ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

পলাতক জঙ্গীরা এখন নিরাপত্তার জন্য হুমকি

প্রকাশিত: ১০:২৮, ১৩ জুন ২০১৯

 পলাতক জঙ্গীরা এখন নিরাপত্তার জন্য হুমকি

শংকর কুমার দে ॥ দেশের কারাগারগুলো থেকে জামিন নিয়ে পালিয়ে গেছে সহস্রাধিক জঙ্গী। পলাতক জঙ্গীরা এখন নিরাপত্তার জন্য হুমকি। জামিন নিয়ে বের হয়ে আত্মগোপনে চলে গেছে জঙ্গীরা। পলাতক জঙ্গীদের অনেকেই দেশের বাইরে বসে ‘গোপন এ্যাপস’র মাধ্যমে যোগাযোগ করে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছে। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে এই ধরনের তথ্যের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। জামিন নিয়ে পালিয়ে যাওয়া জঙ্গীদের বিষয়ে খোঁজ খবর নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। খবর গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রের। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত তিন বছরে সারাদেশে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে পরিচালিত অভিযানে দুই সহস্রাধিক জঙ্গী গ্রেফতার হয়েছে। যেসব জঙ্গী সংগঠনের জঙ্গীরা জামিন নিয়ে পালিয়ে গেছে। তার মধ্যে রয়েছে নব্য জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি), আনসার আল ইসলাম, হিযবুত তাহ্রীর ও হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশের (হুজি)। ২০১৬ থেকে ’১৮ সালের নবেম্বর পর্যন্ত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারসহ বিভিন্ন কারাগার থেকে জামিন নিয়ে জঙ্গীরা বাইরে বেরিয়েছে। তারপর থেকেই তাদের বেশিরভাগের হদিস পাচ্ছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। জামিনের মাধ্যমে কারাগার থেকে বাইরে বেরিয়েই এসব জঙ্গী সদস্য আড়ালে চলে যাওয়ার বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করছে তদন্ত সংশ্লিষ্ট পুলিশ। তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশের অভ্যন্তরে আত্মগোপন করে বিভিন্ন গোপন এ্যাপসের মাধ্যমে পলাতক অন্য জঙ্গীরা একে অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ভাবিয়ে তুলেছে। এছাড়া রোহিঙ্গা শিবিরে পলাতক জঙ্গীদের অপতৎপরতার তথ্য নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেছেন পুলিশের এক উর্ধতন কর্মকর্তা। দুর্ধর্ষ জঙ্গীরা কারাগারের বাইরে বেরিয়ে আসার কারণে রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘিরে নানামুখী জঙ্গী তৎপরতা শুরু হওয়ার বিষয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে গোয়েন্দা সংস্থা। হিযবুত তাহ্রীর থেকে আসা এবিটির বেশিরভাগ জঙ্গী অত্যন্ত মেধাবী। এই সংগঠনের জঙ্গীরা মাঝে মধ্যে প্রকাশ্যে মিছিল করে। দেয়ালে পোস্টারসহ নানা ধরনের তৎপরতা চালায়। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, লালমনিরহাট জেলার কারাগার থেকে জামিন নিয়ে বেরিয়ে ছদ্মবেশে বিভিন্ন অঞ্চলে লুকিয়ে রয়েছে নব্য জেএমবির জঙ্গী তৌহিদুল ইসলাম (২৫), হাসানুল বান্না (২৪), হযরত আলী (৪৫) ও তাজুল ইসলাম (৪৫)। এ তালিকায় আরও রয়েছে রাজধানীর খিলক্ষেত থানার ১৪ নম্বর মামলার পলাতক আসামি হাবিবুর রহমান, গুলশান থানার ৩২ নম্বর মামলার পলাতক জঙ্গী ছগির হোসেন, কালিয়াকৈর থানার ১২ নম্বর মামলার জঙ্গী রফিকুল ইসলাম ওরফে রকিব ওরফে সুমন ওরফে ছমির ভূঁইয়া। ঢাকা মহানগরীর বিভিন্ন মামলার পলাতক অন্য জঙ্গীরা হচ্ছে কাজী মোঃ রেজওয়ান শরীফ, জসিমউদ্দিন আহমেদ, মোঃ হানফি, মুশফিকুর রহমান, মিনহাজ আবেদীন, মোঃ মনিরুজ্জামান, সায়েফ ও নাজমুল। চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার জঙ্গী আবদুন নূর সাঈদী ওরফে তিতুমীর, তরিকুল ইসলাম ওরফে এখতিয়ারও পালিয়েছে। একই জেলার নাচোল থানার কলারনা গ্রামের বাসিন্দা মোস্তফার ছেলে কারবান আলীও পালিয়েছে। পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জ থানার সোনাহার গজপুরী গ্রামের