ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

চাল আমদানি ॥ চরম লোকসানের মুখে কৃষক

প্রকাশিত: ১০:০৭, ২৬ মে ২০১৯

 চাল আমদানি ॥ চরম লোকসানের মুখে কৃষক

সাজেদুর রহমান শিলু, দিনাজপুর ॥ মাথার ঘাম পায়ে ফেলে ধান উৎপাদন করে কৃষকরা বোরো ধানের ন্যায্যমূল্য না পেলেও, ভারত থেকে ব্যাপকহারে হচ্ছে চাল আমদানি। এতে কম দামে চাল আমদানি করে আমদানিকারকরা লাভবান হলেও উৎপাাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন কৃষকরা। মিল মালিকরা বলছেন, বিদেশ থেকে ব্যাপকহারে চাল আমদানির ফলে বাজারে এর ব্যাপক প্রভাব পড়ছে। বিদেশী চালের কারণে বাজারে কমেছে চালের দাম ও চাহিদা। আর এ কারণেই তারা বেশি দামে ধান কিনতে পারছেন না। কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে সঙ্কট না থাকা সত্ত্বেও বিদেশ থেকে চাল আমদানি করায় বাজারে ধানের দাম কমছে। আমদানি বন্ধ না হলে কৃষকরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে জানিয়েছেন কৃষি বিশেষজ্ঞ ও মিল মালিকরা। আমদানি নির্ভরতা না থাকলেও আমদানি করা চালই কৃষকের সর্বনাশ ডেকে আনছে বলে জানিয়েছেন তারা। আর কৃষকরা বলছেন, এভাবে লোকসান হতে থাকলে ধান চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন কৃষকরা। চলতি বোরো মৌসুমে ধানের জেলা দিনাজপুরসহ সারাদেশে ধানের দাম না থাকায় কৃষকরা চরম লোকসানের মুখে পড়েছে। বাজারে ধান বিক্রি করে লাভ তো দূরের কথা, উৎপাদন খরচও তুলতে পারছেন না কৃষকরা। বাজারে ধানের দাম না থাকায় ইতোমধ্যেই যারা ধান কর্তন করেছেন, তারা বাজারে পানির দামে ধান বিক্রি করে হতাশ ও বিমর্ষ হয়ে বাড়ি ফিরছেন। আর যারা এখনও ধান কাটেননি, তারা চড়াদামে মজুরি দিয়ে ধান কাটার সাহস পাচ্ছেন না। দিনাজপুরে বোরো ধান বিক্রি হচ্ছে প্রতিমণ ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকায়। কৃষকরা জানান, এই দামে ধান বিক্রি করে লাভ তো দূরের কথা, উৎপাদন খরচও উঠবে না তাদের। বাজারে দাম না থাকায় বাধ্য হয়েই লোকসান দিয়ে ধান বিক্রি করছেন তারা। দিনাজপুর সদর উপজেলার বোলতৈড় গ্রামের কৃষক সেলিম রেজা জানান, প্রতিবিঘা জমিতে ধান উৎপাদন করতে খরচ হয়েছে সব মিলিয়ে প্রায় ১৮ হাজার টাকা। আর একবিঘা জমিতে ধান উৎপাদন হয়েছে ৩৪ মণ। এক বিঘা জমির ধান বাজারে বিক্রি করে তিনি পেয়েছেন ১৭ হাজার টাকা। এতে বিঘাপ্রতি লোকসান এক হাজার টাকা। সঙ্গে রয়েছে বিনিয়োগ ও নিজের শ্রম। আর যদি বর্গাচাষী হয় তাহলে এই লোকসানের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ৭ হাজার টাকা থেকে ১০ হাজার টাকা। গত কয়েক বছর ধরেই ধানে লোকসান গুনতে হচ্ছে তাদের। এভাবে চলতে থাকলে ধানচাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন কৃষকরা বলে জানান তিনি। দিনাজপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক তৌহিদুল ইকবাল জানান, দিনাজপুরে জেলায় এবার মোট ১ লাখ ৭৪ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধান আবাদ করা হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে প্রায় ৭ লাখ মেট্রিকটন চাল। তিনি জানান, ইতোমধ্যেই বোরো ধান কাটা শুরু করেছে কৃষকরা। এবারে রোগ বালাই না থাকা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ না থাকায় বোরোর বাম্পার ফলন হয়েছে। এদিকে ধানের বাম্পার ফলন হলেও ভারত থেকে ব্যাপকহারে চাল আমদানি করা হচ্ছে। দেশের অন্যতম বৃহৎ স্থলবন্দর দিনাজপুরের হিলি স্থলবন্দর শুল্ক স্টেশনের দেয়া হিসাবে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে মাসের ১৯ তারিখ পর্যন্ত ভারত থেকে চাল আমদানি করা হয়েছে ৪৪ হাজার ৮৬ মে.টন। ২৮ শতাংশ শুল্ক মূল্যে এসব চাল আমদানি করা হচ্ছে। হিলি শুল্ক স্টেশনের রাজস্ব কর্মকর্তা নুর আমীন জানান, হিলি স্থলবন্দর দিয়ে গত জানুয়ারি মাসে ১১ হাজার ৮শ’ ৬৮ মে.টন চাল, ফেব্রুয়ারি মাসে ৭ হাজার ৯শ’ ৬৫ দশমিক ৭ মে.টন, মার্চ মাসে ৯ হাজার ৬শ’ ৯৭ দশমিক ৭৫ মে.টন, এপ্রিল মাসে ৮ হাজার ২শ’ ১২ মে.টন ও চলতি মে মাসের ২৩ তারিখ পর্যন্ত ৬ হাজার ৩শ’ ৪৪ মে.টন চাল আমদানি করা হয়েছে। এসব চালের বেশির ভাগই সম্পা কাটারি বলে জানান তিনি। হিলি স্থলবন্দর আমদানি-রফতানিকারক গ্রুপের সভাপতি হারুন-অর রশিদ হারুন জানান, বর্তমানে ভারত থেকে যে চাল আমদানি হচ্ছে, তা চিনিগুড়া জাতের আতপ চাল। এদিকে সরকার কৃষকদের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে সংগ্রহ অভিযানে চালের মূল্য নির্ধারণ করছে প্রতি কেজি ৩৬ টাকা। কিন্তু ভারত থেকে প্রচুর পরিমাণে চাল বাংলাদেশে আমদানি হওয়ায় এর প্রভাব পড়ছে স্থানীয় বাজারে। ফলে কৃষকরা ধানের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। বাজারে ধানের দাম কমার বিষয়ে মিল মালিকরাও দুষছেন বিদেশ থেকে চাল আমদানিকে। দিনাজপুর জেলা চালকল মালিক সমিতির সভাপতি মোসাদ্দেক হুসেন জানান, বিদেশ থেকে ব্যাপকহারে চাল আমদানির ফলে বাজারে কম দামেই চাল বিক্রি করছে আমদানিকারকরা। এতে বাজারে চালের চাহিদা ও দাম দুটোই কমছে। তাই বেশি দামে ধান কিনে চাল বিক্রি করতে পারছেন না তারা। আর বিদেশ থেকে চাল আমদানি করায় কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ধানের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। এতে কৃষকরা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এটিএম শফিকুল ইসলাম জানান, গত কয়েক বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবং বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের কার্যকরী পদক্ষেপে দেশে ধান উৎপাদন অনেকগুণ বেড়ে গেছে। এতে বার্ষিক চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণ ধান উৎপাদন হচ্ছে। এই অবস্থায় প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও বিদেশ থেকে চাল আমদানি করা হচ্ছে। এর ফলেই কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ধানের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
×