ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ওমর বিশ্বাস

গল্পের ভেতর দিয়ে জীবনকে জানা

প্রকাশিত: ১০:৫২, ২৪ মে ২০১৯

  গল্পের ভেতর দিয়ে জীবনকে জানা

কোনটা গল্প আর কোনটা গল্প না কিংবা গল্পের সংজ্ঞা কি এর প্রাতিষ্ঠানিক তত্ত্ব দিয়ে হয়ত কোন একাডেমিশিয়ান একপ্রস্ত দাঁড় করাবেন। কিন্তু লেখক ও পাঠক কি গল্পের সংজ্ঞা ধরে গল্প তৈরি ও গল্প পাঠ করে। নিশ্চয় না। আর যদি করেনও নিশ্চয়ই সবাই করেন না, করলেও হয়ত কখনও কখনও করেন। তাহলে যে গল্পে লেখক ও পাঠকের সেতুবন্ধন হয়, লেখক পাঠককে মনের খোড়াক দেন, পাঠক তা পাঠে তৃষ্ণা নিবারণ করে তৃপ্ত হয় তাই তো গল্প। আর এ রকম একটি গল্পগ্রন্থের নাম ‘নিঃসঙ্গ সৈকতে সোনার ময়ূরপঙ্খি নাও’। এর লেখক হলেন দীলতাজ রহমান। এটা লেখকের গল্পসমগ্র-১ বাদে নবম একক গল্পগ্রন্থ। মোট আটটি গল্প নিয়ে সাজানো হয়েছে বইটি। এর মধ্যে একটি গল্প ভিন্ন অবয়বে রচনার ফলে একটু ভিন্নতাই পেয়েছে। কেউ হয়ত ওই একটা গল্প দেখে চমকে উঠবেন? দারুণভাবে আবিষ্ট করে রাখার মতো করে উপস্থাপন করা হয়েছে গল্পগুলো। এক কথায় বলা যায় পড়ার মতো। পড়তে গেলে গল্পের ভেতর আটকে যাওয়ার মতো। পাঠকের পাঠতৃষ্ণাকে ক্রমাগত বাড়িয়ে দেয়ার মতো। এ রকম একটি বই হাতে আসলে সম্পূর্ণ শেষ না করে উঠার মতো। বইটি শুরু হয়েছে ‘ভালবাসা যারে খায়’ এর জমজ বোন সায়মা আর সায়রা নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়া তুহীন নামের এক যুবকের সঙ্গে প্রেম দিয়ে। আর বইটির ভাঁজে ভাঁজে রয়েছে কত প্রেম - এই প্রেম ভাললাগার, সাহিত্যের ভেতর সাহিত্য খোঁজার। পাঠককে আনন্দ দেয়ার। যার জন্য এক সময় মনে হবে এসব গল্প তো নিজের জীবনের গল্প, সমাজের গল্প, সমাজচিত্রের গল্প। আমরা তার কতটুকুই বা জানি। লেখকের এই জানানোর মুন্সিয়ানা সত্যি অবাক করার মতো। এরপর রয়েছে বইটির মূল আকর্ষণ ‘বিষণ্ণ সৈকতে সোনার ময়ূরপঙ্খি নাও’ নামের ওই ভিন্নধর্মী গল্পটি। এটি এতো দীর্ঘ যা একটি সম্পূর্ণ উপন্যাসের সমান। এ রকম চোখে পড়ে না। উপন্যাসও হতে পারত যদি গল্পকার সেটাকেও শুধু গ্রন্থভুক্ত করে উপন্যাস বলে চালাতেন। প্রায় পৌনে দুশো পৃষ্ঠার এই গল্পটি না পড়লে এর স্বাদ আস্বাদন করা যায় না। উত্তম পুরুষে সাজানো হয়েছে কাহিনীর পর কাহিনী। গল্পের ভিতর রয়েছে গল্প- ভাললাগার মতো বিষয় আশয়ের বহুমাত্রিকতায় সাজানো। গল্পটি আসলে গল্প না জীবনের কিছু কাহিনী বলা মুশকিল। তবে পাঠক গল্পের ভেতর দিয়ে জীবনের জানা অজানা অনেক কিছুই জানতে পারবে। এত দীর্ঘ গল্প বাংলা সাহিত্যে কয়টা আছে তা ঘেটে দেখার মতো। এর আগে গল্পকারের ‘তারান্নুম, নামের চমৎকার একটি দীর্ঘ গল্প বাংলা সাহিত্যে যুক্ত করে সাহিত্যকে ঋদ্ধ করেছেন। আর ‘বিষণ্ণ সৈকতে সোনার