ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

প্রিয় পঞ্চাশ গল্প

প্রকাশিত: ১১:৪৩, ২৪ মে ২০১৯

 প্রিয় পঞ্চাশ গল্প

মোস্তফা কামালের ‘প্রিয় পঞ্চাশ গল্প’ শিরোনামে পঞ্চাশটি গল্পের সংকলনটিতে স্থান পাওয়া গল্পগুলোর বিষয়ভূমি হচ্ছে নিত্যদিনের জীবন। এখানে ইতিহাস থেকে শুরু করে সমকালীন বিবিধ বিষয় উঠে এসেছে। ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্কের টানাপোড়েন কিংবা সামজিক অসঙ্গতির সরল ভাষ্যকারে পরিণত হয়েছেন লেখক। গল্পগুলোতে নাগরিক জীবনের আলেখ্য উঠে এসেছে অধিক পরিমাণে। মোস্তফা কামালের ছোটগল্প ‘আমলা কাহিনি’। গল্পের তিন চরিত্র মন্ত্রী সচিব এবং প্রকল্পের বড় কর্মকর্তা। তিনজনের চরিত্রের একটি দিক আছেÑ সবাই অবৈধপথে উপার্জনে সচেষ্ট। লেখক সমাসবাস্তবতাকে এই তিনটি চরিত্রের মাধ্যমে তুলে আনার চেষ্টা করেছেন। রাজনীতিকের সঙ্গে আমলাদের সম্পর্কের ধরন নিরূপণ করা যায় এ গল্পের মাধ্যমে। উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের পরস্পরের সঙ্গে কীভাবে অনৈতিক বিষয়গুলো খোলারূপ লাভ করে তারও একটি চেহারা এখানে চিত্রিত হয়েছে। যদিও শেষ পর্যন্ত লেখক সচিবের দফতরে দুদকের কর্মকর্তার আসার মাধ্যমে গল্পটিতে একটি দিকনির্দেশ করেছেন- অন্যায়কারীর অপরাধ বিচারের ঊর্ধ্বে নয়। ‘কাবুল উপাখ্যান’ ছোটগল্পটি মোস্তাফা কামালের গল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম। এ গল্পে বাংলাদেশ থেকে কাবুলে যাওয়া এক রিপোর্টার আরশাদের বিচিত্র অভিজ্ঞতাকে অবলম্বন করে লেখা। আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলের জীবন এখানে উঠে এসেছে। তালেবানদের দৌরাত্ম্য এ গল্পে লক্ষ্য করা যায়। আরশাদ আফগানিস্তানে যাওয়ার পরপরই ছিনতাইকারীর হাতে পড়েছিল। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভেঙে গেলে এবং শাসন দুর্বল হলে কত বিচিত্র সঙ্কট দেখা দিতে পারে তারই প্রামাণ্য অবস্থা এ গল্পের প্রাণ। আরশাদের কাবুলের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা পাঠকের কাছে ভ্রমণ সাহিত্যের রস আস্বাদনের উপকরণ হিসেবে বিবেচিত হবে। গল্পের কাহিনি আরশাদের সঙ্গে সঙ্গে ঘূর্ণায়মান। বিপদে যেমন পড়েছিল আরশাদ তেমনি বন্ধুও পেয়েছিল। ভারতের একজন স্বল্প পরিচিত বন্ধু অনহিতা তার বিপদে পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। একটি অরাজাক রাষ্ট্রে ভিনদেশি কেউ এলে তাকে যে বিড়ম্বনায় পড়তে হয় সেই বাস্তবতার ভূমিতে দাঁড়িয়ে আছেন আরশাদ। মোস্তফা কামালের ‘ফেরারি’ পরকীয়া প্রেমের পরিণতির গল্প। উজ্জ্বল সম্ভাবনা নিয়ে শুরু করা এক তরুণ চিকিৎসকের