ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

আজ নজরুল জয়ন্তী

আমি যুগে যুগে আসি আসিয়াছি পুনঃ মহাবিপ্লব হেতু...

প্রকাশিত: ০৯:৫২, ২৫ মে ২০১৯

 আমি যুগে যুগে আসি আসিয়াছি পুনঃ মহাবিপ্লব হেতু...

মোরসালিন মিজান ॥ সাম্য ও মানবতার অমর কবি। কান্ডারি। প্রেমে পূর্ণ। দ্রোহের অগ্নিশিখা। তিনি আর কেউ নন, আমাদের কাজী নজরুল ইসলাম। ‘আমি যুগে যুগে আসি, আসিয়াছি পুনঃ মহাবিপ্লব হেতু...।’ পরাধীনতার যুগে এসেছিলেন মহাবিপ্লব হয়ে। আজ ১১ জ্যৈষ্ঠ শনিবার ‘ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো এই মহান পুরুষের ১২০তম জন্মবার্ষিকী। ১৩০৬ বঙ্গাব্দের এই দিনে পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। প্রতিবারের মতো এবারও বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে সারাদেশে দিবসটি উদ্যাপিত হবে। জাতীয়ভাবে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। এবারের প্রতিপাদ্য ‘নজরুল-চেতনায় বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’। এদিকে দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাণী দিয়েছেন। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম নিজের সৃষ্টির মধ্য দিয়ে প্রেমের কথা বলেছেন। সবার উর্ধে তুলে ধরেছেন মানবতা। সাম্যের কবি নজরুল সমাজের নিচু তলার মানুষকেও কাছে টেনে নিয়েছেন। মেনে নেননি নারীর প্রতি উপেক্ষা। ধার্মিক মুসলমান সমাজ ও অবহেলিত জনগণের সঙ্গে তার বিশেষ সম্পর্ক থাকলেও সর্বক্ষণ সাম্প্রদায়িকতার নিন্দা করেছেন কড়া ভাষায়। স্বার্থান্ধ মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে ছিলেন সদা সোচ্চার। সাম্রাজ্যবাদবিরোধী কবি তৎকালীন ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় অসংখ্যবার জেল খেটেছেন। জেলে বসেই তিনি লিখেছেন তার বিখ্যাত ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী।’ ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে এভাবেই দুর্দম গতিতে এগিয়ে এসেছেন তিনি। হয়ে উঠেছেন আমাদের নজরুল। বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী কাজী নজরুল ইসলাম অতি দরিদ্র পরিবারের সন্তান। লেখাপড়া শুরু করেন মক্তবে। কিন্তু বাবার মৃত্যুর পর দারিদ্র্যের কারণে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বেশি দূর এগোয়নি। মাত্র ১০ বছর বয়সে গোটা পরিবারের ভার কাঁধে নিতে হয় তাঁকে। জীবিকার প্রয়োজনে এমনকি রুটির দোকানে কাজ করেন। তরুণ বয়সে সেনাসদস্য হিসেবে যোগ দিয়েছেন যুদ্ধেও। সাংবাদিকতা পেশায় যুক্ত ছিলেন তিনি। করেছেন রাজনীতিও। সাহিত্যচর্চার শুরুটাও বালক বয়সে। লেটো দলে যোগ দিয়ে শুরু হয় তাঁর সাহিত্যচর্চা। নজরুলের কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ বাংলা সাহিত্যকে দিয়েছে বিপুল সমৃদ্ধি। বিশেষ আলোড়ন তোলেন ‘বিদ্রোহী’ কবিতা লিখে। শোষকের বিরুদ্ধে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করে তিনি বলেছিলেন, ...‘আমি ত্রাস সঞ্চারি ভুবনে সহসা সঞ্চারি ভূমিকম্প।/ ধরি বাসুকির ফণা জাপটি,/ ধরি স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা শাপটি!/ আমি দেব-শিশু, আমি চঞ্চল,/ আমি ধৃষ্ট, আমি দাঁত দিয়া ছিঁড়ি বিশ্বমায়ের অঞ্চল...’। কাছাকাছি সময়ে রচিত তাঁর আরেকটি বিখ্যাত কবিতা ‘কামাল পাশা।’ এতে ভারতীয় মুসলমানদের খিলাফত আন্দোলনের অসারতা সম্বন্ধে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমকালীন আন্তর্জাতিক ইতিহাস-চেতনার পরিচয় পাওয়া যায়। ১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর সাড়াজাগানো কবিতা সঙ্কলন ‘অগ্নিবীণা।’ কাব্যগ্রন্থটি বাংলা কাব্যের ভুবনে পালাবদল ঘটাতে সক্ষম হয়। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে এর প্রথম সংস্করণ নিঃশেষ হয়ে যায়। পরে খুব দ্রুত আরও কয়েকটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। ‘বিদ্রোহী’, ‘কামাল পাশা’ ছাড়াও এই কাব্যগ্রন্থের ‘প্রলয়োল্লাস’, ‘আগমনী’, ‘খেয়াপারের তরণী’, ‘শাত-ইল্-আরব’ কবিতাগুলো সর্বত্র তুমুল হৈ চৈ ফেলে দেয়। কাজী নজরুল ইসলাম গদ্য রচনার বেলায়ও ছিলেন স্বতন্ত্র চিন্তার। তাঁর প্রথম গদ্য ‘বাউ-ুলের আত্মকাহিনী’ ১৯১৯ সালে সওগাত পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সৈনিক জীবনে করাচী সেনানিবাসে বসে এটি রচনা করেন তিনি। এখান থেকে তাঁর সাহিত্যিক জীবনের মূল সূচনা ঘটেছিল বলে ধারণা করা হয়। সেনানিবাসেই তিনি লিখেছেন ‘হেনা’, ‘ব্যথার দান’, ‘মেহেরনেগার’ ও ‘ঘুমের ঘোরে’ প্রভৃতি গল্প। ’২২ সালে প্রকাশিত হয় নজরুলের গল্প সঙ্কলন ‘ব্যথার দান।’ একই বছর প্রকাশিত হয় প্রবন্ধ সঙ্কলন ‘যুগবাণী।’ তবে নজরুলের সৃষ্টির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশজুড়ে আছে সঙ্গীত। বৈচিত্র্যময় বাংলা গানের সবচেয়ে বড় ভান্ডার তাঁর। প্রায় সাড়ে তিন হাজার গান রচনা করেন তিনি। সুর বৈচিত্র্যে ভরপুর এসব গান বাংলা সঙ্গীতকে অনন্য উচ্চতায় আসীন করেছে। তার সৃষ্ট রাগগুলোও দারুণ বিস্ময় জাগায়। তবে জীবনের একটি বড় অংশজুড়ে ছিল লাঞ্ছনা গঞ্জনা। এরই ধারাবাহিকতায় ’৪২ সালে অগ্রজ কবি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের ‘ট্র্যাজেডি’র আশঙ্কাকে সত্য প্রমাণ করেন। এ বছরই চির বিদ্রোহী রণক্লান্ত ‘নজরুল’ বাকশক্তি ও মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে শিশুর মতো হয়ে যান। এ অবস্থায় ১৯৭২ সালে রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ভারত থেকে কাজী নজরুল ইসলামকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। নজরুলকে জাতীয় কবির মর্যাদা দেন। কবির জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে তৎকালীন পিজি হাসপাতালে। দীর্ঘ রোগভোগের পর এখানেই ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট পৃথিবীকে চির বিদায় জানান তিনি। কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়। রাষ্ট্রপতির বাণী ॥ নজরুল জয়ন্তী উপলক্ষে দেয়া বাণীতে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেছেন, কাজী নজরুল ইসলাস আমাদের অন্তহীন প্রেরণার উৎস। কবির ক্ষুরধার অগ্নিঝরা লেখনী শোষিত নির্যাতিত ও বঞ্চিতদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার করে। শিক্ষা দেয় অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে। নতুন প্রজন্ম নজরুলের কর্ম চর্চার মাধ্যমে নিজেদের সমৃদ্ধ করতে সক্ষম হবে। প্রধানমন্ত্রীর বাণী ॥ পৃথক বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলা সাহিত্যে কবি কাজী নজরুল ইসলাম এক অবিস্মরণীয় নাম। তাঁর শিকল ভাঙ্গার গানে ঝিমিয়েপড়া বাঙালী সমাজ জেগে উঠেছিল। সাম্য, মানবতা, তারুণ্য ও দ্রোহের কবি তিনি। নজরুল অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্যহীন ও শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্ন দেখেছেন তা বাস্তবায়নের জন্য বর্তমান সরকার কাজ করছে বলেও বাণীতে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী। দেশব্যাপী নজরুল জয়ন্তীর প্রস্তুতি ॥ রোজার মাস হলেও, আজ সারাদেশেই নজরুল জয়ন্তীর নানা কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়েছে। সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থিত কবির মাজারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করবেন সর্বস্তরের মানুষ। দিনভর চলবে আলোচনা স্মৃতিচারণ। ছায়ানটে আজ সকাল এগারোটায় বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হবে। অনুষ্ঠান থেকে নাচ-গান-কবিতায় প্রিয় কবিকে শ্রদ্ধা ভালবাসা জানাবে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। বাংলা একাডেমি আগামীকাল রবিবার বেলা এগারোটায় একাডেমির কবি শামসুর রাহমান সেমিনার কক্ষে নজরুল বিষয়ক একক বক্তৃতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করবে। অনুষ্ঠানে ‘নজরুলের প্রাসঙ্গিকতা’ শীর্ষক একক বক্তৃতা প্রদান করবেন অধ্যাপক সৌমিত্র শেখর। সভাপতিত্ব করবেন বাংলা একাডেমির সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। স্বাগত বক্তব্য রাখবেন একাডেমির মহাপরিচালক হাবীবুল্লাহ সিরাজী। সাংস্কৃতিক পর্বে থাকবে নজরুলের কবিতার আবৃত্তি ও নজরুলগীতি পরিবেশনা। জাতীয় পর্যায়ে নজরুলজয়ন্তী উদ্যাপনরে অংশ হিসেবে ত্রিশাল কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, চুয়াডাঙ্গা ও মানিকগঞ্জে বিভিন্ন কর্মসূচী পালন করা হবে। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ও অধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে এসব কর্মসূচী নেয়া হয়েছে। নজরুলের স্মৃতিধন্য ময়মনসিংহের ত্রিশালে থাকবে বিশেষ আয়োজন। নজরুল একাডেমি মাঠে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন শিক্ষামন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি। সভাপতিত্ব করবেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ। অন্যদের মধ্যে কবি পরিবারের সদস্য খিলখিল কাজী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন। এছাড়া সারাদেশের অসংখ্য সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠন জাতীয় কবিকে শ্রদ্ধা ভালবাসায় স্মরণ করবে। দ্রোহ প্রেম সাম্যের কবিকে অঞ্জলি জানাবে জাতি।
×