ঈদ মানে আনন্দ, ঈদ মানেই খুশি, সকলের জীবনে আনন্দের বার্তা বয়ে নিয়ে আসে। ছোট-বড়, ধনী-গরিব সবার জন্যই দিনটি হওয়ার কথা ছিল খুশির। কিন্তু সত্যিই কি তাই? ঈদের আনন্দের জোয়ার সবার মনেই জেগে ওঠে কিন্তু সেই খুশির জোয়ার ধরে রাখতে পারে কয়জন? বাস্তবতা বা অভাবের চাপে কি ঈদের আনন্দ মাটি হয় না? আমাদের সমাজের এমন অনেক মানুষ আছেন যাদের কাছে ঈদ মানে বছরের অন্য ১০টি দিন অথবা কাজবিহীন সর্বোপরি উপার্জনবিহীন একটা দিন যেটা আরও ভয়াবহ। প্রতিদিনের মতো তাদের এই দিনটিও কাটে অনাহারে, অর্ধাহারে পায় না নতুন পোশাক এবং হাতে পড়ে না মেহেদীর দাগ। আর তাই তাদের জীবনকে একটু স্বাচ্ছন্দ্যময় করতে আমাদের দুর্বার তারুণ্যের একটা অংশ নিজেদের নিয়োজিত করেছে। বছরব্যাপী নানা মানবিক উদ্যোগের পাশাপাশি দুস্থ এসব মানুষের (বিশেষ করে শিশুদের) ধূসর ঈদকে রঙিন করতে কাজ করছে বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। অদম্য বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে নিজেদের উজাড় করা দুটি সংগঠনের
গল্প পাঠকদের সামনে তুলে ধরছেন- সারতাজ আলীম
আলোর খোঁজে
২৬ মে, ২০১৯। মিরপুরের ফোর সি রেস্টুরেন্টে দেখা মিলল একদল সুবিধাবঞ্চিত শিশুর। সুন্দর বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা আলোর খোঁজের উদ্যোগে সেখানে এক ইফতারের আয়োজন করা হয়েছিল। যেখানে উপস্থিত ছিল ৮০ জনেরও বেশি সুবিধাবঞ্চিত শিশু। আনন্দ উল্লাস আর হৈচৈর মধ্য দিয়ে ইফতার করে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে তাদের ঈদের নতুন উপহার বিতরণ করা হয়। বিগত বছরগুলোতে এই শিশুদের ঈদটা ছিল অনেকটাই মলিন।
শুরুটা খুব অল্প থেকেই। স্বপ্নদ্রষ্টা অমিত কর জয় মনে করেন কম হোক আর বেশি হোক শুরু করাটাই এক চ্যালেঞ্জ। আলোর খোঁজের যাত্রা শুরু হয়েছিল রাজধানীর মিরপুর থেকে। বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় বিইউবিটি এর পাশে কয়েকজন সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের নিয়ে তাদের সূচনা একটা হোয়াইট বোর্ড, একটা মার্কার আর কয়েকটা খাতা পেন্সিল নিয়ে। প্রথমে ৮ জন বাচ্চাকে পড়াতে শুরু করেন তিনি। শুরুতে কেউই পাশে ছিল না। ধীরে ধীরে সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের সংখ্যা বাড়তে থাকে; ৮ থেকে ১০; ১০ থেকে ২০ তারপর আরও বেশি। বোর্ড পরীক্ষায় সন্তোষজনক ফল করে অনেকেই। পিইসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ ও পায় একজন। তাদের ভাল ফল দেখে এগিয়ে আসে অনেকেই। বাড়তে থাকে স্বেচ্ছাসেবীর সংখ্যা। নিরক্ষর এসব শিশুরা জীবনে চলতে পারার মতো কিছু প্রাথমিক অক্ষরজ্ঞান লাভ করছিল। এভাবে কয়েক মাস চলতে থাকে। এর পর আসে বর্ষাকাল। বৃষ্টি বা রাস্তায় কাদাপানির মধ্যে আর কার্যক্রম চালানো সম্ভব হলো না। পাশের বস্তিতে একটা কক্ষ ভাড়া নিয়ে সেখানে চলতে থাকে স্কুলের কার্যক্রম। বর্তমানে ২টি কক্ষে চলছে এই স্কুলের কার্যক্রম। ৮ জন শিশু নিয়ে শুরু হওয়া আলোর খোঁজের পাঠশালায় এখন ৮০ জনের বেশি শিশু শিক্ষা নিচ্ছে। মোট স্বেচ্ছাসেবীর সংখ্যা ১৫ জন। সবাই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। নিজেদের সময় থেকে একটু সময় বাঁচিয়ে তারা ছুটছেন মানবতার সেবা করতে। শিক্ষার পাশাপাশি চলছে বিভিন্ন সচেতনতা বৃদ্ধির নানা উদ্যোগ, সাংস্কৃতিক আয়োজন। আর এসব কিছুর ব্যয় বহন করছেন আলোর খোঁজের সদস্যরা নিজেই।
