ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অধ্যাপক হাসান আবদুল কাইয়ূম

রমাদানউত্তর ভাবনা

প্রকাশিত: ০৯:০৭, ১৪ জুন ২০১৯

 রমাদানউত্তর ভাবনা

রমাদান আসে মানব জীবনের পরতে পরতে পবিত্রতার এবং পরিশুদ্ধতার সৌরব ছড়িয়ে দিতে, এই মাসে আসমানের, রহমতের এবং জান্নাতের দরজাগুলো খুলে দেয়া হয় এবং জাহান্নামের দরজাগুলো বন্ধ করে দেয়া হয় ও শয়তানদের শেকল দিয়ে বাঁধা হয়। প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম রমাদান মাসের গুরুত্ব ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে যে সমস্ত বাণী রেখেছেন তার মধ্যে ঐ বাণীসমূহ অত্যন্ত তাৎপর্য বহন করে। রমাদান আসে রহমত, মাগফিরাত ও দোজখের আগুন থেকে নাজাতের অনন্য ভান্ডার নিয়ে, সিয়াম পালনের মাধ্যমে আত্মসংযম, আত্মশুদ্ধির যে প্রত্যক্ষ প্রশিক্ষণ অর্জিত হয় সেটাই সায়িম বা রোজাদারের জন্য আল্লাহ্্র রহমত দ্বারা অভিষিক্ত হওয়ার। তাবত গোনাহ্্ থেকে মাগফিরাত বা ক্ষমা পাবার ও দোজখের আগুন থেকে রক্ষা পাবার সুযোগ এনে দেয়। এক মাস ধরে সেহ্রি, ইফতার, সিয়াম, তারাবির তৎপরতায় এক অনন্য অনুভব, এক অনন্য প্রশিক্ষণ প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে, সাবধানী জীবনযাপনের প্রয়াস বিরাজ করে মুসলিম মননে। এই যে সাবধানী জীবনযাপনের প্রয়াস এটা রমাদানউত্তর মাসগুলোতেও জারি রাখার মধ্যে রমাদানে গৃহীত প্রশিক্ষণের বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়। একখানি হাদিসে আছে : লিস্্ সায়িমি র্ফ্হাাতান্্, ‘ইন্্দা ফিত্রিহি ওয়া র্ফ্হাাতুন ‘ইন্্দা লিকায়ি রব্বিহি- সায়িমের (রোজাদারের) জন্য দুটি আনন্দ আর সেই আনন্দের একটি হচ্ছে যখন সে ইফতার করে আর দ্বিতীয় আনন্দ হচ্ছে যখন সে তার রবের দিদার লাভ করবে। এই আনন্দ লাভের সুযোগের প্রত্যাশা সায়িমকে তখনই মন্যিলে মকসুদে পৌঁছাতে পারে যখন রমাদান উত্তরকালেও সে রমাদানে অর্জিত শিক্ষার আলোকধারা দ্বারা নিজের সমগ্র জীবন পরিচালিত করতে পারে। রমাদানে যে সহনশীলতার শিক্ষা, মানবিক মূল্যবোধের শিক্ষা লাভ হয় তা শুধুমাত্র রমাদানেই সীমাবদ্ধ রাখার জন্য নয় বরং তা জীবনের প্রতিটি স্তরে, প্রতিটি পর্যায়ে বলবত রাখার জন্য। মানুষ মানুষের ভাই, মানুষ মানুষের জন্য, প্রতিটি মানুষের প্রতি প্রতিটি মানুষের দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে- এগুলো নীতিকথার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে যাতে বাস্তবে তার প্রয়োগ যথার্থভাবে হয় সেই শিক্ষা দিতেই প্রতিবছর রমাদান আসে। এক মাস পূর্ণ হলে রমাদান চন্দ্র পরিক্রমের পথ ধরে ৩৫৪ দিনের আবর্তনে চলে যায়। কিন্তু যে শিক্ষা সে রেখে যায় তাকে সক্রিয় যারা রাখতে পারে তারাই প্রকৃতপক্ষে রমাদানের শিক্ষাকে