ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আলী যাকের

মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!

প্রকাশিত: ১১:৩৮, ১৪ জুন ২০১৯

   মধ্যাহ্ন, অপরাহ্ণ!

পর্ব-৩৩ সকাল সাড়ে নয়টা। কারেন আমাদের নিয়ে পূর্ব জার্মানির বিদেশ মন্ত্রণালয়ে পৌঁছল। যথারীতি শুভেচ্ছা বিনিময় হলো। এখানে নতুন একটি বাক্য শিখলাম, ’বাংলাদেশ-জার্মান গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের বন্ধুত্ব দীর্ঘজীবী হোক’ যেটি প্রতিদিনই ব্যবহার করতে হয়েছে আমাকে, বিভিন্ন দফতরে। আমাদের সাক্ষাতের প্রথমেই ঐ দফতরের অধিকর্তা আমাদের জিজ্ঞেস করলেন, ফেস্টিভ্যালে অংশগ্রহণ করা ছাড়া তোমরা আর কে কী করতে চাও? জবাবে আমি প্রথমেই বললাম যে, আমার মাল্টিপল্ এন্ট্রি ভিসা লাগবে। বলেই মনে হলো এইটা তো কমিউনিস্ট দেশ, কী জানি এরা কীভাবে নেয় এই কথাটা? ভদ্রলোক একটু চিন্তা করে আমাকে বললেন, পাসপোর্ট এনেছো? আমার জ্যাকেটের বুক পকেট থেকে পাসপোর্ট বের করে তাকে দিলাম। তিনি বললেন, তোমার দোভাষী কালকে তোমাকে পাসপোর্টটি পৌঁছে দেবে। মনে হলো আমার আবেদন গ্রহণ করা হবে। ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। এরপরে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পরবর্তী সাক্ষাৎ। এখানেও সেই ’এস লিবে বাংলাদেশ-ডিডিআর সলিডারিটেট’। প্রথমে আমাদের একটি সভাকক্ষে বসিয়ে পূর্ব জার্মানির সংস্কৃতি এবং সংস্কৃতি-ঋগ্ধ সকল জায়গার ছবির বর্ণনা দিলেন এক সুন্দরী রমণী। বুঝতে পারলাম যে, পূর্ব জার্মানিতে থাকার সময়ে বার্লিন ছাড়াও বেশ কিছু শহর আমাদের ঘোরানো হবে। যেমন ভাইমার, পট্স্ডাম, র্এফুর্ট, লাইপযিগ ইত্যাদি। পরে জেনেছি যে, এর প্রত্যেকটি সংস্কৃতিগত এবং ঐতিহাসিক মূল্যায়নে পূর্ব জার্মানির অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। এই সভা শেষে কারেন আমাদের বলল যে, তোমাদের রাস্তার খাবার খাওয়াব আজ। তখন দুপুর দুটো। খিদেয় পেট চনমন করছে। ও আমাদের নিয়ে পথের পাশের একটি পার্কে খোলা কিছু খাবারের দোকানে হাজির হলো। এ গুলো দেখতে অনেকটা আমাদের দেশের ফুচ্কা বা চটপটির দোকানের মতো। এরা দিব্যি টোস্ট করা বনরুটি এবং তার মাঝে ভাজা সসেজ বিক্রি করছে। কারেন ওদেরকে জার্মান ভাষায় বললো, ‘সোয়াই রিন্ডা ফ্লাইশ উন্ড আইন সোয়াইনে ফ্লাইশ’। অর্থাৎ দুটি গরুর মাংসের এবং একটি শুকরের মাংসের। এই একটি কারেণের জন্য। আমি আর স্যার দুটো করে গরুর মাংসের সসেজের জার্মান