েছেন। যাত্রী অভিযোগ প্রসঙ্গে স্টেশন ম্যানেজার আমিনুল হক বলেন, ঈদের সময় সবাই এসি টিকেট চায়। কিন্তু আমাদের এসি সিট তো সীমিত তাই সবাইকে দেয়া সম্ভব হয় না। প্রতিটি লাইনে মানুষ সুশৃঙ্খলভাবে দাঁড়িয়ে টিকেট সংগ্রহ করছেন। এছাড়া ট্রেনের অগ্রিম টিকেট বিক্রিতে যেন অপ্রীতিকর কোন ঘটনা না ঘটে সে লক্ষ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ রেলওয়ের নিজস্ব বাহিনী তৎপর রয়েছে। প্রতি যাত্রী চারটির বেশি টিকেট সংগ্রহ করতে পারবেন না। ঈদের বিক্রিত আগাম টিকেট ফেরত নেয়া হচ্ছে না। যাত্রীরা ৫০ শতাংশ টিকেট অনলাইনে এ্যাপের মাধ্যমে কিনতে পারবেন। স্টেশন কাউন্টার থেকে কিনতে পারবেন ৫০ শতাংশ টিকেট। অনলাইনে ৫০ শতাংশ টিকেট বিক্রি না হলে অবিক্রিত টিকেট কাউন্টার থেকে দেয়া হবে। এদিকে রেলের ফিরতি টিকেট বিক্রি ২৯ মে শুরু হয়ে ২ জুন পর্যন্ত চলবে। প্রথমদিনে অনলাইনে ৭১ ভাগ টিকেট বিক্রি ॥ অনলাইনে ট্রেনের আগাম টিকেট বিক্রির দ্বিতীয় দিনে বৃহস্পতিবার প্রথম দিনের হিসাব দিয়েছে সিএনএস (কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিস্টেম) লিমিটেড। তাদের তথ্য অনুযায়ী, বুধবার টিকেট বিক্রির প্রথম দিনে অনলাইনে বিক্রি হয়েছে ৭১ শতাংশ। বৃহস্পতিবার কমলাপুর স্টেশনে এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ তথ্য জানিয়েছে সিএনএস। প্রথম দিন অনলাইনে টিকেট কিনতে না পেরে বিভিন্ন স্টেশনে গিয়ে দুর্ভোগের কথা জানিয়েছিলেন টিকেট কিনতে আসা গ্রাহকরা। ৭১ ভাগ টিকেট বিক্রি কিভাবে হলো- এর ব্যাখ্যা জানতে চাওয়া হয় সিএনএসের ব্যবস্থাপক (অপারেশন) শামীম উল হকের কাছে। ব্যাখ্যা না দিয়ে তিনি বরং নীরব থাকেন। পরে তার পক্ষ থেকে ব্যাখ্যা দেন সিএনএসের প্রজেক্ট ম্যানেজার কবিরুল আলম। বলেন, কমলাপুরে সিএনএসের ৭২ সার্ভার স্টেশন আছে, যেখানে কেবল এগুলোই দেখাশোনা করা হয়। সিএনএসের মূল কার্যালয় মিরপুরে। সেখানকার টেকনিক্যাল কর্মকর্তারাই এই হিসাবটি দিয়েছেন, তারাই এর ভাল ব্যাখ্যা দিতে পারবেন। এ ব্যাখ্যার জন্য সিএনএসের নির্বাহী পরিচালক জিয়াউল আহসানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি মুঠোফোনে জানান, প্রথম দিনে অনলাইনের জন্য বরাদ্দ ছিল ১১ হাজার টিকেট। এর মধ্যে ৭১ ভাগ অর্থাৎ ৮ হাজার ২৬৮ টিকেট বিক্রি হয়েছে। যারা টিকেট কিনতে পেরেছেন, তারা আর স্টেশনে আসেননি। যারা ব্যর্থ হয়েছেন, তারাই স্টেশনে এসে টিকেট না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন। কমলাপুর থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে যাতায়াতকারী ১৬ ট্রেনের ১৪ হাজার ৯৫ টিকেট বিক্রি হয়েছে। এর মধ্যে কাউন্টার থেকে পাঁচ হাজার ৯৪৪ এবং অনলাইন ও মোবাইল এ্যাপে আট হাজার ১৫১ টিকেট বরাদ্দ রাখা হয়। এছাড়া বিমানবন্দর স্টেশন থেকে চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীগামী সাতটি আন্তঃনগর ট্রেনের চার হাজার ৮৭৯ টিকেট বিক্রি হওয়ার কথা। এর মধ্যে দুই হাজার ৫৪৮টি অনলাইনে এবং দুই হাজার ৩৩১ টিকেট বরাদ্দ ছিল। তেজগাঁও স্টেশন থেকে জামালপুরগামী পাঁচটি ট্রেনের মোট টিকেট তিন হাজার ৪৪৪। এর মধ্যে ৬৪৪ অনলাইনে এবং ৬১৪ কাউন্টারে বিক্রির কথা। বনানী রেল স্টেশন থেকে মোহনগঞ্জ রুটের দুটি ট্রেনের টিকেট সংখ্যা এক হাজার ২৫৮। এর মধ্যে ৬৪৪ টিকেট অনলাইনে বাকি ৬১৪ টিকেট কাউন্টারে বিক্রির জন্য রাখা হয়। ফুলবাড়িয়া পুরান রেলভবন থেকে সিলেট ও কিশোরগঞ্জ রুটের সাতটি আন্তঃনগর ট্রেনের টিকেট সংখ্যা চার হাজার ৫৪৮। এর মধ্যে দুই হাজার ২৫১ টিকেট অনলাইনে এবং দুই হাজার ২৯৭ টিকেট কাউন্টারে বিক্রি হবে।
×