ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

২৭ মে, ১৯৭১

সমঝোতার সম্ভাবনা নাকচ!

প্রকাশিত: ০৮:৫২, ২৭ মে ২০১৯

সমঝোতার সম্ভাবনা নাকচ!

শাহাব উদ্দিন মাহমুদ ॥ ১৯৭১ সালের ২৭ মে দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। এইদিন মুক্তিবাহিনীর এক প্লাটুন যোদ্ধা কুমিল্লার শালদা নদীর সিএ্যান্ডবি রাস্তার ওপর পাকসেনাদের এ্যামবুশ করে। এ এ্যামবুশে পাকবাহিনীর ৯ জন সেনা নিহত হয় এবং একটি জীপ ও একটি ট্রাক ধ্বংস হয়। মুক্তিযোদ্ধারা কুমিল্লার রাজাপুর এলাকায় অবস্থানরত পাকসেনাদের ওপর আক্রমণ চালায়। মুক্তিযোদ্ধাদের এ অভিযানে ৪ জন পাকসেনা নিহত হয়। সাতক্ষীরায় ভেড়ামারা বাঁধে অবস্থানরত মুক্তিবাহিনীর ওপর পাকিস্তানী দুই কোম্পানি সৈন্য দু-বার হামলা চালায়। দিনব্যাপী যুদ্ধে পাকবাহিনীর দু’জন অফিসার নিহত হয় ও একজন কমান্ডিং অফিসার আহত হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের পাল্টা আক্রমণে পাকসেনারা পিছু হটে। সকালে কুড়িগ্রামের রায়গঞ্জ ও নাগেশ্বরী ঘাঁটি থেকে সামান্য কিছু গোলাবারুদসহ কিছু ইপিআর সদস্য সুবেদার বোরহানের সাহায্যার্থে পাটেশ্বরীর দিকে অগ্রসর হয়। অন্যদিকে বিএসএফএর কাছ থেকে প্রাপ্ত কিছু গোলাবারুদ এবং সংগৃহীত খাবার সঙ্গে নিয়ে একটি জীপ ও উনিশজন মুক্তিযোদ্ধাবাহী একটি ট্রাক মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে মিলিত হতে ধরলা নদীর দিকে রওনা হয়। ওদিকে ধরলা নদী পার হয়ে পাকসেনারা তখন নাগেশ্বরীর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, নাগেশ্বরী পার হয়ে তে-মাথার কাছে পৌঁছে রসদবাহী জীপের একজন মুক্তিযোদ্ধা বিষয়টি আন্দাজ করতে পারেন। সঙ্গে সঙ্গে তাদের জীপ বাম দিকের কাঁচা রাস্তায় নেমে নাগেশ্বরী, রায়গঞ্জ হয়ে ভূরুঙ্গামারীতে ফিরে যায়। পিছনের মুক্তিযোদ্ধাবাহী ট্রাকটি পাকবাহিনীর ঘেরাওয়ের মধ্যে পড়ে। সৈন্যদের প্রচন্ড গোলাবর্ষণের ফলে ট্রাকটি উল্টে রাস্তার পশ্চিম পাশে গর্তের মধ্যে পড়ে যায়। ঘটনাস্থলেই ড্রাইভার রব্বানীসহ সতেরো জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। পাটেশ্বরীর প্রতিরোধ ভেঙ্গে পড়ায় সুবেদার বোরহান মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে পূর্ব দিকে যাত্রাপুরের দিকে সরে পড়েন, তারপর নদী পার হয়ে মাদারগঞ্জ দিয়ে সোনাহাট চলে যান। সুবেদার আরব আলী ও অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা পশ্চিম দিকে সরে গিয়ে ফুলবাড়িতে আশ্রয় নেন। সিআর চৌধুরী তাঁর বিশেষ গেরিলা বাহিনীসহ দুধকুমার নদীর ওপারে চর-ভূরুঙ্গামারীতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। নাগেশ্বরী পাকবাহিনীর দখলে চলে যায়। পাকিস্তানী সামরিক কর্তৃপক্ষ ৫১নং সামরিক বিধির আওতাভুক্ত বইপত্র, পোস্টার, লিফলেট, ইত্যাদি আপত্তিকর জিনিস সামরিক দফতরে জমা দেয়ার নির্দেশ দেয়। ৫১ নং সামরিক বিধি হচ্ছে প্রকাশনা সংক্রান্ত কালো আইন। এই আদেশ অমান্যের শাস্তি ৭ বছরের সশ্রম কারাদ-। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নয়াদিল্লীতে এক অনুষ্ঠাতে বলেন, পূর্ববঙ্গ থেকে ব্যাপকভাবে বাঙালীদের ভারতে আগমনের ফলে আমাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে গুরুতর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে। উদ্বাস্তু পরিস্থিতি ভারতের পক্ষে বিরাট বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাকিস্তান সরকার যেভাবে পূর্ববঙ্গের পরিস্থিতি মোকাবেলা করছেন তাতে কেবল ভারতের নয়, এ অঞ্চলের শান্তি বিঘ্নিত হতে পারে। এদিন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূত আগা হিলালী ওয়াশিংটনে বলেন, ভারত পাকিস্তানের একটি অভ্যন্তরীণ সমস্যাকে আন্তর্জাতিকীকরণের চেষ্টা চালাচ্ছে। মার্কিন সিনেটর উদ্বাস্তু সংক্রান্ত সাব-কমিটির চেয়ারম্যান এ্যাডওয়ার্ড কেনেডি বাংলাদেশের জনগণ ও ভারতে অবস্থানরত বাঙালী উদ্বাস্তুদের দুর্দশা লাঘবে ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় নিয়োজিত পক্ষগুলোর পাশে এসে দাঁড়ানোর জন্য মার্কিন সরকারের প্রতি আবেদন জানান। ভারতের কলকাতার সদর স্ট্রিট মেথোডিস্ট চার্চের রেভারেন্ড জন হ্যাস্টিংস ও রেভারেন্ড জন ক্ল্যাপহ্যাম যৌথভাবে দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশের জন্য সম্পাদককে চিঠি লেখেন। একাত্তরের এই দিন চিঠিটি গার্ডিয়ানে প্রকাশিত হয়। মহোদয়, স্বল্প সময়ে অনেক সুন্দর গল্পের পেছনে ছুটতে থাকা কোন প্রতিবেদক আমরা নই। আমরা প্রত্যেকেই ২০ বছর ধরে পশ্চিমবঙ্গে বসবাস করে আসছি। এখানে ত্রাণ বিতরণ করতে গিয়ে শত শত সাধারণ শরণার্থীর সঙ্গে কথা বলেছি। পূর্ব পাকিস্তানে কী ঘটছে তার একটি ছবি আজ আমাদের কাছে সন্দেহাতীতভাবে পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। ফায়ারিং স্কোয়াড থেকে নিহায়ত ভাগ্যক্রমে বেঁচে যাওয়া অনেকেই আছেন। শত শত সাক্ষী আছেন যারা নিজ চোখে মেশিনগানের গুলিতে হত্যা করতে দেখেছেন অনেককে যাদের মধ্যে আছেন-রাজনৈতিক নেতা, অধ্যাপক, চিকিৎসক, শিক্ষক ও ছাত্ররা। দিনের আলোয় কিংবা রাতের অন্ধকারে যখন খুশি গ্রাম ঘেরাও করা হয়েছে, ভীতসন্ত্রস্ত গ্রামবাসী যে যেখানে সম্ভব পালিয়েছে, নতুবা তাদের যেখানে পাওয়া গেছে, সেখানেই হত্যা করা হয়েছে, কিংবা তাদের মাঠে ধরে এনে রীতিমতো কচুকাটা করা হয়েছে। নারীদের ধর্ষণ করা হয়েছে আর মেয়েদের উঠিয়ে নিয়ে গেছে ব্যারাকে, নিরস্ত্র কৃষককে লাঠিপেটা করা হয়েছে, কখনো বেয়নেটে দিয়ে খুঁচিয়ে মারা হয়েছে। সাত সপ্তাহ পরও অবস্থা অপরিবর্তিতই রয়ে গেছে। এমনকি সবচেয়ে অবিশ্বাস্য গল্প- ভীতসন্ত্রস্ত শিশুদের ধরে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচানো কিংবা নারীদের নগ্ন করে বেয়োনেট দিয়ে লম্বালম্বি চিড়ে ফেলা কিংবা শিশুদের শরীরকে টুকরো করা- এগুলো সত্য; এজন্য নয় যে লোকজন এসব ঘটনা বলেছে। কারণ যারা বলেছে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নিয়ে গল্প বানানোর মতো উদ্দেশ্য তাদের নেই। আমরা হাত কেটে ফেলা মা এবং পা কাটা শিশুও দেখেছি। এসব ঘটনা ঘটেছে সীমান্ত থেকে বেশ কিছুটা দূরে। তাদের বুলেটের ক্ষতগুলোতে গ্যাংগ্রিন হয়ে গেছে, অনেকেই চোখের সামনে নিজের মেয়েকে ধর্ষিত হতে দেখেছেন এবং তাদের শিশুদের মাথা গুঁড়িয়ে যেতেও দেখেছেন। কেউ দেখেছেন স্বামী, সন্তান ও নাতিকে কবজিতে বেঁধে গুলি করতে- এটা ছিল বাছাই করে শক্ত সামর্থ্য পুরুষদের শেষ করে দেয়ার একটি প্রক্রিয়া। কোন কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধও বনগাঁ হাসপাতালের সেই মেয়েটিকে শান্ত করতে পারবে না, প্রলাপের ঘোরে সে চিৎকার করে কাঁদছে আর বলছে- ‘ওরা আমাদের সবাইকে হত্যা করবে, ওরা আমাদের সবাইকে হত্যা করবে।’ তার পাশেই কাঁপছে আরেকটি মেয়ে- দিনভর ধর্ষণের পর ওরা তার গোপনাঙ্গ বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়েছে। ভারতে আসার পথে প্রায় ৪০০ জনকে মারা হয়েছে চুয়াডাঙ্গায়, তাদের ঘেরাও করে হত্যা করা হয়েছে। কেন? পাছে তাদের নির্যাতনের কাহিনী ভারতে পৌঁছে যায়? অথবা শেখ মুজিবের নেতৃত্বে একটি গণতান্ত্রিক পদ্ধতি মেনে নেয়ার কারণে সে দেশে বসবাস করার অধিকার হারানো? সবচেয়ে ভীতিকর উদ্যোগটি সম্ভবত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলা। ফার্স্ট ব্যাটালিয়নে কয়েকজন গুলিবৃষ্টির মধ্য থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছে- গুলি করেছে তারাই, যারা আগের দিন তাদের সঙ্গে এক মেসের বাসিন্দা ছিল। এটা ছিল সমগ্র পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার একেকটি দৃষ্টান্ত। এই ক্রোধ আসলে বছরের পর বছর ধরে সঞ্চিত ঘৃণার ফসল। শোষণ হয়ে উঠেছিল তাদের মজ্জাগত চর্চা। চাল পশ্চিম পাকিস্তান থেকে দ্বিগুণ দামে কিনতে হতো পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে। মুজিবের অনুসারীরা গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণভাবে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রস্তুত ছিল। ডিসেম্বরের নির্বাচনে জনগণ নিরঙ্কুশ সমর্থন দিয়ে ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টিতেই তাকে ম্যান্ডেট দিয়েছে। ইয়াহিয়া খান ও ভুট্টোর এই ফলাফলের অপমানটা হজম হলো না। এটা কি ভারতের সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত হবে? এটা অন্য যে কোন দেশের সমস্যার মতই, ভারতের জন্য তার চেয়ে বেশি কিছু হওয়ার কথা নয়। পশ্চিম কী করছে? আসল খেলা তো শেষ হয়ে গেছে। ত্রাণ সহায়তা চালিয়ে যাওয়ার তহবিল কে দেবে? এর জন্য প্রচারণা চালাবে কে? রাজনৈতিক জটিলতা কি মুখে গজ ঢুকিয়ে দিয়েছে? কোন সরকার বা কোন ব্যক্তির কি সেই কণ্ঠস্বর নেই, যা এই অসহায়, বিপর্যস্ত মানুষদের জন্য উচ্চারিত হবে? এমন কোন বিবেক কি নেই, যা শোনাতে পারবে একটি সৃষ্টিশীল উত্তর!! জন হ্যাস্টিংস ও জন ক্ল্যাপহ্যাম। একাত্তরের এই দিনে ইউএনআই ও পিটিআই এর বরাতে আনন্দবাজার পত্রিকায় ‘তামাবিল ঘাঁটি আবার মুক্তিফৌজের দখলে’ শিরোনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×