হটডগ খেয়ে উদরপূর্তি করে ঢেঁকুর তুললাম। এই হটডগের বিশেষত্ব ছিল এক ধরনের সর্ষে-বাটার সস, যা অনেকটা আমাদের কাসুন্দির মতো খেতে। এরপর কারেনের নেতৃত্বে আমরা হাঁটতে শুরু করলাম ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের দিকে। সেখান থেকে যাব বার্লিনের স্টেট অপেরা হাউজ-এ। সেই ১৯৭৪-এ একজন কাঁচা বয়সী নাট্য নির্দেশক এবং অভিনেতার ইউরোপে নাট্যদর্শন আমাকে, বলাই বাহুল্য, বিভিন্নভাবে অনুপ্রাণিত করে। যে তিন/চার সপ্তাহ আমি পূর্ব জার্মানিতে ছিলাম, সেই সময় বিশ্বের কিছু প্রধান নাট্যমঞ্চ এ আমি অবিরত নাটক দেখেছি, নাট্য কর্মশালায় যোগ দিয়েছি এবং প্রখ্যাত সব নাট্য নির্দেশকের সঙ্গে পরিচিত হবার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। এসবেরই শুরু বার্লিনের দ্বিতীয় সন্ধ্যায় স্টেট অপেরা হাউজে অপেরা দেখার অভিজ্ঞতা দিয়ে। এই সুবিশাল ভবনটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কোর্ট অপেরা হিসেবে। অর্থাৎ রাজ-নাট্যশালা হিসেবে। সেটা ১৭৪২ খ্রিস্টাব্দে। এর প্রথম নামকরণ ছিল ‘রয়েল অপেরা হাউস’। পরবর্তীতে এর নামকরণ করা হয় ’স্টেট অপেরা হাউস’। ১৯৪৯ থেকে ১৯৯০ পর্যন্ত এই ইমারতটি সেই নামেই পরিচিত ছিল। আমি নিশ্চিত, বিভক্ত জার্মানি এক হয়ে গেলে নিশ্চয়ই রাষ্ট্রীয় অপেরা ভবন অন্য কোথাও স্থানান্তরিত হয়। ১৯৭৪ সালে আমি যখন এখানে অপেরা দেখতে যাই তখন এর রবরবা অবস্থা। যেই নাট্যরীতি এরা তখন অনুসরণ করতেন তা ’বারোক্ থিয়েটার’ হিসেবে আজ পরিচিত। ’৯০-এর দশকে এই নাট্যশালার নতুন নামকরণ করা হয় ’স্টাট্সওপার উন্টার ডেন লিন্ডেন’। উন্টার ডেন লিন্ডেন-এর সহজ অর্থ হলো ‘লাইম গাছের তলায়’। আমাদের ভাষায় ‘লেবুতলায়’। নামটি ভারি সুন্দর। সেই সন্ধ্যার পরেও আমি একাধিকবার বার্লিন শহরে হাঁটতে হাঁটতে এই লেবুতলায় এসেছি। সারিবদ্ধভাবে এই লাইম গাছগুলো তখন রাস্তার মাঝখানের সড়কদ্বীপে লাগানো ছিল। অবশ্য লেবু দেখতে পাওয়া যেত না। তবে একবার একটা পাতা নিয়ে ঘষে দেখেছিলাম গন্ধটি ঠিক আমাদের লেবুপাতার মতোই। সেই সন্ধ্যায় ঠিক কোন অপেরাটি দেখেছিলাম তা মনে করতে পারছি না। তবে বিশ্ববিখ্যাত প্রতীচিও ধ্রুপদী সঙ্গীতজ্ঞ ভার্গ্না-এর কোন একটি অপেরা হবে বলে মনে পড়ছে। হলটির ধারণ ক্ষমতা ছিল ১৩০০। তিন স্তরে দর্শকদের বসবার জায়গা। কিন্তু আমি হলের প্রায় প্রতিটি কোণায় গিয়ে গিয়ে কণ্ঠস্বর পরিষ্কার শুনতে পেয়েছি। ভাবতে অবাক লাগে যে, সেই সাড়ে তিনশ’ বছর আগের হলো অথচ এর এ্যাকুস্টিক এত নিখুঁত! ১৮৪৩ সালে এই হলটিতে অগ্নিকা- ঘটে এবং সম্পূর্ণরূপে ভস্মীভূত হয়ে যায়। এর পরে আরও একবার হয়েছিল ’৫০-এর দশকের শুরুতে। তবে ’৭৪-এ যখন আমি এখানে যাই, তখন সেইসব ধ্বংসের কোন চিহ্ন অবশিষ্ট ছিল না। অপেরা দেখার পর মুস্তাফা নরূ-উর ইসলাম স্যারকে হোটেলে পৌঁছে দিয়ে আমি ক্যারেনকে বললাম, চল তোমার সঙ্গে গল্প করা যাক। আমরা দু-জনে হাঁটতে হাঁটতে হোটেলের কাছেই একটা ছোট রেস্তোরাঁয় ঢুকলাম। এবং খাবারের অর্ডার দিয়ে গল্প করতে শুরু করলাম। ক্যারেনের স্বামী তখন রেলওয়েতে ইঞ্জিনিয়ারের কাজ করত। ওদের কোন সন্তান সন্ততি ছিল না। দু’জনের আয়ে একটি ছোট ফ্ল্যাটে ওরা থাকত। কথায় কথায় জানলাম যে, পূর্ব জার্মানির সরকার একটি উদ্যোগ নিয়েছে, জার্মানির পুরনো সব বাড়িঘরগুলোকে মেরামত করে সেখানে সেন্ট্রাল হিটিং এর ব্যবস্থা করার। সেই অক্টোবর মাসেই বুঝতে পারছিলাম এদেশের শীত কত তীব্র হয়। ক্যারেন বলল, এখন পূর্ব জার্মানির অধিকাংশ বাড়িই কেন্দ্রীয় উষ্ণনায়নের আওতায় আনা হয়েছে। জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, সপ্তাহে একদিন, রবিবার, ক্যারেনের ছুটির দিন। তবে কোন বিশেষ ব্যক্তির আগমনে যদি দরকার পড়ে তাহলে দোভাষী হিসেবে তাঁর রবিবারের ছুটি কাটা যায়। সপ্তাহের ছুটি যেদিন পায় সেদিন সে বার্লিনের অদূরে তার দাদীর বাড়িতে বেড়াতে যায়। অশীতিপর বৃদ্ধা, তার দাদী গ্রামের বাড়িতে একা থাকেন। সেই কারণে সপ্তাহের কোন না কোন দিন তাঁর নাতি অথবা নাতনিরা তাঁর কাছে গিয়ে থাকে। উন্নত বিশ্বের কোন সমাজে এ বিষয়টি তেমন দেখা যায় না। প্রত্যেকেই নিজের কাজ নিয়ে ব্যতিব্যস্ত। সময় কোথায় তাদের বৃদ্ধ আত্মীয়স্বজনের দেখাশোনা করার? বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বয়োবৃদ্ধদের বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আমি নানারকম প্রশ্ন করে পূর্ব জার্মানির এই ভিন্ন ব্যবস্থার কারণ জানার চেষ্টা করলাম। যা বেরিয়ে এলো তা হলো, সমাজতান্ত্রিক বিশ্বে যেহেতু পুঁজিই সকল সম্পর্কের নিয়ামক নয়, সেহেতু মানবিক মূল্যবোধগুলোকে এখানে উৎসাহ দেওয়া হয়ে থাকে। আমি আগে কোথাও লিখেছিলাম, পশ্চিমাদের কল্যাণে আমরা এই কথা জানতে জানতে বড় হই যে, কমিউনিস্টরা দিনরাত ধরে ধরে মানুষ খায়। এরা যে মানুষখেকো নয়, সেই বিষয়টি সম্বন্ধে আমি নিশ্চিত হয়েছি স্বয়ং একটি কমিউনিস্ট দেশে ভ্রমণ করার অভিজ্ঞতার মাধ্যমে।
×