ধারণ করে। এই পৃথিবীতে আল্লাহ্্ তায়ালা মানুষকে প্রেরণ করেন তাঁর খলিফা বা প্রতিনিধি করে। মানুষ তখনই প্রতিনিধিত্বের মর্যাদা সমুন্নত রাখতে পারে যখন সে আল্লাহ্র বিধান অনুযায়ী জীবন ও সমাজকে এবং দেশ ও বিশ্বটাকে গড়ে তুলতে পারে আর সেটা সম্ভবপর হতে পারে আল্লাহ্্র রবূবিয়ত প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। আল্লাহ্্ সমস্ত মানবাত্মাকে সৃষ্টি করে তাদের জিজ্ঞাসা করেছিলেন : আলাস্তু বি রব্বিকুম- আমি কি তোমাদের রব্্ নই? এর জবাবে সব মানবাত্মা হ্যাঁ সূচক স্বীকারোক্তি ব্যক্ত করেছিল। কোন মানুষেরই সেই স্বীকারোক্তি বিস্মৃত হওয়া উচিত নয়। যারা বিস্মৃত হয়ে যায় তারা মূলত শয়তানের দোসরে পরিণত হয়। মানুষকে আল্লাহ্ তায়ালা বিবেক, বুদ্ধি এবং ভাল-মন্দ বিচার শক্তি যেমন দিয়েছেন, তেমনি সত্য পথের দিশা দেয়ার জন্য হিদায়াতের বাণী সংবলিত কিতাব দিয়েছেন- যা পৃথিবীর মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন নবী-রসূলগণ যুগে যুগে। পৃথিবীতে এক লাখ চব্বিশ হাজার, মতান্তরে দুই লাখ চব্বিশ হাজার নবী-রসূল প্রেরিত হয়ে এসেছেন। তাঁরা সবাই ইসলামের কথাই বলেছেন, তওহীদের কথাই বলেছেন। প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লাম আল্লাহ্্র দেয়া জীবন ব্যবস্থা আল-ইসলামের পরিপূর্ণতা দান করেছেন। তাঁর আবির্ভাবের মধ্য দিয়ে পৃথিবীতে নবী আগমনের পরিসমাপ্তি যেমন ঘটেছে, তেমনি তিনি আল্লাহ্্ প্রদত্ত যে শরিয়াত বা বিধান প্রদান করেছেন সেটাই বলবত হয়েছে এবং পূর্ববর্তী নবী-রসূলদের বিধান স্থগিত হয়ে গেছে। প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লামের নবুওয়ত ও রিসালাত অব্যাহত রয়েছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকবে। তাঁর পৃথিবীতে আগমনের মধ্য দিয়ে পৃথিবী প্রকৃত শান্তির দিশা লাভ করেছে। তিনি সর্বশেষ নবী আর তিনিই সাইয়েদুল মুরসালিন- রসূলগণের নেতা, তিনি রহমাতুল্লিল ‘আলামীন- সমগ্র বিশ্বজগতের জন্য রহমত। আল্লাহ্্ জাল্লা শানুহু প্রিয় নবী হযরত মুহম্মদ সাল্লাল্লাহু ‘আলায়হি ওয়া সাল্লামকে সম্বোধন করে ইরশাদ করেছেন : (হে রসূল) বলুন, যে মানুষ, আমি তোমাদের সকলের জন্য আল্লাহ্্র রসূল, যিনি (্আল্লাহ) আকাশমন্ডল ও পৃথিবীর সার্বভৌমত্বের অধিকারী, তিনি জীবিত করেন এবং মৃত্যু ঘটান, সুতরাং তোমরা ইমান আনো আল্লাহ্্র প্রতি তাঁর উম্মী নবী-রসূলের প্রতি। (সূরা আ’রাফ: আয়াত ১৫৮)। আরও ইরশাদ হয়েছে : হে নবী! আমি নিশ্চয়ই আপনাকে প্রেরণ করেছি সাক্ষীরূপে, সুসংবাদদাতা রূপে, সতর্ককারীরূপে এবং আল্লাহ্্র দিকে তাঁরই অনুমতিক্রমে আহ্বানকারীরূপে এবং উজ্জ্বল প্রদীপ (সিরাজাম মুনীরা) রূপে। (সূরা আহযাব: আয়াত ৪৫-৪৬)। চলবে... লেখক : পীর সাহেব, দ্বারিয়াপুর শরীফ
×