ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জলবায়ু কন্যা গ্রেটা থানবার্গ

প্রকাশিত: ০৯:৩৩, ১১ জুন ২০১৯

 জলবায়ু কন্যা গ্রেটা থানবার্গ

গত বছরের গ্রীষ্মে ইউরোপজুড়ে নজিরবিহীন তাপদাহে জনজীবনে নাভিশ্বাস উঠছিল। ইউরোপবাসীর কাছে এমন নজিরবিহীন তাপপ্রবাহ জীবনে প্রথম। এমনকি সুইডেন ও ইউরোপের কিছু জায়গায় দানাবলে পুড়ে গিয়েছিল লক্ষাধিক হেক্টর বনভূমি। এসব কিছুকে উপেক্ষা করে রাজনীতিবিদরা যখন রাজনীতির নানা সমীকরণ মেলাতে ব্যস্ত তখনই ত্রাতা হয়ে পথে নামেন এক কিশোরী। সে বছরেরই ২০ আগস্ট স্কুল বয়কট করে সুইডেনের সংসদের সামনে প্ল্যাকার্ড নিয়ে বসে পড়েন এই কিশোরী যে প্ল্যাকার্ডে কিনা লিখা ছিল ‘জলবায়ুর জন্য স্কুল স্ট্রাইক’। উদ্দেশ্য একটাই, আর তা হলো জরবায়ু রক্ষায় প্যারিসে পরিবেশ চুক্তি অনুসারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার জন্য সংসদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। স্কুলে না গিয়ে এই কিশোরীর একক প্রতিবাদ কর্মসূচী চলল সেপ্টেম্বরের ৯ তারিখ, অর্থাৎ সুইডেনের সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত। শুধু এখানেই শেষ নয়, নির্বাচনের পরেও তিনি তার এই কর্মসূচী চালিয়ে গিয়েছিলেন তবে সেটা সপ্তাহে একদিন শুধু শুক্রবার। যে কিশোরীকে নিয়ে এত বাক্যালাপ তিনি হলেন ক্লাস নাইনে পড়া সুইডেনের কিশোরী ‘গ্রেটা থানবার্গ’ যার বর্তমান বয়স মাত্র ১৬ বছর। বেড়ে ওঠা স্টকহোমে। তার এই কর্মকান্ডে সম্প্রতি পরিবেশে উষ্ণায়ন রুখতে অনেকেই নড়েচড়ে বসেছেন। শুরুটা একার হলেও গত বছরের শেষ ভাগে পরিবেশের জন্য স্কুল স্ট্রাইকের এই আন্দোলনের তরঙ্গ ছড়িয়ে পড়েছিল পৃথিবীজুড়ে। বিশ্বের কয়েকশ’ শহরের হাজার হাজার স্কুল ছাত্রছাত্রী শামিল হয় এতে। শুধুমাত্র বার্লিনেই ২৫ হাজারের মতো ছাত্রছাত্রী শামিল হয় এই স্কুল স্ট্রাইকে আর জার্মানিজুড়ে সংখ্যাটা ছিল ৪০ হাজারেরও বেশি। এরই মধ্যে কিশোরী গ্রেটা বড় বড় মঞ্চে পরিবেশের উষ্ণায়নের ওপর বক্তৃতা দিয়েছেন। গেল বছরের অক্টোবরে লন্ডনে, নবেম্বরে স্টকহোমে টেড এক্স কনফারেন্সে, ডিসেম্বরে জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন শীর্ষক বৈঠক ও প্লেনারি এ্যাসেম্বলিতে। এ বছরের জানুয়ারিতে দাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের মিটিংয়ে, ফেব্রুয়ারিতে ইউরোপিয়ান ইকোনমিক এ্যান্ড সোশ্যাল কমিটির কনফারেন্সে বক্তব্য রাখেন গ্রেটা। তবে গ্রেটার জনপ্রিয়তার সর্বোচ্চ সূচক স্পর্শ পায় চলতি বছরের জানুয়ারিতে তার বক্তব্যের একটি ভিডিওর নেট দুনিয়ায় আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে। বার্ষিক ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে উপস্থিত শীর্ষনেতাদের সামনে দাঁড়িয়ে গ্রেটা বলেছিল ‘কিছু মানুষ বলে থাকেন আমরা সবাই মিলেই নাকি জলবায়ু সঙ্কট তৈরি করেছি। আদতে তা সত্যি নয়। যদি কোন একজন মানুষ একটি নির্দিষ্ট অপরাধের জন্য দায়ী হয়, তার জন্য কোনভাবেই সবাইকে দায়ী করা উচিত নয়। শুধুমাত্র যারা অপরাধী, তাদেরই দায়ী করতে হবে। আমরা প্রত্যেকেই জানি এই জলবায়ু সঙ্কটের পেছনে দায়ী হলো কিছু মানুষ, কিছু প্রতিষ্ঠান এবং কিছু নীতি নির্ধারক, যারা কিনা নিজেরাও খুব ভাল করেই জানেন অর্থ উপার্জনের লক্ষ্যে তারা পৃথিবীর কী ভীষণ ক্ষতি করে চলেছেন এবং আমার বিশ্বাস সেই মানুষদের মধ্যে অনেকেই আজ এখানে উপস্থিত আছেন। বিশ্ব নেতাদের কাছে তার আবেদন ছিল ‘আমাদের ঘরে আগুন লেগেছে। আপনারাও এটা নিয়ে ভাবুন, ভয় পান, যে ভয়টা আমি পেয়ে চলেছি প্রতিনিয়ত।’ সেদিন সবার সামনে দাঁড়িয়ে দ্ব্যর্থহীন চিত্তে বলা কথাগুলোর কল্যাণে গ্রেটা আজ শুধু বিশ্বব্যাপী পরিচিত নামই নয় পাশাপাশি সে পেয়েছে ২০১৯ সালের জন্য শান্তিতে নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির মনোনয়নও। আর নোবেলটা শেষ পর্যন্ত পেয়ে গেলে মালালার রেকর্ড ভেঙ্গে এই কিশোরী গ্রেটাই হবে বিশ্বের সবচেয়ে কনিষ্ঠ শান্তিতে নোবেল বিজেতা। আশ্চর্য বিষয় এই যে এ্যাসপারজার সিন্ড্রোম অর্থাৎ সামাজিক সংযোগ স্থাপনে যার সমস্যা এছাড়াও মানসিক অবসাদ, অবসেসিভ কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার, এ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপার এ্যাক্টিভিটি ডিসঅর্ডারের মতো সমস্যায় আক্রান্ত মেয়েটি যেন কি সহজেই পুরো পৃথিবীর সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে ফেলেছে কোন এক জাদুমন্ত্র বলে। গ্রেটার এই বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়া আন্দোলনের ফলে ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট জাঁ ক্লদে জানকার এরই মধ্যে ২০২১-২০২৭ সময়সীমার মধ্যে জলবায়ু ও বিশ্ব উষ্ণায়ন নিয়ন্ত্রণে এক লাখ কোটি ইউরো খরচের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। গ্রেটার আহ্বান যেমন বিশ্বনেতারা গুরুত্বের সঙ্গে শুনছেন তেমনি করে কি আমরা যারা বাংলাদেশের জনতা ও নীতিনির্ধারক তারাও শুনতে পাচ্ছি তার আহ্বানগুলো?
×