ময়ূরপঙ্খি নাও’ গল্পটি গল্পকারের ভিন্ন মাত্রার ভিন্ন ধরনের একটি কীর্তি। এখানে গল্প আছে, আছে ভাললাগা-ভালবাসার মতো উপাদান। গল্পে দর্শন পাওয়া যায়। ব্যক্তিগত রুচি-অভিরুচির সঙ্গে একেবারে ব্যক্তিগত বিষয়গুলো গল্প হয়ে ওঠে। এখানে সংসার জটিলতা আর সমাজের চিত্রগুলো যেন চোখে দেখা যায়। জীবন সরলসাপটা, জীবন জটিল। কখনও উদার, কখনও মারমুখো। বইটি পড়লে বোঝা যায় এসব বাস্তবতা। বইটিতে পরিবারের ছেলেমেয়ে বৌ-জামাই আর নাতি-নাতনিসহ বিশাল পরিম-লের আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে ঘিরে আছে দেশের তরুণ-প্রবীণ বহুজনের নাম-নিশানা। সে সব আবার দেশ-কাল-সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক গন্ডি পর্যন্ত বিস্তৃত। কোথাও কোথাও সম্পর্কের বৈরিতা সত্ত্বেও হৃদয়ের টানাপোড়েন উথলে ওঠে ভাষার মাধুর্যে। অকপটে জীবনের অনেক কথাই বলা হয়েছে। গল্পের ভেতর এত রিলেশন এতো কাহিনী সত্যি গল্প হয়ে ‘মিঠে রোদের মতো অন্তরের উঠোনে এসে দাঁড়ায়।’ গল্পগুলো পড়তে গেলে নীরবে জানালা গলিয়ে বাতাস আসার মতো হাসি আসে। কখনও খারাপ লাগে, বিষণ্ণতায় ছেয়ে যায়, কখনো আনন্দ লাগে। আসলে গল্প এ রকমই - লেখক সাজিয়ে গুছিয়ে ভাষার মাধুরী ঢেলে পাঠককে দেন, পাঠক হৃদয়ঙ্গম করে, তৃপ্ত হয়। বইটি লেখার প্রেরণার কথা জানতে পারি বইটির ৫২-৫৩ পৃষ্ঠায়। জানা যায় কোন সুশিক্ষিকা, সুলেখিকা, সুভাষিণী রোকেয়া পারভীনের এককোয়া কমলার কথা যা ‘না হলো হয়ত এ পুরো লেখাটি লিখবার এত জোর থাকত না।’ আর ‘জলের দিকে না গেলে প্রাণের ভেতরের তাপটা জুড়াতো কি করে’ - বইটি লেখার তাগাদা। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় মোড়ানো একটি গল্প ‘বন্ধ খামে খোলা চিঠি’। গল্পটিতে ভাললাগা, ভালবাসার প্রান্তরে দাঁড়িয়ে বহুপথ পরিক্রমায় অভিজ্ঞানের কথা শোনা যায়। মৌকে লেখা দীলাপার চিঠিটির ভেতর স্বামীর প্রশ্রয় আর শাসনের নীরবে চিত্রের বর্ণনা পাওয়া যায়। অন্যের সঙ্গে স্বামীর উপস্থিতিতে কথাবার্তা, আলাপচারিতার কথা আছে চিঠিতে। এটাও তো মানুষের জীবনের একটি অংশই, হোক না তা খুবই কণাসদৃশ। এটাই বিশাল বিস্তৃত হতে কতক্ষণ। গল্পে গৃহের কর্তব্যক্তির দৃষ্টির পাঠ প্রতিক্রিয়া ভবিষ্যতের পাথেয় হয়ে ওঠে দীলাপার, তা বোঝা যায়। ‘লেপ ছাড়া এক শীতের কাহিনী’- এ রকম ঘটনা কি অনেকের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য বলা যায়? ভুলের থেকে উদ্দীপ্ত হওয়ার প্রেরণামূলক একটি গল্প। এতে দেখা যায় নিজের হিসাবের টাকা খ্যাতির মোহে সিনিয়রদের পেছনে কিভাবে খরচ করছে একজন তরুণ লেখক। এতে আছে প্রায়শ্চিত্ত। লেপ কেনার টাকায় উপঢৌকন কেনা হয় লেখক হওয়ার বাসনায় দৃষ্টিতে পড়ার জন্য। অথচ সামনের শীত কীভাবে