জীবনে নেমে আসে করুণ পরিণতি। সাহবাজ ডাক্তারের সমস্ত অর্জন ভূলুণ্ঠিত হয় পরকীয়ায়। স্ত্রী সবিতা এবং সন্তান নবনীতাকে হত্যা করে পরবর্তী বিয়ের পথ সহজ করতে চেয়েছিল। কিন্তু স্ত্রী সন্তানকে মেরে ফেলার পর প্রেমিকা তনুজার সঙ্গে বিয়ের পরিবর্তে বেছে নিতে হয় পলাতক জীবন। সাহবাজ ডাক্তার নিজের চেহারা ধর্মীয় আবরণে পাল্টে ফেলে। সে ঢাকার একটি একটি এলাকায় দরবেশ পরিচিতি লাভ করে। দিনের পর দিন তার ভক্তের সংখ্যা বাড়তে থাকে। লোকবিশ্বাস তৈরি হয় তাকে ঘিরে। গল্পকার দেখিয়েছেন যাদেরকে হত্যা করেছে সাহবাজ ডাক্তার তার জন্য নিভৃতে চোখের জল ঝরাচ্ছে। লেখক এ গল্পে কয়েকটি অনুষঙ্গকে এক রৈখিকতায় নিয়ে এসেছেন। পরকীয়ার পরিণতি, সাধারণ মানুষের অন্ধবিশ্বাস এবং যে স্ত্রী সন্তানকে খুন করেছে তাদের জন্য সাহবাজ ডাক্তারের করুণ আকুতি। পরিণতিতে যাবজ্জীবন কারাদ-প্রাপ্ত আসামি পুলিশ কর্তৃক ধরা পড়েন। ভক্তকূল পাথর দৃষ্টিতে সাহবাজ ডাক্তারকে ধরে নিয়ে যাওয়া দেখতে থাকে। এ দৃশ্যে গল্পটির সমাপ্তি। ‘একজন রাজনীতিকের ইতিকথা’ গল্পটির কলেবর জুড়ে ব্রিটিশ-পাকিস্তান এবং স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতির বয়ান। গল্পটির শেষাংশে গিয়ে অপ্রিয় সত্যের মুখোমুখি দাঁড়ানো মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন এবং স্ত্রী তাহমিনার কথোপকথন আলো ছড়ায়। ষাটের দশকে নীতির উপর দাঁড়িয়ে রাজনীতি করা শুরু করেছিলেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ন্যায় প্রতিষ্ঠায় ছিলেন অকুতোভয়। মিছিলে পায়ে গুলিও লেগেছিল। তবুও অনঢ় ছিলেন নীতিতে। সেই মিছিলে গুলি খাওয়ার পর এগিয়ে এসেছিলেন তাহমিনা। সেই সম্পর্ক একদিন বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়েছিল। ত্রিশ বছরের সংসার তাদের। পঞ্চম বারের মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন নিজের আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের বীভৎস রূপ আবিষ্কার করেন। স্ত্রী তাহমিনাও অকপটে তাকে ঘৃণার কথা জানান। শুধু সংসার করার স্বার্থে মুখ বুজে নীতিহীনতাকে প্রশ্রয় দিয়েছেন তিনি। গল্পকার নীতিভ্রষ্ট রাজনীতিককে আত্মবিশ্লেষণের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। গল্পের শেষে এই দুই চরিত্রের কথোপকথন গল্পটিকে উচ্চমার্গীয় গল্পে উন্নীত করেছে। গল্পের স্বাদ আস্বাদনে পরিতৃপ্তির প্রসাধন সেখানে বিন্যস্ত হয়েছে। ‘ক্যাম্পাস’ গল্পটি বর্তমানের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজনীতি নিয়ে লেখা। দলের কোন্দলে গল্পের নায়ক কমলের মৃত্যু দেখানো হয়েছে। বাস্তবতার