ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

টার্গেট ৮০ বিলিয়ন ॥ বাজেটে রফতানি ও রেমিটেন্স বাড়ানোর ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব

প্রকাশিত: ০৯:৫০, ২৫ মে ২০১৯

টার্গেট ৮০ বিলিয়ন ॥ বাজেটে রফতানি ও রেমিটেন্স  বাড়ানোর ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব

এম শাহজাহান ॥ বছরে ৮০ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। বাংলাদেশী মুদ্রায় (প্রতি ইউএস ডলার ৮৫ টাকা ধরে) যা প্রায় ৬ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। এ লক্ষ্যে আগামী বাজেটে রফতানি বহুমুখীকরণ ও রেমিটেন্স আহরণে বিশেষ প্রণোদনা ঘোষণা করতে যাচ্ছে সরকার। বৈধ কিংবা ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিটেন্স পাঠালে প্রবাসীরা ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা পাবেন। এছাড়া সব পণ্য রফতানিতে নগদ সহায়তা ও প্রণোদনা দেয়া হবে। এই দুই খাতের জন্য বাজেটে বিশেষ প্রণোদনা ও নগদ সহায়তা প্রদানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে সবুজ সঙ্কেত দেয়া হয়েছে। এতে করে গার্মেন্টস পণ্যের পাশাপাশি অন্য পণ্যসামগ্রীও বিপুল পরিমাণে রফতানির সুযোগ তৈরি হবে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের বড় উৎস গার্মেন্টস ও রেমিটেন্স খাত থেকে এখন প্রতি বছরে ৬০ বিলিয়ন ডলার আয় হচ্ছে। সঠিক পরিকল্পনা ও নীতিগত সহায়তা প্রদান করা হলে রূপকল্প-২১ এর মধ্যে এই আয় আরও ২০ বিলিয়ন ডলার বাড়ানো সম্ভব বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। জানা গেছে, বঙ্গবন্ধুর জন্মশত বার্ষিকী উদযাপন, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন এবং রূপকল্প-২১ সামনে রেখে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার। নতুন বাজেট ঘোষণায় এ বিষয়ে পরিকল্পনা ও নীতিগত সহায়তার কথা জানাবেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। আগামী ১৩ জুন মহান সংসদে বাজেট উপস্থাপন করা হবে। ইতোমধ্যে খসড়া বাজেটের ওপর মতামত দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তাতে তিনি রফতানি বহুমুখীকরণ ও রেমিটেন্স বাড়ানোর উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছেন। এদিকে, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সবচেয়ে বড় খাত পণ্য ও সেবা রফতানি। এরপরই রয়েছে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স। চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছর শেষে পণ্য রফতানি খাত থেকে ৩৯ বিলিয়ন ডলার ও সেবা খাত থেকে আরও ৫ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্স থেকে আয় হবে সাড়ে ১৫ বিলিয়ন ডলার। তবে নগদ সহায়তা ও প্রণোদনা দেয়ার মতো কর্মসূচী গ্রহণ করে বৈদেশিক মুদ্রার আয় আরও বাড়ানো সম্ভব। সম্প্রতি এক হিসেবে দেখা গেছে, গার্মেন্টস খাতের পণ্য রফতানিতে নগদ সহায়তা ও বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনা থাকায় এ শিল্প খাতে এখন বিশ্বে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। এ কারণে গার্মেন্টসের মতো অন্যান্য পণ্যের রফতানি বাড়াতে এখন থেকে সব ধরনের পণ্য রফতানির উপরও নগদ সহায়তার প্রণোদনা ও বন্ডেড সুবিধা দেয়ার চিন্তা ভাবনা করছে সরকার। এছাড়া প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সের উপর কোন প্রণোদনা নেই। এ বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে অর্থ ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের মধ্যে আলোচনা চলছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রণোদনা ঘোষণা করা হলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে রেমিটেন্সের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে। শুধু তাই নয়, রেমিটেন্স ব্যাংকিং চ্যানেলে আসার সুযোগ তৈরি হতে পারে। মূল ধারার বিনিয়োগে আসবে রেমিটেন্স এবং বাড়বে কর্মসংস্থান। এসব দিক বিবেচনায় নিয়ে আগামী অর্থবছরের বাজেটে বিশেষ প্রণোদনা ও নগদ সহায়তা প্রদানের ঘোষণা দেয়ার কথা ভাবছে অর্থ মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সঙ্গে (এনবিআর) ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের বাজেট সংক্রান্ত পরামর্শক কমিটির সভায়ও এই দুই খাত আলোচনায় গুরুত্ব সহকারে উঠে আসে। ওই বৈঠকে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারী খাত বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান এবং এফবিসিসিআইয়ের বিদায়ী সভাপতি মোঃ সফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন রফতানি খাতে প্রণোদনা ও নগদ সহায়তা প্রদানের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন। অর্থমন্ত্রী বলেন, রফতানি ও রেমিটেন্স বাড়াতে সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের উদ্যোগ নেয়া হবে। পরে ওই বৈঠকেই সালমান এফ রহমান বলেন, গার্মেন্টস খাতের এই যে উত্থান তা কিন্তু প্রণোদনা, নগদ সহায়তা এবং বন্ডেড সুবিধার কারণে। উদ্যোক্তাদের সামনে ৬০ বিলিয়ন ডলারের রফতানির লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রণোদনা তো বটেই প্রয়োজনে বন্ডেড সুবিধাও দেয়া হবে। গার্মেন্টসের মতো অন্যান্য খাতও একদিন শক্ত অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হবে। তিনি বলেন, এ বছরই ব্যবসা সহজীকরণ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৬ থেকে ১২৫ এ উন্নীত হবে। এই অবস্থান আগামী বছর দুই অঙ্কের ঘরে আসবে। দেশে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরি হয়েছে, তাই বিদেশীরাও বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছে। রফতানি পণ্য বহুমুখীকরণে সব প্রতিষ্ঠানেরই পদক্ষেপ নেয়া উচিত। রফতানিকৃত সব পণ্যে নগদ সহায়তা ॥ বর্তমানে ৪৫টি পণ্যের উপর নগদ সহায়তা দেয়া হচ্ছে। তবে এখন থেকে রফতানিকৃত সব পণ্যে নগদ সহায়তা দেয়া হবে। আগামী বাজেটেই এ সংক্রান্ত ঘোষণা আসছে। তবে নগদ সহায়তার নামে কোন দুর্নীতি ও অপকৌশলের আশ্রয় নেয়া হলে প্রচলিত আইন অনুযায়ী অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিত করা হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে সহায়তা করবে কম্পন্ট্রোলার অডিটর জেনারেল-সিএজি ও দুর্নীতি দুমন কমিশন-দুদক। উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করতে মাদক ও অস্ত্র ছাড়া যেকোন পণ্য রফতানির উপর নগদ সহায়তা দেয়ার চিন্তা ভাবনা করছে সরকার। এক্ষেত্রে নতুন বাজারে কোন পণ্য রফতানি সম্ভব হলে সেক্ষেত্রেও নগদ সহায়তা দেয়া হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রফতানি বাণিজ্যকে উৎসাহিত করতে গত বছর ৩৬টি পণ্য রফতানিতে নগদ সহায়তা ও ভর্তুকি দেয়া হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানিয়েছে-বর্তমান গরু-মহিষের নাড়ি, ভুরি, শিং ও রগ রফতানির বিপরীতে ভর্তুকি দেয়া হচ্ছে ১০ শতাংশ হারে। শস্য ও শাকসবজির বীজ রফতানির বিপরীতে ভর্তুকি দেয়া হয় ২০ শতাংশ হারে। পাটকাঠি থেকে উৎপাদিত কার্বন রফতানির বিপরীতে ভর্তুকি দেয়া হয় ২০ শতাংশ। এছাড়া রফতানিমুখী দেশীয় বস্ত্র খাতে শুল্ক বন্ড ও ডিউটি ড্র ব্যাক এর পরিবর্তে বিকল্প নগদ সহায়তা দেয়া হচ্ছে ৪ শতাংশ, বস্ত্র খাতের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের অতিরিক্ত সুবিধা ৪ শতাংশ, ইউরো অঞ্চলে বস্ত্র খাতের রফতানিকারকদের জন্য বিদ্যমান ৪ শতাংশের অতিরিক্ত বিশেষ সহায়তা ২ শতাংশ, নতুন পণ্য ও বাজার সম্প্রসারণে ৩ শতাংশ সহায়তা দেয়া হয়। এছাড়া সফটওয়্যার, আইটিইএস ও হার্ডওয়্যার রফতানির বিপরীতে ১০ শতাংশ হারে নগদ সহায়াত দেয়া হচ্ছে। চলতি অর্থবছর থেকে আরও ৯টি পণ্য রফতানিতে ১০ শতাংশ হারে নগদ আর্থিক সহায়তা প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পণ্যগুলো হলো- হিমায়িত সফটসেল কাঁকড়া, ফার্মাসিউটিক্যালস পণ্য ও ওষুধের কাঁচামাল, সিরামিক দ্রব্য, গালভানাইজড সিট বা কয়েলস, ফটোভলটাইক মডুল, রেজার ও রেজার ব্রেডস, ক্লোরিন, হাইড্রোক্লোরিক এসিড, কস্টিক সোডা এবং হাইড্রোজেন পারঅক্সাইড। এ প্রসঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোঃ হাবিবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, বাজেট চূড়ান্ত করে আনা হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয়ের সিদ্ধান্ত দেবেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, এবার সব ধরনের পণ্য রফতানির উপর নগদ সহায়তা ও প্রণোদনা দেয়া এবং রেমিটেন্সের উপর প্রণোদনা দেয়ার মতো বিষয় রয়েছে। ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর দফতরে এ সংক্রান্ত ফাইলপত্র জমা দেয়া হয়েছে। আশা করছি, নতুন বাজেটে এ সংক্রান্ত ঘোষণা আসবে। রফতানি ও রেমিটেন্স বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তিনি বলেন, রূপকল্প-২১ বাস্তবায়নে রফতানি ও রেমিটেন্সের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হওয়া প্রয়োজন। এবারের বাজেটে এর প্রতিফলন থাকবে। রেমিটেন্সে প্রণোদনা ॥ রফতানির মতো রেমিটেন্সে প্রণোদনা দেয়ার ঘোষণা আসছে। ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠালে ২ শতাংশ হারে প্রণোদনা দেয়া হবে। আগামী বাজেটে রেমিটেন্সে প্রণোদনা দিতে ২ হাজর ৮০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়ার প্রস্তাব করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। প্রবাসীদের কষ্টার্জিত অর্থ দেশে আনতে সরকার এই সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে। শুধু তাই নয়, রেমিটেন্সের অর্থ যাতে অর্থনীতির মূল ধারায় বিনিয়োগ হয় সে বিষয়ে ও আন্তরিক আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার। ইতোমধ্যে রফতানির মতো রেমিটেন্সের উপর নির্ধারিত হারে প্রণোদনা দেয়ার সুপারিশ করে বাংলাদেশ ব্যাংকে একটি চিঠি দিয়েছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, বর্তমানে বিশ্বের ১৬৫ দেশে এক কোটিরও বেশি বাংলাদেশী কর্মরত রয়েছেন। বিদেশে যে পরিমাণ কর্মসংস্থান হচ্ছে, বৈধ রেমিটেন্স প্রবাহে তা পুরোপুরি প্রতিফলিত হচ্ছে না। ব্যাংকের চেয়ে অবৈধ চ্যানেলে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার কিছুটা বেশি থাকায় সামান্য লাভের আশায় অনেকে সেদিকে যাচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতে রফতানির মতো করে রেমিটেন্সে নগদ প্রণোদনা দেয়া যেতে পারে। রেমিটেন্সের উপর প্রতিষ্ঠানগুলো ৩ থেকে ৪ শতাংশ হারে চার্জ নিচ্ছে। জানা গেছে, প্রণোদনা দেয়া গেলে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই বছরে ২০ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স আসবে। বর্তমানে প্রায় সাড়ে ১৫ বিলিয়ন ডলারের রেমিটেন্স আসছে। চার্জ বেশি হওয়ার কারণে অনেক প্রবাসী এখন দেশে টাকা পাঠাতে ভরসা পাচ্ছেন না। এছাড়া কষ্টার্জিত এই অর্থ অর্থনীতির মূল ধারায় নিয়ে আসারও সঠিক কোন পরিকল্পনা নেই। ফলে রেমিটেন্সের অর্থ ব্যয় হচ্ছে দৈনন্দিন আয়-ব্যয় নির্বাহ, ভোগবিলাস ও বাড়িঘর নির্মাণে।
×