ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

মমতাজউদ্দীন আহমদ

প্রকাশিত: ১০:৩৫, ১৩ জুন ২০১৯

  মমতাজউদ্দীন আহমদ

চিরপ্রস্থান হলো এক বহুমুখী প্রতিভার। মমতাজউদ্দীন আহমদ। জাতির সৃজনশীল চিন্তার আকাশে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। ভাষাসংগ্রামী, শিক্ষাবিদ, নাট্যব্যক্তিত্ব, সংস্কৃতিজন, বুদ্ধিজীবী। গত ২ জুন বিকেলে তিনি ঢাকার এক হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। স্বাধীনতা উত্তর বাংলা নাট্য আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ মমতাজউদ্দীন আহমদ। স্বাধীনতার আগে ও পরে দেশের ক্রান্তিকালীন সময়ে তিনি নানা বিষয়ের প্রতীকী উপস্থাপন করেছেন নাটকের মাধ্যমে। তাঁর বেড়ে উঠার সময়ে ভারত-পাকিস্তান ভাগ, ভাষা আন্দোলন আর স্বাধীনতা যুদ্ধ বিশেষ প্রভাব রাখে। সাধারণ মানুষের জীবনযুদ্ধকে সব সময় দেখেছেন গভীরভাবে। সেই জীবনবোধের চিত্র ফুটে ওঠে তাঁর লেখনীতে। মমতাজউদ্দীন আহমদের ‘সাতঘাটের কানাকড়ি’ কি চাহো শঙ্খচিল, স্বাধীনতা আমার স্বাধীনতা, বর্ণচোরা, নাটকগুলোয় তুলে ধরা হয় স্বাধীনতার প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির নানা বিষয়। পেশাগত জীবনে শিক্ষক মমতাজউদ্দীন জড়িত ছিলেন থিয়েটারের সঙ্গে। লেখার পাশাপাশি অভিনয়েও ছিলেন পারঙ্গম। বাংলা নাটকে বিশেষ অবদানের জন্য পেয়েছেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, একুশে পদকসহ আরও অন্যান্য সম্মাননা। মমতাজউদ্দীন ১৯৩৫ সালের ১৮ জানুয়ারি ব্রিটিশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের অন্তর্গত মালদহ জেলার হাবিবপুর থানার আইহো গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। দেশ বিভাগের পর তার পরিবার তদানীন্তন পূর্ববঙ্গে চলে আসে। তার পিতার নাম কলিমুদ্দিন আহমদ ও মাতার নাম সখিনা বেগম। মমতাজউদ্দীন মালদহ আইহো জুনিয়র স্কুলে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করে ১৯৫১ সালে ভোলাহাট রামেশ্বর পাইলট মডেল ইনস্টিটিউশন থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। পরবর্তীকালে রাজশাহী কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় বিএ (অনার্স) ও এমএ ডিগ্রী লাভ করেন। মমতাজউদ্দীন আহমদ ৩২ বছরের বেশি বিভিন্ন সরকারী ও বেসরকারী কলেজে বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি ও ইউরোপীয় নাট্যকলায় শিক্ষাদান করেছেন। ১৯৬৪ সালে তিনি চট্টগ্রাম কলেজের বাংলা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে যোগদানের মাধ্যমে শিক্ষকতা শুরু করেন। তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা ও সঙ্গীত বিভাগের খন্ডকালীন অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষকতা করেছেন। তিনি ১৯৭৬-৭৮ সালে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচী প্রণয়নে একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ভারতের দিল্লী, জয়পুর এবং কলকাতায় নাট্যদলের নেতা হিসেবে ভ্রমণ ও নাট্য মঞ্চায়ন করেন। তার লেখা নাটক কি চাহ শঙ্খ চিল এবং রাজা অনুস্বরের পালা রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচীতে তালিকাভুক্ত হয়েছে। তিনি বাংলাদেশের জাতীয় দৈনিকসমূহে নিয়মিত কলামও লিখতেন। এছাড়ও তার বেশ কিছু নাটক, বাংলাদেশের প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। মমতাজউদ্দীন শিক্ষক ও লেখক হিসেবে পরিচিতি পেলেও থিয়েটারের মাধ্যমে তার কর্মজীবনকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। তিনি সংস্কৃতি অঙ্গনের একজন কর্মী হিসেবে সক্রিয়ভাবে বাংলা ভাষা আন্দোলন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। এছাড়াও স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার আন্দোলনেও তিনি সক্রিয় ছিলেন। মমতাজউদ্দীন ১৯৭৭-৮০ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগের পরিচালক ছিলেন। ২০১১ সাল থেকে তিনি জাতিসংঘের বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনে সংস্কৃতিবিষয়কমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। টেলিভিশনে মমতাজউদ্দীন আহমদের লেখা প্রচার হওয়া প্রথম নাটক ছিল ‘দখিনের জানালা’। এটি নির্মাণ করেন প্রয়াত আতিকুল হক চৌধুরী। টেলিভিশনে প্রচারিত তাঁর প্রিয় নাটকের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে প্রয়াত আব্দুল্লাহ আল মামুনের নির্দেশনায় ‘ঝড়ের মধ্যে বসবাস’। টেলিভিশনে মমতাজউদ্দীন লেখা প্রচারিত সর্বশেষ দর্শকপ্রিয় দুটি নাটক হচ্ছে ‘কূল নাই কিনার নাই’ ও ‘সহচর’। দুটি নাটক নির্মাণ করেছিলেন মোস্তফা কামাল সৈয়দ ও নওয়াজেশ আলী খান। হুমায়ূন আহমেদেরই নির্দেশনায় দশটি নাটকে অভিনয় করেছেন মমতাজউদ্দীন আহমদ। নাটকে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ১৯৭৬ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, ১৯৯৭ সালে একুশে পদক লাভ করেন। এছাড়া নাট্যকলায় অবদানের জন্য ২০০৮ সালে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির বিশেষ সম্মাননা, বাংলাদেশ শিশু একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, আলাউল সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করেন। ২০১৫ সালে আশিতম জন্মজয়ন্তী পালনকালে গণমাধ্যমে এক সাক্ষাতকারে মমতাজউদ্দীন আহমদ দীর্ঘ এই জীবনে প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির কথা বলতে গিয়ে বলেন- ‘রবীন্দ্রনাথের কথায় বলতে হয় ‘সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালবাসিলাম সে কখনও করে না বঞ্চনা’। আমি আমার ছাত্রছাত্রী, দর্শকশ্রোতা ও পাঠকের কাছে খুবই কৃতজ্ঞ। কেননা তাদের কাছ থেকে আমি পেয়েছি অফুরন্ত শ্রদ্ধা, ভালবাসা। আমি মনে করি এতটা পাওয়ার যোগ্য আমি নই। বাংলা ভাষাকে ভালবেসেছি, পেয়েছি সবার ভালবাসা। বাংলাদেশকে আমার বলতে ইচ্ছে করছে জীবন আমার ধন্য হলো মাগো তোমার কোলে এসে। জীবনে কখনও মিথ্যার সঙ্গে যুক্ত হতে চাইনি। জীবনের একটা বিচলিত অবস্থা গেছে, সেটাকে আমার অপ্রাপ্তি ঠিক বলা যায় না। একটা আপত্তি আমার বিধাতার কাছে। খুব অল্প বয়সে আমার মা মারা যায়। এ সময়ে আমার জীবনের একটা খুবই করুণ মুহূর্ত ছিল।’ তিনি বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিংবা দীনবন্ধু মিত্রর মতো মৃত্যুর পরও আমি বেঁচে থাকতে চাই আমার সাহিত্য ও কর্মের মধ্য দিয়ে।
×