নিরিখে গল্পের কাহিনির নির্মাণ। ছাত্র রাজনীতি করা নিলয়ের লক্ষ্য ছিল ছাত্র রাজনীতিকে একটি শুদ্ধ ধারায় ফেরাবে। কিন্তু রাজনীতিকে শুদ্ধ ধারায় ফেরানোর পরিবর্তে নিজেই রাজনীতির বলি হয়। স্বজনেরা বারংবার চেষ্টা করেও কমলকে ফেরানো সম্ভব হয়নি। বর্তমান ছাত্র রাজনীতির ঘৃণ্য নগ্ন চেহারাটাই ভেসে উঠেছে এ গল্পে। ‘রুদ্র, আমাদের রুদ্র’ গল্পটি সমকালীন জীবনের প্রতিচ্ছবি। গত কয়েক বছর আগে বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের ২৭তম বিসিএস পরীক্ষার দুবার চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হয়। প্রথমবারেরটা বাতিল করে দ্বিতীয় বার আবারও সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। রুদ্র নামের একজন পরীক্ষার্থী প্রথমবার ট্যাক্সেশন ক্যাডারে প্রথম হয়েছিল। পরীক্ষকগণ দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎকারে ধারণা করেছেন ঘুষ খাওয়ার জন্য পরীক্ষার্থী এই ক্যাডার পছন্দ করছে। সে কারণে তাকে প্রশ্ন না করে বের করে দেয়। ফলে তার চাকরি আর হয়নি। সে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিতে যোগদান করেনি বলে প্রেমিকাও চলে গেছে। শেষ পর্যন্ত হতাশা গ্রাস করে। পরিণতিতে মানসিক ভারসাম্য হারায় এবং মারা যায়। এ গল্পটিতে গুরুতবপূর্ণ বার্তা আছে। বিসিএস ব্যাধিতে আক্রান্ত সমাজ। বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হলে সমাজে যেন কোন গুরুত্ব নেই। এই বিষয়টি লেখক দেখাতে চেয়েছেন। আবার পিএসসিতেও যে কত অযৌক্তিক বিষয় ঘটে তাও দেখানো হয়েছে। ‘পার্বতীপুর জংশন’ গল্পটি বিত্তহীন মানুষের গল্প। ছিন্নমূল রুপেন এবং মালতীর প্রেম আছে, নিম্নবর্গীয় মানুষের চরম অবহেলায় বেড়ে ওঠার গল্প আছে। কিন্তু সবকিছুকে ছাপিয়ে বড় হয়ে ওঠে চলন্ত বাসে পেট্রোল বোমায় নিহত রুপেনের মা এবং ছোট বোনের মৃত্যুর কাহিনি। ২০১৪ এর শেষে এবং ২০১৫ এর শুরুতে দেশব্যাপী পেট্রোল বোমার আঘাতে জর্জরিত বাংলাদেশকে পাওয়া যায় এ গল্পে। নেপালের কাঠমা-ুতে বিমান দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে লেখা হয়েছে গল্প ‘অদিতি কাহিনি’। ‘ঠিকানা শাহাবাগ’ গল্পটি গণজাগরণ মঞ্চবিষয়ক। মোস্তাফা কামাল স্বল্প পরিসরে প্রতিটি গল্পের কলেবর সাজিয়েছেন। বিষয় নির্বাচনে গুরুত্ব পেয়েছে সমকালীনতা। বিষয় উপযোগী গল্পভাষা সৃষ্টিতে তার দক্ষতার পরিচয় মেলে। সিরিয়াস পাঠক এবং সাধারণ পাঠক সবার উপযোগী সে গল্পভাষা। ‘প্রিয় পঞ্চাশ গল্প’ মোস্তফা কামালের অনবদ্য রচনা। ৩০ মে পঞ্চাশ বছরে পা রাখছেন লেখক। তার জন্ম স্মরণে পাঠকের নিরন্তর শ্রদ্ধা, অশেষ ভালোবাসা।
×