ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অতঃপর ইলোরা অজন্তা

প্রকাশিত: ১১:০৫, ১৪ জুন ২০১৯

অতঃপর ইলোরা অজন্তা

১৩ থেকে ১৬ ফেব্রুয়ারি এই চারদিন Sun-Sand-Sea এই তিন এস (S বৈভব নিয়ে ১৭ ফেব্রুয়ারি অজন্তা ইলোরা দেখার জন্য গোয়া থেকে রওনা হলাম Taxi তে আওরঙ্গবাদের পথে। আওরঙ্গবাদ মহার্রাস্ট্র রাজ্যের একটি জেলা। মুঘল সাম্রাজ্যের ষ্রস্টতম বংশধর সম্রাট আওরঙ্গজেবের নামানুসারে এই জেলার নামকরণ করা হয়। ১৬৫৩ খ্রিস্টাব্দে আওরঙ্গবাদ রাজধানীর মর্যাদা লাভ করে। প্রায় চৌদ্দ ঘণ্টা একটানা ভ্রমণ করে গোয়া থেকে আওরঙ্গবাদে পৌঁছালাম। ১৮ ফেব্রুয়ারি সকালে বিবি-কা-মোকবারা দেখতে গেলাম। বিবি-কা-মোকবারা সম্রাট আওরঙ্গজেবের পুত্র তাঁর মা অর্থাৎ সম্রাটের স্ত্রী বেগম রাবিয়া দুরানির সমাধি সৌধ নির্মাণ করেন ১৬৭৯ খ্রিস্টাব্দে। এই সমাধি সৌধ তাজ মহলের রিপলিকা অর্থাৎ তাজের অনুকরণে করা হয়েছে। দাক্ষিণাত্যের এই সমাধি সৌধই মুঘল সাম্রাজ্যের একমাত্র স্থাপত্য কারণ সম্রাট আওরঙ্গজেবের সমাধি অন্যান্য মহামতি মুঘলদের সমাধি সৌধের বিশালতা এবং শৈল্পিক স্থাপত্য বিরাজমান তার কোন নিদর্শন সম্রাট আওরঙ্গজেবের সমাধিতে নেই। তিনি কঠোরভাবে ইসলাম ধর্মের অনুশাসন মানতেন তাই তার অছিয়ত মতো অতি সাধারণভাবে যেন তাঁকে সমাধিস্থ করা হয়। ইসলামের বিধানও তাই। ভারতের ভাইসরয় লর্ড কার্জন অবহেলিত আওরঙ্গজেবের সমাধি দেখে বিস্মিত হয়েছিলেন কারণ অন্য মুঘল সম্রাটদের সমাধি সৌধের মতো না হলেও এতটা নিরাভরণ সমাধি তাঁকে ব্যাথিত করেছিল তাই তিনি হায়দ্রাবাদের নিজামকে দিয়ে কবরের চারদিকে দেয়াল দিয়ে সংরক্ষিত করার আদেশ দিলে ছাদবিহীন খোলা আকাশের নিচে দেয়াল দিয়ে ঘেরা রয়েছে। পাশেই তাঁর আধ্যাত্মিক গুরুর মাজার মার্বেল পাথরে তৈরি মুঘল স্থাপত্য পরিলক্ষিত হচ্ছে। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য, সম্রাট আওরঙ্গজেবের পূর্বপুরুষ দক্ষ প্রভাবশালী স¤্রাজ্ঞী নূরজাহান ১৬৪৫ খ্রিস্টাব্দে ১৭ ডিসেম্বর ইন্তেকাল করেন। তাঁর সমাধি লাহোরের শাহাদারা বাগে রয়েছে- সেই সমাধির পাথরে ফার্সিতে লেখা কয়েকটি চরণ কবি সত্যেন্দ্র নাথ দত্তের অনুবাদ- ‘গরিব গোরে দ্বীপ জে¦লো না ফুল দিয়ো না কেউ ভুলে, শামা পোকার না পোড়ে পাখ দাগা না পায় বুলবুলে’ এটা সম্রাজ্ঞীর আবেগ অভিমান অথবা বিলাসিতা হতে পারে কিন্তু সম্রাট আওরঙ্গজেবের কোন অভিমান বিরাগ নয় শুধু ধর্মীয় অনুশাসন। ইলোরা গুহা বিশ্ব ঐতিহ্যের অন্তর্গত। ইলোরার ৩৪টি গুহা তিনটি ধর্মের মহামিল। বৌদ্ধ, হিন্দু এবং জৈন এই তিন ধর্মের সহ অবস্থান। ৩৫০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৭০০ শতাব্দী পর্যন্ত পাহাড় খোদায় করে অথবা কেটে কেটে এই গুহাগুলো তৈীি করা হয়। ১২টি বৌদ্ধ গুহা (৬০০-৮০০ খ্রিস্টাব্দ) ১৭টি হিন্দু গুহা (৬০০-৯০০ খ্রিস্টাব্দ)এবং ৫টি জৈন গুহা ( ৫০০-১০০০ খ্রিস্টাব্দ) নির্মিত হয়েছে। অর্থাৎ ৩৫০ খ্র্রিস্টাব্দ থেকে ১০০০ খ্র্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় ৬৫০ বছর ধরে তিন ধর্মের সৈন্যাসী ভিক্ষু এবং পাথর খোদায়কারী এবং চিত্র শিল্পীরা এই ৩৪টি গুহা তৈরি করেন। বৌদ্ধ গুহা ৩ এবং ৪ অসমাপ্ত বাকি ১,৫,৬,১০,১১ এবং ১২ হিন্দু গুহা ১৩ সাধারণ গুহা । হিন্দু গুহার ভেতর সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো ১৬ নম্বর গুহা। কৈলাশ মন্দির নির্মাণ করতে প্রায় একশ’ বছর লেগেছিল। সম্পূর্ণ মন্দির অখ- একটি পাথর দ্বারা নির্মিত। এই নির্মাণে ২ লাখ টন পাথর ব্যবহৃত হয়েছে। রাবণ তার সর্বশক্তি দিয়ে শিবের গৃহ কৈলাশ পাহাড়কে তুলে ফেলার বা ছুড়ে ফেলার মোটিভ পরিলক্ষিত হয়। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের নির্মিত ইলোরার ১০ নম্বর গুহাকে Prayer Hall বা প্রার্থনা হল বলা হয়। এখানে ১৫ ফুট লম্বা হয়ে বসা অবস্থায় রয়েছেন বৌদ্ধ। এই গুহাকে বিশ্বকর্মা গুহাও বলা হয়ে থাকে। এই গুহায় দোতলা বিশিষ্ট খোলা বৌদ্ধ মন্দির রয়েছে। ৩০-৩৪ এই পাঁচটি জৈন গুহা। কিন্তু খ্রিস্টের জন্মের প্রায় ছ’শ’ বছর আগে জৈন ধর্ম বিস্তার লাভ করে। ৩০ নম্বর গুহাটিকে ১৬ নম্বর গুহার মতো বলে একে ছোট কৈলাশ বলা হয়ে থাকে। এর পিলার বা থাম এবং সিলিং পদ্মফুলের প্রতিকৃতিতে লর্ড মহাবীরকে ঘিরে রেখেছে। ৩২ নম্বর গুহাকে ইন্দ্র সভাকক্ষ বা ইন্দ্রের আইনসভা কক্ষ বলা হয়ে থাকে। খ্র্রিস্টপূর্ব সাত‘শ’ বছর আগে জন্মগ্রহণ করেন জৈন ধর্মের প্রবর্তক লর্ড মহাবীর । এখানে তিনি সিংহের ওপর সিংহাসনে বসে আছেন । পরদিন সকালে অর্থাৎ ১৯ ফেব্রুয়ারি সকালে আওরঙ্গবাদ থেকে Taxi তে রওনা হলাম অজন্তা দেখার জন্য। ১৮১৯ খ্রিস্টাব্দে একদল ব্রিটিশ কর্মকর্তা পশু শিকার করতে নিবিড় জঙ্গলে প্রবেশ করে বগোড়া নদীর অপর পারে গাছের ফাঁক দিয়ে দেখতে পান ওপারে পাহাড়ের গায়ে সারি সারি খিলান আর স্তম্ভ আবিষ্কৃত হলো শিল্পকলার অনুপম সৌকর্য প্রাচীন সভ্যতার বিস্ময়কর স্থাপত্য এবং চিত্রকলার অপরূপ রূপ অজান্তা। বৌদ্ধ ভিক্ষুর তৈরি খ্র্রিস্টপূর্ব ২০০ থেকে ৬৫০ খ্র্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নির্মিত এই ২৫০ ফিট পাহাড়ে পাদদেশে পৌঁছালাম। অজন্তা পাহাড়ের একটু দূরে যানবাহন পার্কিং করতে হয় তারপর সরকারের পরিবেশ বান্ধব বাসে এসে পৌঁছাতে এই ৩০টি গুহা দেখার জন্য। এসব গুহার দেয়াল চিত্র এবং স্কালপচার সবই বৌদ্ধইজম এবং জাতকের গল্পের মোহনীয় চিত্ররূপ। এমনিভাবে বৌদ্ধ ভিক্ষুর দীর্ঘসময় ধরে পাথর খোদায় করে গৌতমবুদ্ধের বিভিন্ন ভঙ্গিমায় বা আসনের স্ট্যাচু বা মূর্তি কিভাবে নির্মাণ করল ভাবতে বিস্ময় লাগে। তখন কোন ক্রেন ছিল না, না ছিল পাহাড় কাটার আধুনিক যন্ত্রপাতি বা ছেনি যার দ্বারা প্রথমে দোতলা নির্মাণ করে তার পর একতলা নির্মাণ করতে পিলার বা স্তম্ভের পর সিলিং অবলীলায় দাঁড়িয়ে আছে। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দী থেকে সপ্তম শতাব্দী পর্যন্ত প্রায় ন’শ’ বছর ধরে গুহা অলংকরণ অর্থাৎ গুহা গাত্রে ছবি আঁকা এবং স্ট্যাচু তৈরি করা হয়। তারপর প্রায় এগারো শ’ বছর ছিল গুহার অজ্ঞাতবাস। ব্রিটিশ রাজ কর্মকর্তারা যখন এই গুহাগুলো আবিষ্কার করবেন তখন প্রায় কুড়িটি গুহার চিত্রগুলো অবিকল-অবিকৃত বাকি গুহার চিত্র কিছুটা বিবর্ণ হয়ে পড়েছে। গুহা ৯, ১০, ১৯, ২৬, ২৯ এই পাঁচটি গুহা চৈত্যগৃহ বাকি পাঁচটি বিহার বা বাসস্থান বা সংঘবাস। বৌদ্ধদের উপাসনালয়কে চৈত্যগৃহ বলা হয় আর থাকার ঘরকে বিহার বলা হয়। এসব গুহার দেয়ালে এবং সিলিং এ আঁকা আছে অসাধারণ ম্যুরাল। অনেকগুলো গুহার বাইরে এবং ভেতরে রয়েছে বৌদ্ধের নানা মুদ্রায় মূর্তি। খ্র্রিস্টপূর্ব দুশ’ বছর পূর্ব থেকে দুশ’ বছর পরে এই চারশ’ বছর ধরে তৈরি হয়েছিল ৮, ৯, ১০, ১২, ১৩, ৩০ এই ছয়টি গুহা বাকিগুলো পরবর্তী সময়ের নির্মিত হয়। বৌদ্ধ ভিক্ষুরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, গভীর ধ্যানের জন্য গৃহাংগনের বাইরে পর্বতের নির্জনতার দরকার তাই তারা এসব উপত্যকায় পৃথিবীর সর্ব আকর্ষণ থেকে নিজেদের গভীর ধ্যানের মগ্ন থাকার জন্য গুহাগুলো নির্মাণ করেন যার স্থাপত্য মান শৈল্পিক মান এতোই সমৃদ্ধ যে ১৬ নম্বর গুহা দেখে বিস্মিত হতে হয়। এই গুহার বাম পাশের দেয়াল চিত্র পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ চিত্রকলা হিসেবে বিবেচিত হয়। এখানে আসন গেঁড়ে বসে গৌতম বুদ্ধ অনুসারীদের শিক্ষা দান করছেন। আর মৃত্যু পথযাত্রী রাজকুমারী তার স্বামী বুদ্ধের জ্ঞাতি ভ্রাতা নন্দ বৌদ্ধ ভিক্ষুর দীক্ষা গ্রহণ করার সংবাদে দগ্ধ হচ্ছেন- এই দেয়াল চিত্রের অপরূপ রূপ বর্ণনা করার মতো শব্দ আমার জানা নেই শুধু চোখ এবং চিত্ত দিয়ে কিছুটা দেখা বা অনুভব করা যায় মাত্র। অজন্তার চিত্রকলা ম্যুরাল বা দেয়াল চিত্র এবং মূর্তি বা ট্যাটু না দেখলে অনুধাবন করা যাবে না যে সে সব বৌদ্ধ ভিক্ষুরা কত বড় শিল্পী ও স্থাপত্যকলার পন্ডিত ছিলেন। গোয়া আওরঙ্গবাদ ইলোরা এবং অজন্তা বেড়ানো শেষে ১৯ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে মহারাষ্ট্রের রাজধানী ভারতের বাণিজ্য-অর্থনীতি রাজধানী এবং হিন্দী সিনেমার বিনোদন কেন্দ্র সেদিনের বোম্বে আজকের মুম্বাই কুড়ি ঘণ্টার যাত্রা বিরতি। এই বিরতিটুকু মুম্বাই দেখার জন্য ব্যয় করার আগ্রাহ আমার প্রবল যদিও আরও আগে একবার মুম্বাই এসে গেছি। সেই সময় হাজি আলি মাজার জেয়ারত আর The Gate way of India দেখা হলেও এবার মেরিন ড্রাইভিং এর পাশাপাশি জুহু সমুদ্র সৈকতের পাশে অমিতাভ বচ্চনের বাড়ি প্রতীক্ষা (Pratiksha)। শাহরুখ খানের বাড়ি মান্দা সাগর সৈকতে মান্নাত (Mannat) দেখে আজকের ধনকুবের মুকেশ আম্মানির বাড়ি আন্তোলিয়া (Antellia) Altamount Road South Mumbai দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না। আরব সাগরের কুইজ করার তাগিদে The Cate way of India থেকে এক ঘণ্টার Steamar Ride করলাম আরব সাগরে। তারপর বাইরে থেকে সেদিনের ভিক্টোরিয়া টার্মিনান্স আজকের ছত্রপতি শিবাজি টার্মিনান্স এশিয়াটিক সোসাইটি দি বোম্বে স্টক একচেঞ্জ এ্যান্ড ন্যাশনাল স্টক একচেঞ্জ রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া দেখে হোটেল তাজে বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে কুড়ি ঘণ্টার বিরতি শেষে করে ছত্রপতি শিবাজি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উদ্দেশে যাত্রা এবারও আমার এ্যালিফ্যান্ট দেখা হলো না।
×