ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

তারেকের একক সিদ্ধান্ত, খালেদা ও সিনিয়ররা গুরুত্বহীন

প্রকাশিত: ০৯:৫৮, ২৭ মে ২০১৯

 তারেকের একক সিদ্ধান্ত, খালেদা ও সিনিয়ররা গুরুত্বহীন

শরীফুল ইসলাম ॥ দল পরিচালনায় বিএনপির লন্ডন প্রবাসী ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বেপরোয়া। খালেদা জিয়াসহ দলের কোন সিনিয়র নেতাকেই মানছেন না তিনি। সকল দলীয় কর্মকান্ড একক সিদ্ধান্তেই বাস্তবায়ন করছেন। কোন্টা ভুল আর কোন্টা সঠিক সেদিকে তাকাচ্ছেন না। এ নিয়ে কারাবন্দী বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়াসহ দলের সিনিয়র নেতাদের মধ্যে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছে। তারা না পারছে তারেক রহমানকে কিছু বলতে, না পারছে তার চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্ত মেনে নিতে। এ পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়া মুক্তি না পেলে বিএনপির ভবিষ্যত চরম অনিশ্চয়তার দিকে যাওয়ার আশঙ্কা করছে দলটির নেতাকর্মীরা। গত বছর ৮ ফেব্রুয়ারি বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া মামলায় সাজা নিয়ে কারাগারে যাওয়ার পর থেকেই দলে আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে তার লন্ডন প্রবাসী ছেলে তারেক রহমান। যদিও কারাগারে যাওয়ার আগে খালেদা জিয়া সিদ্ধান্ত দিয়ে গিয়েছিলেন, তার অনুপস্থিতিতে দল চলবে স্থায়ী কমিটির সদস্যদের সমন্বিত সিদ্ধান্তে। কিন্তু খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পরদিনই এ সিদ্ধান্ত উল্টিয়ে দেন লন্ডন প্রবাসী ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তারেক রহমান লন্ডন থেকে সিনিয়র নেতাদের নির্দেশনা পাঠান দল চলবে তার নির্দেশেই। এর পর থেকে একে একে সব সিদ্ধান্ত তিনি একাই দিতে থাকেন। মাঝেমধ্যে সিনিয়র নেতাদের বৈঠককালে স্কাইপিতে লোকদেখানো আলোচনা করলেও সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেন নিজের ইচ্ছেতেই। আগে মাঝে মধ্যে খালেদা জিয়ার নির্দেশনা মানার চেষ্টা করলেও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে থেকে বিএনপিতে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেন তারেক রহমান। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সারাদেশে দলীয় প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত করা থেকে শুরু করে সর্বশেষ বগুড়ার উপনির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত পর্যন্ত কোন সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার আগে খালেদা জিয়ার নির্দেশ মানেনি তারেক রহমান। এমনকি এসব সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার আগে দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে পরামর্শ করারও প্রয়োজন মনে করেননি তিনি। এর ফলে সম্প্রতি বিদেশে চিকিৎসা শেষে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর দেশে ফেরার পর সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন- বগুড়া- ৬ আসনের উপনির্বাচনে দলীয় মনোনয়নের বিষয়ে কি জানেন? জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, আমি কিছুই জানি না। মির্জা ফখরুলের মুখে এমন উত্তর শুনে শুধু সাংবাদিকরাই নন, বিএনপি নেতাকর্মীরাও বিব্রত হন। অভিজ্ঞ মহলের মতে, গণতন্ত্রের কথা বলে রাজনীতি করা বিএনপিতে তারেক রহমান যেভাবে একের পর এক অগণতান্ত্রিকভাবে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তা