বাসিন্দা আবদুল্লাহর ছেলে নব্য জেএমবির সদস্য নজরুল ইসলাম ওরফে বাইক নজরুল ওরফে পারভেজ ওরফে হাসান জামিনে বের হয়ে আত্মগোপন করেছে। জামিন পেয়েছে একই জেলার হিযবুত তাহ্রীরের জঙ্গী আশরাফ আলী। কক্সবাজার জেলার নব্য জেএমবির জঙ্গী সদস্য নূর মোহাম্মদ চৌধুরী ওরফে রবিন সন্ত্রাসবিরোধী আইনে একাধিক মামলার আসামি। সম্প্রতি সেও জামিন নিয়ে পালিয়ে গেছে। একই জেলার সদর থানার মধ্যপেচা গ্রামের বাসিন্দা ও চট্টগ্রাম রাউজান থানার মামলার আসামি হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশ বা হুজিবির দুর্ধর্ষ জঙ্গী মাওলানা নোমানও সম্প্রতি জামিন নিয়ে আত্মগোপন করে আছে। ফেনীর জেলার হিযবুত তাহ্রীরের সদস্য তৌহিদা আক্তার ওরফে ঊর্মি, শাহ ইমরান, মোঃ ওমর ফারুক, মোঃ মাঈনউদ্দিন, ফেরদৌস ওয়াহিদ ওরফে প্রিন্স জামিন পেয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, গোয়েন্দা সংস্থার তালিকায় দেশের বিভিন্ন জেলায় পলাতক রয়েছে এমন সংখ্যা সহস্রাধিক। এর মধ্যে সাতক্ষীরা জেলা থেকে ৭ জঙ্গী, মেহেরপুর জেলা থেকে ৩, ঝিনাইদহ থেকে ৬, মাগুরা থেকে ৭, সিলেট জেলা থেকে ২ (হুজি), মৌলভীবাজার থেকে ৩ (জেএমবি), হবিগঞ্জের ১৩, বরিশালের ১৯, বরগুনা জেলার ৩৯, ঝালকাঠির ৩, পটুয়াখালীর ২, পিরোজপুরের ৯, রংপুরে ৯, ঠাকুরগাঁওয়ে ৩০, দিনাজপুরে ১৭, নীলফামারীতে ১৬, কুড়িগ্রামে ৮, পঞ্চগড়ে ২, গাইবান্ধায় ২১ ও লালমনিরহাট জেলার সন্ত্রাসবিরোধী ও বিস্ফোরক আইনের মামলার ৭ জঙ্গী জামিন নিয়েছে। একইভাবে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ২৭, ঢাকা জেলার ৩২, নারায়ণগঞ্জের ১৬, টাঙ্গাইলে ২২, গাজীপুরে ২২, ফরিদপুরে ১৪, মাদারীপুরে ১৫, রাজবাড়ীতে ৫, গোপালগঞ্জে ১০, শরীয়তপুরে ২, কিশোরগঞ্জে ১০, নরসিংদী জেলার ৭, মানিকগঞ্জের ৫, মুন্সীগঞ্জের ১২, ময়মনসিংহের ৫০, নেত্রকোনার ৬, শেরপুরে ৯, জামালপুরে ৩১, রাজশাহীতে ২০, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ৩০, জয়পুরহাটে ৩৬, নওগাঁর ৭, নাটোরে ৮, বগুড়ার ১৬, পাবনার ১৬, সিরাজগঞ্জে ৭, সিএমপির ১৪, চট্টগ্রামের ৩১, কক্সবাজারে ৯, কুমিল্লার ১৪, নোয়াখালীর ২৩, বি-বাড়িয়ার ২৮, চাঁদপুরের ২৭, লক্ষ্মীপুরের ১৮, ফেনী ১৫, খাগড়াছড়ির ১, রাঙ্গামাটির ১, কেএমপির ২৩, খুলনার ৩, চুয়াডাঙ্গার ৭, যশোর ৭, নড়াইলের ২, কুষ্টিয়ার ১৬, বাগেরহাট জেলার বিভিন্ন থানার তালিকাভুক্ত ১৩ জঙ্গী আত্মগোপন করেছে। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, পলাতক জঙ্গীদের অনেকেই পালিয়ে পাশ্ববর্তী দেশ ভারতে গিয়ে ধরা পড়ছে। বেশিরভাগ জঙ্গী পালানোর আগে ছদ্মনামে পাসপোর্ট ও বিভিন্ন কাগজপত্র তৈরি করে বিধায় তাদের দেশত্যাগের বিষয়টি মনিটরিং করা যায় না। প্রকৃত নাম-পরিচয় ও অবস্থানের নির্দিষ্ট এলাকা চিহ্নিত করতে পারলে পুলিশ সদর দফতরের এনসিবির মাধ্যমে তাদের ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ বলেছেন, গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার পর থেকে এ পর্যন্ত ৫১২ জঙ্গীকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। তবে আদালত থেকে এখন পর্যন্ত ৩০০ জঙ্গী জামিনে বের হয়েছে এবং তাদের অধিকাংশই পলাতক। ঈদে নিরাপত্তা ও আইন শৃঙ্খলা নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেছেন র‌্যাবের মহাপরিচালক। দেশবাসীকে আতঙ্কিত না হওয়ার আহ্বান জানিয়ে র‌্যাব মহাপরিচালক বলেন, ‘জামিনে পলাতক থাকা জঙ্গীরা আবারও সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। র‌্যাব মহাপরিচালক বলেন, বৈশ্বিক, আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ে জঙ্গী হামলার ঝুঁকি রয়েছে। আমাদের নিজস্ব ইন্টেলিজেন্স ও অন্য ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির সঙ্গে সমন্বয় করে আমরা নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। যে কোন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমরা প্রস্তুত।
×