কাটবে? খ্যাতির মোহে এক রকম রিলেশন একজন লেখক হিসেবে মেলাতে পারে না এক নারী লিখিয়ে। ‘মা যে শুধুই মা’ গল্পটিতে মাতৃত্বের বিচ্ছেদ বেদনার কথাগুলো ভারি হয়ে ওঠে পড়তে গেলে। অপরদিকে ‘মরণের মূল্য’ গল্পে যতই রাগ করুক বৃদ্ধার কিন্তু মৃত্যুর সময় উপনীত হয়েও ছেলেদের জন্য দোয়া। যে ছেলেগুলো এই বৃদ্ধার কোন খোঁজখবরই রাখে না তারা তার কাছে পঞ্চাশ হাজার টাকা দেখে হামলে পড়ে টাকার প্রতি। বৃদ্ধার জমানো টাকায় নিজের কুলখানি করার জন্য মৌলবী ডেকে তার হাতে টাকাটা ধরিয়ে বলে দেন কাফন, কবরের খরচসহ কোথায় কি কি করতে হবে। তিনি বেঁচে থেকেই তাজা কুলখানি দেখে যেতে চান। আসলে একটি শিক্ষার মধ্যে দিয়ে তিনি তার অমানুষরূপী ছেলেদের শিক্ষা দেন। এতেও যদি শিক্ষা পায়, যারা এই বৃদ্ধা সফুরা বিবিকে এতদিন শুধু কষ্টই দিছে। মানুষের অন্তরের সৌন্দর্য আর কদর্যের যে রূপ তা বিশ্লেষণের পারঙ্গমতায় ফুটে ওঠে ‘সোনার পাথরবাটি’ গল্পে। ভাঙা-গড়ার সংসারে জোড়াতালির প্রচেষ্টায় গল্পের নায়িকা নেবুলার প্রাণওষ্টাগত। সেখানে দেখা যায় মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব। তবুও নেবুলা তার বান্ধবীকে, যে তার বয়সেও বড়, যে দৃষ্টিকটুভাবে নেবুলাকে পরকীয়ার কথা বলে, সেই সুরমা আপাকে স্বামীর সঙ্গে মনোমালিন্য দূর করে সংসার আগলে রাখার পরামর্শ দেয়। এ যেন সত্যিই সোনার পাথরবাটি যেখানে সে নিজের নিঃসঙ্গতা দূর করার চেষ্টা করেও পারে না। নিজে নিঃসঙ্গ থেকেও অন্যের জন্য নিঃসঙ্গতা দূর করার উপায় বাতলে দেয়। ‘সৃষ্টির স্বার্থে নিষ্ঠুর না হতে পারলে শিল্পী হওয়া যায় না’ - এই বোধ, এই তাড়নার স্পষ্ট ছাপ লক্ষ্য করা যায় গোটা বইটিতে। তার গল্পগুলো পড়ে মনে হয় মন আর মস্তিষ্কের মিশেলে গড়া রসায়ন। মন দিয়ে ভাবলে মস্তিষ্ক সংকেত দেয়, আর মস্তিস্কের মধ্যে দিয়ে গেলে আবেগ নাড়া দেয়। আত্মস্মৃতি, আত্মউপলব্ধি, আত্মময়তা থেকে শুরু করে বহুদূর পর্যন্ত যাওয়া যায় তার গল্প পাঠে। তার গল্পে বৈচিত্র্য আছে। পাঠে আছে আনন্দ। সেসব দিয়ে গাঁথা সুন্দর একটি বই ‘নিঃসঙ্গ সৈকতে সোনার ময়ূরপঙ্খি নাও।’ এখানে জীবন যুদ্ধের জীবনযাপনের নানা বিষয় উঠে এসেছে গল্পকারের হাত ধরে। এর সবটাই পাওয়া যায় ওই একটি গল্পেই। কখনও স্মৃতি কথা কখনও জীবন কথার আদলে সাজানো বইটি ভাষায় প্রাঞ্জল। শব্দের ভারিক্কি নেই। গল্পগুলো পড়লে মনে হয় চোখের সামনে ঘটনাগুলো ঘটছে। চিত্রগুলো দৃশ্যমান। দীলতাজ রহমানের হাত দিয়ে গল্পগুলো গল্প হয়ে ওঠে। তাই আশা করা যায় গল্পগুলো যে কোন পাঠকের ভাললাগবে। ভাললাগলেই তো কথাশিল্পীর শিল্পসৃষ্টির সফলতা। আসলে ভাললাগার মতো একটি বই ‘নিঃসঙ্গ সৈকতে সোনার ময়ূরপঙ্খি নাও।’ এতে এত গল্প, এক গল্পের ভেতর- সত্যি অবাক করার মতো।
×