সুষ্ঠু রাজনীতিতে কাম্য নয়। এতে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীর মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হচ্ছে। সেই সঙ্গে দলের গণতন্ত্রমনা নেতাকর্মীরা ধীরে ধীরে রাজনীতি থেকে নিজেদের সরিয়ে নেবে। এর ফলে বিএনপি দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির সম্মুখীন হবে। বগুড়া-৬ আসনের উপনির্বাচনে একক সিদ্ধান্তে বিএনপির প্রার্থী ঠিক করতে গিয়ে তারেক রহমান তার মা খালেদা জিয়াসহ দলের ৫ নেতাকে প্রাথমিকভাবে মনোনয়ন দেন। এ খবর শুনে তারেক রহমানের ওপর চরম অন্তুষ্ট হন খালেদা জিয়া। কেন তার অনুমতি ছাড়া এ নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হলো এবং কেন অন্য ৪ জনের সঙ্গে খালেদা তাকেও এ উপনির্বাচনে অংশ নিতে প্রাথমিক মনোনয়ন দেয়া হলো এ বিষয়টিকে তিনি মেনে নিতে পারেননি। খালেদা জিয়ার এ অবস্থানের কথা জেনে পরে তারেক রহমান দলীয় অপর ৪জনকে মনোনয়নপত্র জমা দিতে বললে তারা রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে তা জমা দেন। কিন্তু দলের অন্য সিনিয়র নেতারাও এ বিষয়টিকে ভালভাবে নেননি। তাদের মধ্যে এ নিয়ে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করলেও তারা এ বিষয়ে মুখ খুলেননি। প্রসঙ্গত, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভরাডুবির পর বিএনপি এ নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করে দ্রুততম সময়ের মধ্যে নতুন নির্বাচন দাবি করে। সেই সঙ্গে এ সরকারের অধীনে আর কোন নির্বাচনে অংশ না নেয়ারও সিদ্ধান্ত নেয় দলটি। বিএনপির সঙ্গে তাদের নির্বাচনী জোট জাতীয় ঐক্যফ্রন্টও একই অবস্থান নেয়। নতুন নির্বাচনের দাবিতে বিএনপি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট বিভিন্ন আন্দোলন কর্মসূচীও পালন করে। এ ছাড়া জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও অংশ নেয়নি বিএনপি ও তাদের জোট। দলের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নেয়ায় ২ শতাধিক তৃণমূল নেতাকে দল থেকে বহিষ্কারও করা হয়। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দলের নেতাদের সঙ্গে স্কাইপি বৈঠক করে বগুড়া-৬ আসনের উপনির্বাচনে ৫ জনকে প্রাথমিক মনোনয়ন দেয়ার বিষয়টি কিছুতেই মেনে নিতে পারেননি খালেদা জিয়াসহ দলের সিনিয়র নেতারা। যেখানে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর কোন নির্বাচনে অংশ নেয়নি এমনকি বগুড়া-৬ আসন থেকে নির্বাচিত বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শপথ নিয়ে সংসদে যায়ননি সেখানে সে আসনের উপনির্বাচনে বিএনপি যায় কি করে; বিএনপির সিনিয়র নেতারা এখন নিজেদের মধ্যে এমন আলাপ-আলোচনা করছেন। কিন্তু সিনিয়র নেতাদের এমন উপলব্ধিকে আমলেই নিচ্ছেন না তারেক রহমান। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শপথ না নেয়ায় শূন্য হওয়া বগুড়া-৬ আসনের উপনির্বাচনে অংশ নেয়ার বিষয়ে দলের কারাবন্দী চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া ও লন্ডন প্রবাসী ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মধ্যে এ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই মতবিরোধ সৃষ্টি হয়। উপনির্বাচনে অংশ নেয়ার বিষয়ে আগে থেকেই তারেক রহমান ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করলেও খালেদা জিয়া বরাবরই ছিলেন নেতিবাচক অবস্থানে। তাই তফসিল ঘোষণার আগেই ২০ দলীয় জোটের সঙ্গে স্কাইপি বৈঠকে তারেক রহমান এ নির্বাচনে অংশ নেয়ার কথা জানালেও পরে খবর পেয়ে খালেদা জিয়া এর বিরোধিতা করন। এর ফলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ দলের সিনিয়র নেতারা এ উপনির্বাচন নিয়ে কোন আগ্রহ প্রকাশ করেননি। এর আগে বিএনপি দলীয় ৫ এমপি শপথ নিয়ে সংসদে গিয়েছেন তারেক রহমানের একক সিদ্ধান্তেই। তারা সংসদে যোগদানের পরই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর শপথ না নেয়ায় শূন্য হওয়া বগুড়া-৬ আসনের উপনির্বাচন ও দলের জন্য সংরক্ষিত ১টি নারী আসনের নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন। ইতোমধ্যেই বিএনপির সহআন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার রুমিন ফারহানাকে সংরক্ষিত নারী আসনে দলীয় মনোনয়ন দেয়ায় তিনি এমপি হচ্ছেন। সংসদে না যাওয়ার পূর্বনির্ধারিত সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে দলীয় ৫ এমপিকে সংসদে যাওয়ার নির্দেশ দেয়ার পর থেকেই ছেলে তারেক রহমানের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন খালেদা জিয়া। খালেদা জিয়ার সঙ্গে দলের অন্য সিনিয়র নেতারাও ক্ষুব্ধ হন। স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়সহ ক’জন সিনিয়র নেতা প্রকাশ্যেই এই ক্ষোভের কথা জানান। ২০ দলীয় জোট নেতারাও এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থের দল বিজেপি এককভাবে তারেক রহমানের এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে জোট ত্যাগ করেন। এ পরিস্থিতিতে প্রথমে বিএনপি ও পরে ২০ দলীয় জোটের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে স্কাইপিতে কথা বলেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এ সময় তিনি কোন্ প্রেক্ষাপটে বিএনপি পূর্বনির্ধারিত সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে দলীয় এমপিদের সংসদে যাওয়ার সিদ্ধান্ত দেন তা জানান। তবে তারেক রহমানের ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হতে পারেননি বিএনপি ও ২০ দলের সিনিয়র নেতারা। একক সিদ্ধান্তে তারেক রহমানের দল পরিচালনার বিষয়টি বিএনপি পন্থী বুদ্ধিজীবীরাও ভালভাবে নিতে পারেননি। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বিএনপি পন্থী বুদ্ধিজীবী ডাঃ জাফরউল্লা চৌধুরী বলেন, তারেক রহমানের উচিত অন্তত ৩ বছর রাজনীতি থেকে দূরে থাকা। আর অপর বুদ্ধিজীবী প্রফেসর এমাজউদ্দিন আহমেদ বলেন, তারেক রহমান দেশের বাইরে অবস্থান করেন। তাই রাজনীতি করতে হলে তার দেশে ফিরে আসা উচিত। দলের অধিকাংশ নেতাকর্মীও তাই মনে করেন। কিন্তু তারেক রহমান কারও পরামর্শই শুনছেন না। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিএনপি নেতা বলেন, খালেদা জিয়া কারাগারে থাকায় দলের গঠনতান্ত্রিক ক্ষমতাবলে তারেক রহমান এখন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। তবে তিনি লন্ডনে অবস্থান করায় দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে দল পরিচালনার ক্ষেত্রে কখন কোন্ সিদ্ধান্ত দিতে হবে সে ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া দুষ্কর। তারপরও তিনি সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করে যে কোন সিদ্ধান্ত দিতেই পারেন। কিন্তু কারও সঙ্গে কোন আলোচনা না করে তারেক রহমান এককভাবে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে গিয়ে ইতোমধ্যেই নেতাকর্মীদের মধ্যে ভুল বার্তা দিয়েছেন। দলের সাধারণ নেতাকর্মীরা চান এসব ভুলের অবসান ঘটিয়ে সিনিয়র নেতাদের মতামত নিয়ে তারেক রহমান দল পরিচালনা করুক।
×