ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

পোল্ট্রি রফতানির বিপুল সম্ভাবনা

প্রকাশিত: ০৮:৫৪, ২৭ মে ২০১৯

পোল্ট্রি রফতানির বিপুল সম্ভাবনা

রহিম শেখ ॥ অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে ডিম ও মুরগির মাংস রফতানির বিপুল সম্ভাবনাও সৃষ্টি করেছে পোল্ট্রিখাত। তবে, এ খাতে নতুন করে কর আরোপ ও কৃষির উপখাত হওয়া সত্ত্বে উচ্চ সুদের ঋণসহ নানা কারণ, সম্ভাবনা বাস্তবায়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এমন দাবি করে সুযোগ কাজে লাগাতে সরকারী নীতি সহায়তা চান উদ্যোক্তারা। সেই সঙ্গে ২০১৯ সালের মধ্যেই পোল্ট্রিখাতকে রফতানিমুখী খাতে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি তাদের। জানা যায়, আশির দশকে শুরু হওয়া এই শিল্পের বিনিয়োগ বর্তমানে ছাড়িয়ে গেছে ৩০ হাজার কোটি টাকা। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ৬০ লাখ মানুষের। প্রায় ৬০ লাখ মানুষের জীবন-জীবিকা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এখন এ শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। এ খাতে কর্মরতদের প্রায় ৪০ শতাংশই নারী। ফলে গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশ ও নারীর ক্ষমতায়নে কৃষির পরই সবচেয়ে বড় অবদান রাখছে বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্প। বাংলাদেশের মোট প্রাণিজ আমিষের শতকরা ৪০-৪৫ ভাগই জোগান দেয় পোল্ট্রি শিল্প। বর্তমানে জিডিপিতে ২ দশমিক ৪ শতাংশ অবদান রাখা এ খাতের ১৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি প্রমাণ করেছে পোল্ট্রি শিল্পের সম্ভাবনা। তবে, বর্তমানে খামারিদের ব্যয় বাড়লেও ডিম ও মুরগির সঠিক দাম না পাওয়ার আক্ষেপ আছে তাদের। পরিসংখ্যান ব্যুরোর-তথ্য মতে, এই খাদ্য চাহিদার ১০ শতাংশ আসে পোল্ট্রি খাত থেকে। মোট প্রাণিজ আমিষের ৪০-৫০ ভাগও যোগান দেয় এই খাত। জানা গেছে, আমিষ ও পুষ্টি চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশে দিন দিন বেড়ে চলছে পোল্ট্রি শিল্প। পোল্ট্রি এ্যাসোসিয়েশনের তথ্য মতে, সারাদেশে বর্তমানে প্রায় ৬৫-৭০ হাজার ছোট-বড় খামার রয়েছে। এসব খামারে প্রতিদিন মুরগির মাংসের উৎপাদন প্রায় ১ হাজার ৮৫১ টন। প্রতিদিন ডিম উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ২ কোটি ২০ লাখ থেকে ২৫ লাখ। একদিন বয়সী মুরগির বাচ্চার সাপ্তাহিক উৎপাদন প্রায় ১ কোটি ২৫-৩০ লাখ। সক্ষমতা আছে ১ কোটি ৩৫-৪০ লাখের। আগে ডিম এবং ব্রয়লার মুরগি আমদানি করতে হতো। এখন তা শূন্যের কোঠায় দাঁড়িয়েছে। এ খাতে বার্ষিক প্রবৃদ্ধির বর্তমান হার প্রায় ১৫ শতাংশ। জানা গেছে, ২০০৫ সালের আগেও দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রফতানি হতো ডিম। কিন্তু ২০০৭ ও ২০০৯ সালে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা বা বার্ড ফ্লুতে আক্রান্ত হওয়ায় পোল্ট্রি শিল্পে বিপর্যয় নেমে আসে। বার্ড ফ্লু আঘাত হানায় ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন ফর এ্যানিমেল হেলথের (ওআইই) শর্তের কারণে পোল্ট্রির রফতানি বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে এ বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে এ খাতের উদ্যোক্তারা। ওয়ার্ল্ডস্ পোল্ট্রি সায়েন্স এ্যাসোসিয়েশন-বাংলাদেশ শাখার সাবেক সভাপতি শামসুল আরেফিন খালেদ বলেন, ইউরোপীয়ান ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে গরুর মাংসের ওপর থেকে সাবসিডি তুলে নেয়া হচ্ছে। মুরগির ওপর থেকেও সাবসিডি ধীরে ধীরে তুলে নেয়া হবে। এতে করে তাদের উৎপাদন খরচ বেশ কিছুটা বেড়ে যাবে। কিন্তু তখন আমাদের দেশে তুলনামূলক কম দামে ডিম ও মুরগি পাওয়া যাবে। এতে করে ওইসব দেশে বিলিয়ন ডলারের মার্কেট উন্মুক্ত হতে পারে বাংলাদেশের জন্য। যার ফলে আমরা আগামী ২০২৪ সাল নাগাদ পোল্ট্রি পণ্য রফতানি শুরু করতে পারব বলে আশা করছি। তিনি বলেন, বিভিন্ন দেশের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা এবং বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর হালাল মার্কেটে প্রবেশের সুযোগ আছে। এজন্য সরকারকে আরও বেশি আন্তরিক হওয়ার আহ্বান জানান তিনি। বিপিআইসিসি সূত্রে জানা গেছে, আগে হ্যাচিং ডিম আমদানি করতে হতো। এখন বাংলাদেশে ৭টি গ্রান্ড প্যারেন্টস্টক (জিপি) ফার্ম আছে। প্যারেন্টস্টক বা পিএস ফার্মের সংখ্যা ছোট-বড় মিলে প্রায় ৮০টি। অভ্যন্তরীণ উৎপাদন দিয়েই দেশের হ্যাচিং ডিমের শতভাগ চাহিদা পূরণ হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (এফএও) বলছে, জনপ্রতি ন্যূনতম ডিম খাওয়া উচিত বছরে ১০৪টি। সেখানে বাংলাদেশে জনপ্রতি বছরে ডিম খাচ্ছে ৫১ থেকে ৫২টি। উন্নত বিশ্বে বছরে জনপ্রতি গড়ে প্রায় ২২০টির মতো ডিম খাওয়া হয়। ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ এ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ সালে পোলট্রি ফিডের বার্ষিক উৎপাদন ২৫ লাখ টন। বর্তমানে তা বেড়ে হচ্ছে ৪০ লাখ টন। এছাড়া মাছ, পাখি, গবাদিপশুসহ অন্যান্য ফিড উৎপাদন হচ্ছে ২০ লাখ টন। এর সঙ্গে বাণিজ্যিক ফিড মিলও আছে। সব মিলিয়ে ফিড মিলের ৯৫ শতাংশ দেশই যোগান দিচ্ছে কিন্তু ফিড মিলের কাঁচামাল আমদানিতে আরোপিত অতিরিক্ত করারোপের কারণে উৎপাদন খরচ কয়েকগুণ বেড়ে যাচ্ছে। তারপরও অপুষ্টির হার কমিয়ে আনতে অবদান রাখতে চায় পোল্ট্রি শিল্প। মসলা জাতীয় পণ্য আমদানিতে মাত্র ৪ শতাংশ হারে ঋণ প্রদান করা হয়; কৃষি ঋণেরও সুবিধা অনেক; অথচ পোল্ট্রি খামারি ও উদ্যোক্তাদের ১০-১২ শতাংশ হারসুদে ঋণ নিতে হচ্ছে। প্রান্তিক খামারিরা সাধারণত বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ঋণ পান না, তাই তাদের মহাজন কিংবা এজিও থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতে হয়। এ তো গেল অভ্যন্তরীণ প্রেক্ষাপট। আমরা যদি পোল্ট্রি খাতে বিনিয়োগ করা বিদেশী কোম্পানিগুলোর দিকে তাকাই তাহলে সুদের হারের এ ব্যবধানটা আরও প্রকট হয়ে উঠবে। বিদেশী কোম্পানিগুলো বিদেশী ব্যাংক থেকে মাত্র ২-৩ শতাংশ হার সুদে ঋণ এনে এ দেশে ব্যবসা করছে। অর্থাৎ দেশীয় উদ্যোক্তা ও বিদেশী বিনিয়োগকারীদের মাঝে ব্যাংক ঋণের সুদের হারের পার্থক্য প্রায় ৮ থেকে ১০ শতাংশ! এ অসম প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না দেশীয় ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক খামারিরা। অন্যদিকে দেশের বাজার থেকে মোটা অঙ্কের মুনাফা লুটে ক্রমেই আরও শক্তিশালী হচ্ছে বিদেশী কোম্পানিগুলো। এ অসম প্রতিযোগিতা এবং পোল্ট্রি শিল্পের প্রতি এ অন্যায্যতার অবসান ঘটাতে হলে এ শিল্পের জন্য ব্যাংক ঋণের সুদের হার ৪-৫ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। বিদেশী কোম্পানিগুলোর ওপর অতিরিক্ত কিছু কর আরোপ করে দেশীয় শিল্পের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। জানতে চাইলে বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিলের (বিপিআইসিসি) সভাপতি মসিউর রহমান বলেন, কাঁচামালের ওপর শুল্ক ও কর কমানো, এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে শূণ্য করা দরকার। এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার নিরুৎসাহিত করতে প্রো-বায়োটিক ও প্রি-বায়োটিকের ওপর আগামী ৫ বছরের জন্য ভর্তুকি দেয়ার দাবি জানান বিপিআইসিসি সভাপতি। তিনি বলেন, এ খাতের আরও বিনিয়োগ বাড়াতে সরকারের সহযোগিতা করা উচিত। উদ্যোক্তারা নানা উদ্যোগ নিচ্ছেন, যাতে সাশ্রয়ী দামে পুষ্টিমান সমৃদ্ধ প্রাণিজ আমিষ সহজলভ্য করা যায়। একই সঙ্গে দেশের চাহিদা মিটিয়ে তারা রফতানির জন্যও প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তবে এ জন্য আরও কিছুটা সময়ের প্রয়োজন হবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মোঃ আশরাফ আলী খান খসরু জনকণ্ঠকে বলেন, বর্তমান সরকার কৃষি ও পোল্ট্রি বান্ধব। এ খাতের উন্নয়নে জাতীয় প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন নীতিমালা ও পোল্ট্রি উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। নিরাপদ খাদ্যের উৎপাদন নিশ্চিত করতে মৎস্য ও পশুখাদ্য আইন-২০১০ ও নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩ প্রণয়ন করেছে। পোল্ট্রি খাদ্য উপকরণের ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধি, নতুন নতুন রোগ-বালাইয়ের প্রাদুর্ভাব, ওষুধের কার্যকারিতা কমে যাওয়া প্রভৃতি পোল্ট্রি শিল্পের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ বলে মন্তব্য করেন প্রতিমন্ত্রী। তিনি বলেন, ওষুধের কার্যকারিতা কমে যাওয়ার প্রেক্ষিতে এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার যেন বেড়ে না যায় সেজন্য এখনই কার্যকর কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। তিনি বলেন, পোল্ট্রি পণ্য রফতানি বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ডিম ও গোশত রফতানির জন্য সরকার ইতোমধ্যেই উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সে লক্ষ্যে স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এস ও পি) ও গাইডলাইন অচিরেই তৈরি করা হবে।
×