ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

৪৩ বছরের ‘নিরবচ্ছিন্ন প্রতারণার ক্যারিয়ার’ বারেকের

প্রকাশিত: ০৬:২৮, ২৬ মে ২০১৯

৪৩ বছরের ‘নিরবচ্ছিন্ন প্রতারণার ক্যারিয়ার’ বারেকের

অনলাইন রিপোর্টার ॥ ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় ১৮ বছর বয়সে সৌদি আরবে পাড়ি দেন কুমিল্লার দাউদকান্দি এলাকার বাসিন্দা বারেক সরকার ওরফে বারেক হাজী (৬৩)। প্রবাস জীবনে সফল হতে না পারলেও আয়ত্ত করেন নানা প্রতারণার কৌশল। দু’বছর পর দেশে ফিরে সব কাজ বাদ দিয়ে বনে যান পুরোদস্তুর ‘প্রতারক’। প্রতারণার কাজে তার তীক্ষ্ণ দক্ষতা, সুচিন্তিত কর্ম কৌশল ও কর্ম পরিকল্পনা অল্পদিনের মধ্যে তাকে বিরাট সাফল্য এনে দেয়। ক্রমান্বয়ে প্রতারণার সাম্রাজ্য ছড়িয়ে দেন রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। নিরবচ্ছিন্নভাবে ৪৩ বছর ধরে প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নিয়েছেন অন্তত শত কোটি টাকা। তবে দীর্ঘ এ প্রতারণার ক্যারিয়ারে একবারো গ্রেফতার হননি তিনি। শনিবার (২৫ মে) দিনগত রাতে রাজধানীর দারুসসালাম এলাকা থেকে প্রতারক চক্রের মূলহোতা বারেকসহ পাঁচজনকে আটক করেছে র্যাব-৪। এ সময় বারেকের কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, একটি ম্যাগজিন ও দুই রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়। আটক অন্যরা হলেন- হাবিবুর রহমান (২৪), জাকির হোসেন (৫৮), আক্তারুজ্জামান (২৮) ও শাহরিয়ার তাসিম (১৯)। গত ২ মার্চ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা থেকে এ চক্রের ২২ সদস্যকে আটক করা হয়। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে মূলহোতাসহ পাঁচজনকে আটক করা হয়েছে। রবিবার (২৬ মে) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ানবাজারের র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানান র্যাব-৪ এর অধিনায়ক (সিও) অতিরিক্ত ডিআইজি চৌধুরী মঞ্জুরুল কবির। তিনি বলেন, ১৯৫৬ সালে কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দিতে জন্ম নেওয়া বারেক প্রাথমিকের গণ্ডি পার হতে পারেননি। ভাগ্য পরিবর্তনে ১৮ বছর বয়সে সৌদি আরব পাড়ি জমালেও প্রতিষ্ঠিত হতে পারেননি। বরং প্রতারণার নতুন নতুন কৌশল আয়ত্ত করে মাত্র দু’বছর পর দেশে ফিরে আসেন তিনি। এরপর সুনির্দিষ্ট কোনো পেশায় জড়িত না হয়ে শুরু করেন প্রতারণা। কয়েক বছরের ব্যবধানে প্রতারণাই হয়ে উঠে তার পেশা। ৪৩ বছরে নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রতারণার মাধ্যম অন্তত শত কোটি টাকা উপার্জন করেছেন। এছাড়া ঢাকা শহরে নিজের নামে ফ্ল্যাট, গাড়ি, গ্রামের বাড়ি কুমিল্লাতে জমি-জমাসহ অঢেল সম্পত্তি মালিক হয়েছেন প্রতারক সম্রাট বারেক। বারেক তার প্রতারণা কোম্পানির নাম দেন আরসিডি। যার প্রকৃত নাম রয়্যাল চিটার ডেভেলপমেন্ট। এ নামে অফিস নেওয়াসহ সব কার্যক্রম চালিয়ে এলেও প্রকৃত নামটি ছিল সবার অজানা। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় আরসিডির ছোট ছোট গ্রুপ রয়েছে। যারা সুসজ্জিত অফিস ভাড়া করে বিত্তবানদের ফাঁদে ফেলে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নেয়। বারেকের চক্র ছোট-খাট অঙ্কের প্রতারণা করে না, ন্যূনতম ১০-৫০ লাখ টাকার প্রতারণা করতো জানিয়ে র্যাব-৪ এর সিও বলেন, চক্রটি অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের অবসরের আগে থেকেই টার্গেট করে। এরপর তাদের কোম্পানিতে উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগের প্রলোভন দেখিয়ে অফিসে নিয়ে আসে এবং প্রতিষ্ঠানের শেয়ার হোল্ডার হওয়ার জন্য উদ্বুদ্ধ করে। অফিস কর্মকর্তাদের চালচলনে অভিভূত হয়ে টার্গেটকৃত ব্যক্তিরা অবসরকালীন প্রাপ্ত পেনশনের টাকা বিনিয়োগ করতেন। যার কয়েকদিন পরেই অফিসসহ উধাও হয়ে যেতেন অফিসের কর্মকর্তারাও। দেশের বিভিন্ন এলাকার তাঁত ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ীদের কয়েক কোটি টাকার অর্ডারের ফাঁদে ফেলে ৪০-৫০ হাজার টাকার স্যাম্পল নিতেন। কয়েক কোটি টাকার মালামাল তৈরিতে যে পরিমাণ কাঁচামাল প্রয়োজন (সুতা, রং ইত্যাদি) তা সরবরাহের কথা বলে অগ্রিম হিসেবে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে প্রতারণা করে আসছিল চক্রটি। এছাড়া দেশের বিভিন্ন এলাকায় আর্থিকভাবে স্বচ্ছল ব্যক্তিদের জমি বা নির্মাণাধীন ভবনের উপর ইন্টারনেট টাওয়ার স্থাপনের প্রলোভন দিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিতেন। কখনো বিভিন্ন এলাকায় আর্থিকভাবে স্বচ্ছল ব্যক্তিদের বাসায় এবং তার এলাকার মাদ্রাসা, মসজিদে এনজিও’র পক্ষ থেকে বিনা খরচে সৌর প্যানেল বসানোর কথা বলে মোটা টাকা হাতিয়ে নিতো। এর বাইরে ইট-পাথর, রড-সিমেন্ট, গার্মেন্টস, চাল, থাই অ্যালুমিনিয়াম, সোলার প্যানেল ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পেশার লোকদের টার্গেট বানিয়ে তাদের বিপুল পরিমাণ অর্থের অর্ডারের ফাঁদে ফেলে এবং অর্ডারের ভুয়া চুক্তিপত্র সম্পন্ন করে অগ্রিম বাবদ টাকা আদায় করে প্রতারণা করে আসছিল চক্রটি।
×