ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

টি ইসলাম তারিক

ইউরোপের রাজা পর্তুগাল

প্রকাশিত: ১২:৩৮, ১২ জুন ২০১৯

ইউরোপের রাজা পর্তুগাল

১৫ বছর আগে লিসবনে কান্নার সাগরে ভেসে গিয়েছিল পর্তুগাল। প্রথমবারের মতো ইউরোপ সেরার মুকুট জয়ের কাছাকাছি এসেও ব্যর্থ হয়েছিল লুইস ফিগোর দল। নিজেদের মাঠে ফাইনালে পর্তুগীজরা ১-০ গোলে হেরেছিল গ্রীসের কাছে। ২০০৪ সালের ৪ জুলাই তখনকার ক্ষুদে জাদুকর ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর কান্না ছুঁয়ে গিয়েছিল সবাইকে। ওই বেদনার ১২ বছর পর ২০১৬ সালে আবারও ইউরোপ সেরার মঞ্চের ফাইনালে উঠে আসে পর্তুগাল। এবার নেতা রোনাল্ডোর নেতৃত্বে অসাধ্য সাধন করার মিশন। কিন্তু প্যারিসের সেইন্ট-ডেনিসে স্বাগতিক ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ফাইনাল মহারণের শুরুতেই বড় ধাক্কা খায় পর্তুগাল। ম্যাচের ১৪ মিনিটে আঘাত পান অধিনায়ক রোনাল্ডো। অনেক চেষ্টা করেও আর মাঠে ফিরতে পারেননি। যে কারণে ২৫ মিনিটে রোনাল্ডোর পরিবর্তে মাঠে নামানো হয় রিকার্ডো কারেসমাকে। এক যুগ আগে ছোট্ট রোনাল্ডো কেঁদেছিলেন ফাইনালে হারের পর। ১২ বছর পরও ফাইনালে কান্না সঙ্গী করে উঠে যেতে হয় তাঁকে। ওই সময় ফরাসী কোচ দিদিয়ের দেশমের মতো মুচকি হেসেছিলেন অনেকেই। তাদের ভাবখানা ছিল এমন, হেসেখেলে চ্যাম্পিয়ন হবে ফ্রান্স! আর আরেকবার কাঁদতে হবে রোনাল্ডোকে! কিন্তু বিধাতা যে চিত্রনাট্য সাজিয়ে রেখেছিলেন অন্যভাবে। রোনাল্ডো উঠে গেলে কি হবে, এরপর দলের সেরা তারকার জন্যই পর্তুগীজরা হয়ে উঠেন অদম্য। দলের সবাই যেন হয়ে উঠেন রোনাল্ডো। তাইতো শক্তিশালী ফ্রান্সকে ১-০ গোলে হারিয়ে নিজেদের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ইউরো চ্যাম্পিয়ন হয় পর্তুগাল। ২০০৪ সালে প্রথমবারের মতো ইউরোর ফাইনাল খেলেছিল পর্তুগাল। কিন্তু ঘরের মাঠে সেবার হারের বেদনায় নীল হতে হয়েছিল ফিগো, রোনাল্ডোদের। ২০১৬ সালে সেই হতাশা বরণ করতে হয়েছে ফ্রান্সকে। প্যারিস আক্রমণের আট মাস পর ১৩০জন মানুষের মৃত্যুশোক কাটিয়ে ওঠার দারুণ সুযোগ হাতছাড়া করেন গ্রিজম্যান, এভরা, পোগবাদের। কোচ দেশমের হাত ধরে বড় কোন টুর্নামেন্টে চতুর্থ শিরোপার লক্ষ্যেই নিজেদের পরিচিত মাঠে ময়দানি যুদ্ধে নেমেছিল স্বাগতিকরা। ১৯৮৪ ইউরো ও ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপের পর ঘরের মাঠে এটা তাদের জন্য তৃতীয় শিরোপার হাতছানি ছিল। ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপ জয়ী দলের অধিনায়ক ছিলেন দেশম। স্টাডে দ্য ফ্রান্সেই একমাত্র বিশ্বকাপ জিতেছিল ফরাসীরা। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। অদম্য পর্তুগীজদের কাছে হেরে বেদনায় নীল হতে হয় ফরাসীদের। ১৯৮৪ ইউরো সেমিফাইনাল, ইউরো ২০০০ ও ২০০৬ বিশ্বকাপে ফ্রান্সের কাছে পরাজিত হয়ে বিদায় নিয়েছিল পর্তুগাল। অবাক করা বিষয় হচ্চে, সবশেষ ইউরোতে পুরো টুর্নামেন্টে ৯০ মিনিটে মাত্র একটি ম্যাচে জয় পেয়েছে পর্তুগাল। সেমিফাইনালে ওয়েলসের বিরুদ্ধে ২-০ গোলে জয় পেয়েছিল রোনাল্ডোরা। বাদবাকি ম্যাচগুলো হয় ড্র নয়ত, অতিরিক্ত সময়ে জিতেছে পর্তুগাল। ২০০৪ সালের ফাইনালের সময় রোনাল্ডোর বয়স ছিল ১৯ বছর। ওই বয়সে ফাইনালে হারের পর চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি তখনকার ক্ষুদে বিস্ময়। তিন বছর পর ফাইনালেও ইনজুুরি আক্রান্ত হয়ে স্ট্রেচারে করে বাইরে যাওয়ার সময় তার চোখের পানি দেখেছে পুরো স্টেডিয়াম। তাকে যখন বাইরে বের করে নেয়া হচ্ছিল স্টেডিয়ামের পুরো সমর্থকরাই দাঁড়িয়ে সম্মান প্রদর্শন করেন। দ্বিতীয়ার্ধের শেষের দিকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা শেষে মাঠে ফিরে এসে টাচলাইনে দাঁড়িয়ে কোচ সান্টোসের পাশাপাশি পুরো দলকে উৎসাহিত করেন। তিন বছর পর এবার নতুন করে শুরু হওয়া উয়েফা নেশন্স কাপে আর কেদে মাঠ ছাড়তে হয়নি রোনাল্ডোকে। মাঠে থেকেই দেশকে জিতিয়েছেন দ্বিতীয় বড় ট্রফি। ৯ জুন নিজ দেশ পর্তুগালের পোর্তোতে অনুষ্ঠিত ফাইনাল ম্যাচে টোটাল ফুটবলের জনক হল্যান্ডকে ১-০ গোলে হারিয়েছে ফার্নান্ডো সান্টোসের দল। পর্তুগালের হয়ে জয়সূচক গোলটি করেন গঞ্জালো গুয়েডেস। পুরো আসরে চোখ ধাঁধানো ধারাবাহিক পারফরমেন্স প্রদর্শন করে টুর্নামেন্ট সেরা হয়েছেন চ্যাম্পিয়ন পর্তুগালের অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার বার্নাডো সিলভা। তিন বছরের ব্যবধানে দু’দুটি আন্তর্জাতিক আসরে চ্যাম্পিয়ন হয়ে উচ্ছ্বাসে ভাসছেন সুপারস্টার ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডো। ক্লাবের হয়ে ভূরি ভূরি শিরোপা জেতা সি আর সেভেন এখন জাতীয় দলের হয়েও সফল। এক্ষেত্রে তার চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী লিওনেল মেসিকে ব্যর্থই বলতে হবে। ক্লাব ক্যারিয়ারে বার্সিলোনার হয়ে শিরোপার পর শিরোপা জিতলেও এখন পর্যন্ত আর্জেন্টিনার হয়ে তাঁর ভা-ার শূন্য। আসন্ন কোপা আমেরিকাতে সেই বন্ধ্যত্ব বার্সা ডায়মন্ড ঘোচাতে পারেন কিনা সেটাই দেখার। চ্যাম্পিয়ন হতে না পারলেও এই আসরে রানার্সআপ হয়ে নিজেদের চেনা রূপে ফিরেছে হল্যান্ড। গত দুটি বড় টুর্নামেন্টে বাছাইপর্ব থেকেই বাদ পড়েছিল ডাচরা। ২০১৬ ইউরোর পর ২০১৮ বিশ্বকাপে খেলা হয়নি তাদের। বড় বিপর্যয়ের পর কোচ রোল্যান্ড কোম্যানের অধীনে হল্যান্ড দারুণভাবে ফিরে এসেছে। নেশন্স কাপে গ্রুপ পর্বে বিশ্বচ্যম্পিয়ন ফ্রান্স ও জার্মানিকে পরাজিত করে সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডকে ৩-১ গোলে হারিয়ে ফাইনালের টিকেট কাটে তারা। অবশ্য শেষটা ভাল করতে না পারায় বেদনায় ভারাক্রান্ত হতে হয়েছে ভার্জিল ভ্যান ডিকের দলকে। ম্যাচটিতে মূল আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন দুই দেশের দুই অধিনায়ক ও সেরা তারকা পর্তুগালের রোনাল্ডো ও হল্যান্ডের ভার্জিল। রক্ষণভাগে ডাচ অধিনায়ক নিজেকে দারুণভাবে মেলে ধরায় সি আর সেভেন খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি। ভার্জিলের সঙ্গে মাথিয়াস ডি লিট বেশিরভাগ সময়ই পর্তুগীজ সুপারস্টারকে খোলসবন্দী করে রাখেন। যে কারণে পর্তুগালের অন্যরা আক্রমণ শাণাতে বেশি সুযোগ পান। ম্যাচে এর প্রভাবও লক্ষ্য করা যায়। প্রায় পুরো ম্যাচেই আধিপত্য ছিল পর্তুগীজদের। ম্যাচের ৬০ মিনিটে ভ্যালেন্সিয়া উইঙ্গার গুয়েডেস ডি বক্সের মাথা থেকে জোড়ালো শটে হল্যান্ড গোলরক্ষক জাসপার সিলিসেনকে পরাস্ত করেন। বল গোলরক্ষকের হাতে লাগলেও শেষ রক্ষা হয়নি। গোলটিতে দারুণ অবদান রাখেন টুর্নামেন্ট সেরা সিলভা। ডাচ রক্ষনভাগকে ভেঙ্গে ইংলিশ ক্লাব ম্যানচেস্টার সিটিতে খেলা এই তারকা দারুণ এক পাস দেন গুয়েডেসকে। ভ্যালেন্সিয়ার উইঙ্গার চলতি বলে বুলেট শটে শিরোপা নিশ্চিত করা গোলটি করেন। ম্যাচ শেষে চ্যাম্পিয়ন পর্তুগালের কোচ ফার্নান্ডো সান্টোস বলেন, অসাধারণ পারফরম্যান্সের জন্য আমি আমার খেলোয়াড়দের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। এটা তাদের জয়, পরিশ্রম ও আত্মনিবেদনের ফসল। তিনি আরও বলেন, আমি নিশ্চিত যে এই টুর্নামেন্ট ক্লাসিক হয়ে উঠবে কারণ এটা একটা টুর্নামেন্ট যেখানে গোটা ইউরোপিয়ান পরিবার অংশ নেয় এবং প্রথম আসরের শিরোপা জেতায় আমরা ইতিহাসের অংশ হয়ে থাকব। জেতার মানসিকতা থাকলে সেই দলের ভাল খেলার বিকল্প নেই। ভাল খেলেই পর্তুগাল চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। রানার্সআপ ডাচ দলের কোচ কোম্যান বলেন, আমরা পরিশ্রান্ত ছিলাম কিনা জানি না, তবে মোটেই ভাল খেলতে পারিনি। পর্তুগালের রক্ষণভাগ বেশ শক্তিশালী ছিল। পুরো ম্যাচেই তারা বেশ সংঘবদ্ধ ফুটবল খেলেছে। ফাইনালের মতো ম্যাচে নিজেদের এগিয়ে নিতে হলে আরও ভাল খেলা উপহার দিতে হবে। যা আমরা মোটেই পারিনি। ম্যানচেস্টার সিটির হয়ে ঘরোয়া ট্রেবল জয়ী বার্নাডো সিলভা বলেন, আমি খুব খুশি, খুবই গর্বিত। দেশের হয়ে এটাই আমার প্রথম শিরোপা। পর্তুগীজ সমর্থকদের ধন্যবাদ। আর সুপারস্টার ও পর্তুগাল অধিনায়ক রোনাল্ডো বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় দলের সময়টা দারুণ যাচ্ছে। সবকিছুর জন্য সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ। গুরুত্বপূর্ণ শিরোপা ইউরো ২০১৬ জয়ের পর এবার পর্তুগাল নেশন্স লীগের শিরোপা জিতেছে। অনেকের কাছেই এটা সহজ মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। এই ধরনের শিরোপা জয়ে অনেক বেশি ইচ্ছা ও মানসিক শক্তির প্রয়োজন হয়। সবকিছুর জন্য খেলোয়াড়রা অভিনন্দন পাওয়ার যোগ্য। ইতিহাসের অংশীদার হতে পেরে আমিও গর্বিত।
×