ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সুখ-শান্তি নির্মল বিনোদনে

প্রকাশিত: ০৯:২৩, ১৩ জুন ২০১৯

 সুখ-শান্তি নির্মল বিনোদনে

জাস্টিন গোমেজ॥ নির্মল বিনোদন চর্চা হলো মানসিক, ভাষিক ও সামাজিক যোগাযোগ বিকাশের এক বিশাল মাধ্যম। শিশুদের ভাষিক, সামাজিক ও মানসিক বিকাশের পূর্ববর্তী স্তরে শিশুর সঙ্গে বাবা-মায়ের বা লালন-পালনকারীদের খেলা একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। খেলার মাধ্যমে শিশুর বস্তু সম্পর্কে ধারণা বাড়ে, অনুধাবন ক্ষমতা টেকসই হয়, শিশুর ভাষার প্রকাশগত দিকসহ শিশুর মানসিক শব্দভা-ারও সমৃদ্ধ হয়। খেলতে খেলতে শিশু সামাজিক যোগাযোগ দক্ষতা, বুদ্ধিগত দক্ষতাও অর্জন করে। এ ছাড়া খেলার মাঠে শিশুর নিয়ানুবর্তিতা, সততা, প্রতিজ্ঞা, ভদ্রতা, নম্রতার মতো সদাচারণ শিক্ষার ক্ষেত্রেও ভূমিকা রাখে। পাশাপাশি খেলাধুলা শিশুর আবেগ-অনুভূতি প্রকাশের মাধ্যমও। খেলাধুলার মাধ্যমে মানসিক বিকাশ ঘটে, যা একই সঙ্গে মনকে সতেজও রাখে। মাঠে অনেকের সঙ্গে খেলাধুলা করার ফলে নেতৃত্বগুণ তৈরি হয়। এমনকি খেলায় হারলে হার মেনে নেয়ার মানসিকতা তৈরি হয়, যা পরবর্তী জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলে। বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলা অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ দক্ষতা বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রাখে। শুধু মাঠের খেলাধুলাই নয়, পরিবারের সবাই মিলে যখন লুডু কিংবা ক্যারাম খেলে বা খেলাচ্ছলে আড্ডা দেয়, তখন তাদের মধ্যে আত্মিক বন্ধন দৃঢ় হয়। এ সবই জীবনে আত্মবিশ্বাস নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি জোগায়। মানতে হবে, আধুনিক যুগ তার হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে নানা বিনোদনের অজস্র উপকরণ ও সম্ভার। প্রযুক্তির সহজলভ্যতা হয়ত আমাদের দ্রুত চিন্তা করতে শেখাচ্ছে। যার ফলে দুনিয়াটা অনেক বড় হয়ে দাঁড়াচ্ছে, চেনা মানুষের সংখ্যা বেশি হচ্ছে। নেটওয়ার্কের নানা সুযোগ-সুবিধার ফলে অনেক সহজলভ্যতা দেখা যায়। বাড়ছে বিমূর্ত ছায়া যোগাযোগ কিন্তু আবছা হতে হারিয়ে যাচ্ছে সামনে বসে থাকা মানুষটির শেষ বিন্দু। বিকেলে আর মায়েদের চোখ ফাঁকি দিয়ে সন্তানেরা আর এক্কাদোক্কা খেলতে যায় না। হঠাৎ বৃষ্টি নামলে বাড়িতে বাবাদের বকুনি উপেক্ষা করে গায়ে কাদামাটি মেখে দামাল ছেলেদের ফুটবল খেলার সেই শৈশব হারিয়ে গেছে। হাতে ছুঁয়ে হাতের বরফ-পানির খেলার চলও আজ আর নেই। হারিয়ে গেছে মুড়ি মাখা খেতে খেতে সাপ-লুডু খেলার খুনসুটির দিন। আজ কল্পনাও করা যায় না, তারুণ্যের যে মনকে কোন দিন চার দেয়ালে বন্দী করে রাখা যায়নি, সেই মন কী করে বন্দী হয়েছে আজ চারকোনা এক মুঠোফোন কিংবা কম্পিউটার বা ট্যাবের পর্দায়। বিনোদনের খেলাগুলো হারিয়ে যায়নি, শুধু খেলাগুলোর মূর্ত-বন্ধুরা হারিয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন। রক্ত-মাংসের যুবারা হেরে যাচ্ছে বিমূর্ত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কাছে। যার সঙ্গে খেলতে খেলতে জয়ী হলে আনন্দে বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে উল্লাস করা যায় না। ফাঁকিবাজি করে জিততে গিয়ে ধরা পড়ার খুনসুটি করা যায় না। এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মধ্যে নির্মল বিনোদন চর্চা করার অভ্যাসটাই হারিয়ে গেছে। তার বদলে তারা সকালে ভারি ব্যাগ কাঁধে নিয়ে স্কুলে যায়, বিকেলে বাসায় ফেরার পর কম্পিউটার বা স্মার্টফোন হাতে নিয়ে গেম খেলতে বসে যাচ্ছে। ফলে দীর্ঘক্ষণ এক জায়গায় বসে খেলার কারণে ছেলেমেয়েদের মধ্যে স্থূলতা দেখা দিচ্ছে, চোখের ওপর চাপ পড়ছে, এমনকি অন্যান্য শারীরিক সমস্যাও তৈরি হচ্ছে। অনলাইনে কিছু কিছু গেমে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করা বা মেসেজ পাঠানোর সুযোগ থাকলেও বাস্তব জীবনের সামাজিকতার শিক্ষা তাতে থাকে না। এসব ডিজিটাল গেম খেলতে খেলতে হয়ত অনেক তথ্য জানা যায় বা শেখা যায়, কিন্তু এটা বাস্তবে কোনকিছু শেখার মতো স্বাদ দিতে পারে না। স্বীকার করি, কম্পিউটার গেমে বিনোদন আছে, কিন্তু মাঠের খেলা বা লুডু খেলার নির্মল বিনোদন এখানে অনুপস্থিত। এটাও মানতে হয় এলাকায় বা শহরে মাঠ নেই। বুঝতে হবে, খেলার মাঠই শিশুদের বিকাশের একমাত্র স্থান নয়। কর্মব্যস্ততা থাকলেও ঘরে ফিরে সন্তানকে সময় দেয়াটা তাদের দায়িত্ব। তা না করে তারা নিজেরাও যদি ঘরে ফেরার পর স্মার্টফোনে সময় ব্যয় করেন, তবে সন্তান বিচ্ছিন্নতার শিকার হয়। ঘরে লুডু খেলুন কিংবা গল্প করুন। বাড়ির ছাদেও কিছু খেলাধুলা করতে পারেন। এখন থেকেই এ ব্যাপারে সচেতন না হলে পরবর্তীকালে সন্তান বেড়ে ওঠার পর সে যখন নানা সমস্যার সম্মুখীন হবে, তখন তার দায় এড়ানো মুশকিল হবে। নটর ডেম কলেজ, ঢাকা থেকে
×