অমিত মনে করেন পরিবারের ওপর যেমন একজন মানুষের দায়িত্ব আছে তেমনি সমাজের ওপরও কিছু দায়িত্ব আছে। বাবার কাছ থেকে তিনি শিখেছিলেন মানুষের জন্য কিছু করলেই মানুষ তাকে মনে রাখবে। সেই তাড়না থেকেই মানবতার সেবায় ছুটে চলেছেন অমিত। নিজের স্বপ্ন ছড়িয়ে দিয়েছেন অনেকের মাঝে। হয়তো এই শিশুগুলোই আগামী বাংলাদেশের কারিগর।
আর্তনাদ ফাউন্ডেশন
৪২ জন সুবিধাবঞ্চিত শিশু; সবার হাতে ঈদের নতুন জামা কাপড়ের প্যাকেট। গত মাসের ২১ তারিখে একটি ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে তাদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে ঈদের এই উপহার। ২৫ তারিখে তাদের নিয়েই এক ইফতার এবং দোয়া মাহফিলের আয়োজন করে এই সংগঠনটি। হয়তো কয়েকজন তরুণ পাশে না দাঁড়ালে ঈদের আনন্দটাই থাকত না এই শিশুদের। জীবনের নির্মম বাস্তবতা টের পেতে হতো ঈদের দিনেও।
সংগঠনের নাম আর্তনাদ ফাউন্ডেশন। যাত্রা শুরু হয়েছিল রক্তদানকে কেন্দ্র করে। মানবতার নেই কোন সীমা পরিসীমা। আর তাই রক্তদানে উৎসাহিত করার মাধ্যমে যাত্রা শুরু করা আর্তনাদ ফাউন্ডেশন আজ ছড়িয়ে পড়েছে নানারকম কাজে। ২০০৩ সালে সংগঠনের স্বপ্নদ্রষ্টা ফোরকান জানতে পারেন তার এক বন্ধুকে টাকা দিয়ে রক্ত কিনতে হয়েছে। এই ঘটনা প্রবলভাবে নাড়া দেয় তাকে। ২০১৩ সাল থেকে অনুষ্ঠানিকভাবে ৪০ জন স্বপ্নবাজদের নিয়ে যাত্রা শুরু করে তারা। বর্তমানে এই স্বপ্ন ছড়িয়ে গেছে ৩০০ জনের বেশি স্বেচ্ছাসেবকের মধ্যে। তাদেরই চাঁদাতে যোগাড় হচ্ছে সংগঠনের অর্থ। বর্তমানে ২৩টি জেলার ৩৫টি ইউনিট রক্তদানের সমন্বয় করছে। আর্তনাদ ফাউন্ডেশনের ৬০০ জনের অধিক নিয়মিত রক্তদাতা রয়েছে। রক্তদান সংক্রান্ত যে কোন দরকারে পাশে আছে তাদের কল সেন্টার। তাদের পক্ষ থেকে ৬ বছরে সারাদেশে প্রায় ৫০০০ ব্যাগ রক্তদান করা হয়েছে। ২৫ হাজারের বেশি মানুষ জানতে পেরেছে তাদের রক্তের গ্রুপ। রক্তদানের উপকারিতা সম্পর্কে অবগত করা হচ্ছে মানুষকে। এছাড়াও দুস্থদের মাঝে খাবার বিতরণ, বস্ত্র প্রদান এবং ফ্রি মেডিক্যাল ক্যাম্পের আয়োজন করে আর্তনাদ ফাউন্ডেশন।
২০১৬ সালে মালিবাগ রেলগেটে প্রতিষ্ঠা করা হয় বর্ণমালা স্কুল। শিশুদের বিনামূল্যে পাঠদান, শিক্ষাসামগ্রী এবং খাবার বিতরণ করা ও বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে শিক্ষামূলক কুইজ ও বিতর্ক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়। এছাড়াও সম্প্রতি এই স্কুলের সকল শিক্ষার্থীদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে ঈদের নতুন পোশাক। রোজার আনন্দ ভাগ করে নিতে আয়োজন করা হয়েছে ইফতারেরও। ফোরকান জানান আগামীতে এই স্কুলের আরও শাখা খোলার পরিকল্পনা আছে, ইচ্ছা আছে স্থায়ী মেডিক্যাল ক্যাম্প খোলারও। মানবতার এই ডাকে অবিরাম ছুটে চলুক তরুণ প্রজন্ম। মানবতার এই ডাক ছড়িয়ে পড়ুক সবার মাঝে। সুন্দর হয়ে উঠুক আমাদের বাংলাদেশ। যে বাংলাদেশ নির্মাণে নেতৃত্ব দেবে মানবিক তারুণ্য।
শীর্ষ সংবাদ: