ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

কবিতার নির্মল জলে অবাধ সাঁতার

প্রকাশিত: ১১:৪১, ১৪ জুন ২০১৯

কবিতার নির্মল জলে অবাধ সাঁতার

নির্মলেন্দু গুণ ষাটের দশকের অগ্নিঝলসিত কবি। তাঁর কবিতা দ্রোহের আগুনে দ্যুতিময়। নির্মলেন্দু গুণের কবিতার মুখ্য গুণ জ্বলে ওঠা প্রতিবাদে প্রকম্পিত করে দেয়া। তাঁর কবিতা সোচ্চার ধর্মীয়। তাঁর চৈতন্যের প্রবাহে অবনত হয় সমস্ত অশুভতা। মুক্তিযুদ্ধের নানা ঐতিহাসিক ঘটনা তিনি কবিতায় লিপিবদ্ধ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধকে মূল প্রতিপাদ্য করে নির্মলেন্দু গুণ অসংখ্য কবিতার মাধ্যমে মানুষকে সংগঠিত করেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জীবিত করেছেন, প্রেরণা যুগিয়েছেন। তিনি তাঁর দায়িত্ব বোধের জায়গায় অনড় থেকে তাঁর সৃষ্টি কর্মের ধারাক্রমে নিজেকে প্রতিভাসিত করেছেন। ষাটের দশকের নানা অনুষঙ্গকে তিনি তার কাব্য প্রবণতায় ধাবণ করেছেন বিভিন্নভাবে। দুর্বার উচ্চারণের মধ্য দিয়ে তিনি আবেগময় অভিব্যক্তির প্রকাশ ঘটিয়েছেন। মানুষের দুঃখ সুখকে রূপায়িত হয়েছে তার কবিতায়। মুক্তিযুদ্ধের নানা ছবি নির্মলেন্দু গুণের কবিতায় নিপুণভাবে ফুটে ওঠে। নির্মলেন্দু গুণের কবিতায় বিষয় আশয়ের নানা মাত্রিক বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। স্বদেশ চেতনা, মুক্তিযুদ্ধ, নিসর্গের নিবিড়তা, নারীপ্রেম, শ্রেণী সংগ্রাম, স্বৈরাচার বিরোধিতা, দ্রোহ প্রভৃতি বিষয়কে তিনি তার কবিতায় প্রয়োগ করেন। কবিতার পাশাপাশি তিনি গদ্য এবং ভ্রমণকাহিনীও লিখেছেন। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই’ প্রকাশিত হওয়ার পর গ্রন্থটি পাঠকপ্রিয়তা পায়। এ গ্রন্থের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে লেখা হুলিয়া কবিতাটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং পরবর্তীতে এর ওপর ভিত্তি করে তানভীর মোকাম্মেল একটি পরীক্ষামূলক চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। এ ছাড়াও তাঁর স্বাধীনতা, এই শব্দটি কীভাবে আমাদের হলো কবিতাটি বাংলাদেশের মাধ্যমিক পর্যায়ের পাঠ্যপুস্তকে পাঠ্য। তিনি ১৯৮২ সালে বাংলা একাডেমি, ২০০১ সালে একুশে পদক এবং ২০১৬ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার অর্জন করেন। খ্যাতিমান কবি নির্মলেন্দু গুণ তাঁর মনোজগতে নিহিত নানা অনুভূতি অবধারিতভাবে উপজীব্য বিষয় আশয়ের হাত ধরে তাঁর কবিতার গহীনে প্রবেশ করে। নিরীক্ষায় প্রবণতা তাঁর কাব্য বিকাশকে চলমান করে। নতুন ভিন্নতাকে তিনি রচনাশৈলীর ভিন্নতায় আলাদা, নবতর অবয়ব কবিতায় স্থাপন করেন। নির্মলেন্দু গুণ আমাদের গৌরবময় ঐতিহ্যের কথা নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য নিরন্তর নিবেদিত। তাঁর কবিতায় নানা আন্দোলন সংগ্রামের ঘটনাবলী চিত্রিত হয়। নির্মলেন্দু গুণের কবিতা মিছিল প্রতিবাদ প্রতিবোধ স্লোগানের বাণীতে মুখরিত। অন্যায় শোষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে তাঁর অবস্থান স্পষ্ট, তাঁর কণ্ঠ উচ্চকিত। তাঁর উচ্চারণ সংক্ষুব্ধ। ‘আগুন লেগেছে রক্তে মাটির গ্লোবে যুবক গ্রীষ্ম ফালগুন পলাতক পলিমাখা চাঁদ মিছিলে চন্দ্রহার। উদ্ধত পথে উন্নত হাত ডাকে সূর্য ভেদে অশ্লীল কারাগার প্রতীক সূর্যে ব্যাকুল অগ্নি জ্বলে সাম্যবাদের গর্বিত কোলাহলে।’ ব্যক্তিগত স্বার্থের উর্ধে থেকে তিনি গণমানুষের অধিকার আদায়ের জন্য সক্রিয় থেকেছেন। অধিকার বিপন্ন হতে দেখে তাঁর কবিতা তুমুল প্রতিবাদে স্লোগানমুখর হয়ে ওঠে। সমাজতান্ত্রিক ভাবনা তাঁর কবিতায় নানাভাবে উঠে আসে। তাঁর চেতনার সঙ্গে যুক্ত হয় সমাজতন্ত্র। আমাদের ঐতিহ্য তাঁকে সাহসী করে। ঐতিহ্যিক চেতনা তাঁর লেখাকে শক্তিময় করে। আদর্শিক পিতার নির্মম মৃত্যু দেখে যখন বাংলাদেশ নির্বাক হয়ে গিয়েছিলো, বাঙালী প্রতিবাদী কণ্ঠ মূক হয়েছিল। তখন গুণের কবিতা প্রতিবাদ, আবেগ, আর শোকের মিশ্ররূপে ফেটে পড়েছিল। সেই রাত্রির কল্পকাহিনী’ শীর্ষক কবিতার উদ্ধৃতি দেয়া যেতে পারে। ‘তোমার ছেলেরা মরে গেছে প্রতিরোধের প্রথম পর্যায়ে তারপর গেছে তোমার পুত্রবধূদের হাতের মেহেদী রং তারপর তোমার জন্ম সহোদর ভাই শেখ নাসের তারপর গেছেন তোমার প্রিয়তমা বাল্যবিবাহিতা পত্নী আমাদের নির্যাতিতা মা। এরই ফাঁকে এক সময় ঝরে গেছে তোমার বাড়ির সেই গরবিনী কাজের মেয়েটি, বকুল। এরই ফাঁকে একসময় প্রতিবাদে দেয়াল থেকে খসে পড়েছে রবীন্দ্রনাথের দরবেশ মার্কা ছবি। এরই ফাঁকে এক সময় সংবিধানের পাতা থেকে মুছে গেছে দুটি স্তম্ভধর্ম নিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র।’ নির্মলেন্দু গুণের কবিতা বাংলাদেশের ইতিহাসের সত্যবদ্ধ দলিল হিসেবে বিবেচিত হতে দেখা যায়। তাঁর কবিতায় ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহ, নানা ধরনের রাজনৈতিক টানাপোড়েন, সঙ্কট উত্তরণের উচ্ছ্বাস এসব চিত্রের পাশাপাশি একটা অপার জীবন, মুক্ত জীবনবোধ তাঁর কবিতাকে আচ্ছন্ন করে। তিনি মুক্ত জীবন সন্ধানী হতে ব্রতী হন। ষাটের দশকের দোর্দাণ্ড উন্মাদনা স্বাধীনতাউত্তর বিভিন্ন নির্মমতা এবং গৌরব গাথা বিবরণ তিনি কবিতাবদ্ধ করেছেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার সেই কালরাতের পটভূমির অবতারণা তিনি করেছেন। বর্বরোচিত নির্মম ও নিন্দিত এ ঘটনা যেমন তাঁর কবিতায় উঠে এসেছে। তেমনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় অর্জন তিনি তাঁর কবিতায় তুলে ধরেছেন। নির্মলেন্দু গুণের বেশিরভাগ কবিতায় অত্যাধুনিক দৃষ্টান্তবাদিতা পরিলক্ষিত। আবেগ-অনুুভূতি সংলগ্ন তার নারীপ্রেম কবিতায় উঠে আসে । তিনি কবিতায় দেশপ্রেমের বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। ’৬৬-এর ছয় দফা আন্দোলনের সঙ্গে আত্মিকভাবে জড়িত ছিলেন তিনি। এরপর বাদ পড়েনি স্বাধীনতার পূর্বের ও পরের কোন বিপর্যয়, যতবার এ রাষ্ট্র বিপথগামী হয়েছে- কলম ধরেছেন তিনি। লিখেছেন একের পর এক শ্রেণীসংগ্রাম এবং স্বৈরাচারবিরোধী কবিতা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবারে নিহত হওয়ার পর তাঁকে নিয়ে প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিবেশে যে ক’জন কবি ও লেখক সোচ্চার হয়েছেন, তিনি ছিলেন অগ্রগণ্য। তিনি অসহায় মেহনতী, দরিদ্র মানুষের কথা বলেছেন। নির্মলেন্দু গুণের অতিমানবীয় গুণাবলী তাঁর বয়নশৈলীর মাধ্যমে কবিতায় প্রযুক্ত হয়েছে। ‘নেকাব্বর জানে তার সম্পত্তির হিসাব চাইতে আসবে না কেউ কোনদিন। এই জন্মে শুধু একবার চেয়েছিল একজন কী কইরা পালবা আমারে, তোমার কি আছে কিছু তেনা? সন্ধ্যায় নদীর ঘাটে ফাতেমাকে জড়িয়ে দু’হাতে বুকে পিষে নেকাব্বর বলেছিল : আছে আছে লোহার চাক্কার মতো। দুই আত, গতরে আত্তীর বল : আর কিডা চাষ মাগী। তুমি বুঝি খাবা কলা গাছ? আজ এই গোধূলি বেলায় প্রচণ্ড ক্ষুধার জ্বালা চোখে নিয়ে নেকাব্বর সহসা তাকাল ফিরে সেই কলাবাগানের গাঢ় অন্ধকারে তিরিশ বছর পরে আজ বুঝি সত্য হলো ফাতেমার মিষ্টি উপহাস।’ নির্মলেন্দু গুণ শ্রমজীবী মানুষের অর্থাভাব অসহায়ত্ব তাদের মধ্যে জাগরুক প্রেমের অনুভূতির আনন্দ বিষাদের কথকতা কবিতায় অন্তর্ভুক্ত করেন। দারিদ্র্যের যাঁতাকলে বিপর্যস্ত মানুষের আবেগ তিনি কবিতায় তুলে ধরেন। নির্মলেন্দু গুণ শুদ্ধ কবিতার শ্রষ্টা হিসাবে সমধিক খ্যাতিমান। ষাটের দশকে তিনি কবিতার একটি নতুন ধারার দ্বার উন্মুক্ত করেন। তাঁর বয়নশৈলী, বর্ণনার কাব্যিকতা তাঁর কবিতায় নতুন মাত্রা সংযোজন করেছে। স্কুলের ছাত্রাবস্থায় কবিতার সঙ্গে তাঁর সখ্য গড়ে ওঠে পরবর্তী সময়ে কবিতার সঙ্গে তার নিবিড় ঘরগেরস্থালি সূচিত হয়। খালেকদাদ চৌধুরী সম্পাদিত উত্তর আকাশ পত্রিকায় নির্মলেন্দু গুণের প্রথম কবিতা প্রাকাশিত হয়। প্রথম কবিতার উজ্জ্বলতা পাঠকদের দৃষ্টি কেড়ে নেয়। তারপর থেকে নির্মলেন্দু গুণের অবাধ যাত্রা। কবিতাকে আরাধ্য করে নির্মলেন্দু গুণ তাঁর যাত্রাপথকে উদ্ভাসিত করেছেন। নেত্রকোনা কলেজ বার্ষিকী ময়ুখ-এ তাঁর বেশকিছু কবিতা সমালোচকদের আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। ১৯৬২তে নতুন কাণ্ডারী, ওই আকাশের নিচে শীর্ষক কবিতা তাঁর পরিচিতি বাড়িয়ে দেয়। তিনি তাঁর কবিতা চর্চা অব্যাহত রাখেন। তাঁর নতুন ভাবনার দিগন্ত উন্মোতি হয়। দৈনিক আজাদ, দৈনিক সংবাদ, মাসিক মহম্মদী, পত্রিকায় গুণের কবিতা প্রকাশিত হতে থাকে। নির্মলেন্দু গুণ তাঁর রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি সাবলীল বর্ণনা বিন্যাসে কবিতায় তুলে ধরেন। তাঁর এ ধরনের কবিতা সুধী মহলে প্রশংসিত হয়। নির্মলেন্দু গুণ সম্পাদনা করেন একটি সাহিত্য পত্রিকা। এ পত্রিকাটি সে সময়কার কবি সাহিত্যিকদের মাঝে সাড়া জাগায়। নির্মলেন্দু গুণ তাঁর কবিতার সাহসী উচ্চারণ দিয়ে দুঃশাসন দূর করতে প্রত্যয়ী থেকেছেন। চরম সঙ্কটাপন্ন অবস্থা থেকে উত্তরণের উদ্যোগ তার কবিতায় পাওয়া যায়। গুণের অভিষেক ঘটে সৃষ্টি প্রলয়ের মধ্য দিয়ে। তিনি ১৯৬৭ সালে কণ্ঠস্বর পত্রিকায় ব্যবস্থাপক হিসাবে নিযুক্ত হন। দুই মাসের অভিজ্ঞতার কবিতা রচনায় প্রাণ শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়ে ওঠে। এ সময় বিজ্ঞাপন সংগ্রহ, অর্থ আদায়ের মতো বিচিত্র কর্মপ্রবাহের মাঝে সাহিত্যে তাঁর প্রবল আগ্রহ আমরা দেখতে পেয়েছি। নানা ধরনের অভিজ্ঞতা তাঁর কাব্যচর্চাকে শক্তিময় করেছে। নির্মলেন্দু গুণ আবির্ভাবের আদি থেকে সপ্রতিভ হিসেবে চলমান থেকেছেন। তাঁর কবিতায় নন্দন তত্ত্বের পাশাপাশি বিক্ষোভ বিদ্ধতা লক্ষ্য করা যায়। তিনি সংক্ষুব্ধ হয়ে যান সচেতনভাবেই। তাঁর কবিতায় নিপীড়িতের হাহাকার মর্মরিত হয়। তিনি বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। তাঁর কবিতা হৃদয়গ্রাহী হয়ে ওঠে এ সময় আবুল হাসানের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব তৈরি হয়। পিপল পত্রিকায় নির্মলেন্দু গুণ কিছুদিন সাংবাদিকতা করেন। দৈনিক পাকিস্তান, দৈনিক আজাদ পত্রিকায় তিনি নিয়মিত লিখতে থাকেন। ১৯৭০-এর জুলাই মাসে জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রে তিনি হুলিয়া, শীর্ষক কবিতা পাঠ করেন। এই বিখ্যাত কবিতার মধ্যে গোটা জাতির দুঃখ-দুর্দশা ও স্বপ্নের বৃত্তান্ত ফুটে উঠেছে। গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট আয়ুবীয় দুঃশাসন, বাঙালীর অগ্রসরতা, একটি স্বপ্নবিন্দুকে ছোঁয়ার সংগ্রামকে তিনি এই কবিতায় বর্ণনায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন। উদ্ধৃতি দেয়া যেতে পারে। ‘আমি যখন বাড়িতে পৌঁছলাম তখন দুপুর চতুর্দিকে চিকচিক করছে রোদ্দুর- আমার শরীরের ছায়া ঘুরতে ঘুরতে ছায়াহীন একটি রেখায় এসে দাঁড়িয়েছে। কেউ চিনতে পারেনি আমাকে। ট্রেনে সিগারেট জ্বালাতে গিয়ে একজনের কাছ থেকে আগুন চেয়ে নিয়েছিলুম একজন মহকুমা স্টেশনে উঠেই আমাকে জাপটে ধরতে চেয়েছিল একজন পেছন থেকে কাঁধে হাত রেখে চিৎকার করে উঠেছিল। আমি সবাইকে মানুষের শামিল চেহারার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছি। খবর পেয়ে যশমাধব থেকে আসবে ন্যাপ কর্মী ইয়াসিন তিন মাইল বৃষ্টির পথ হেঁটে রসুলপুর থেকে আসবে আদিত্য ওরা প্রত্যেকেই জিজ্ঞেস করবে ঢাকার খবর আমাদের ভবিষ্যত কী? আইয়ুব খান এখন কোথায়? শেখ মুজিব কি ভুল করছেন? আমাদের নামে কতদিন এরকম হুলিয়া ঝুলবে?’ এই কবিতায় মুক্তিযুদ্ধের পূর্বকালের সঙ্কটাপন্ন অবস্থা বিপর্যস্ত বাঙালী জাতির মুক্তির আকাক্সক্ষা অনিবার্যভাবে ধারাবাহিক বিবরণীর মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়েছে। নির্মলেন্দু গুণের প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘প্রেমাংশুর রক্ত চাই, প্রকাশিত হয় ১৯৭০ সালে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে তিনি নিয়মিত কথিকা পাঠে অংশ নেন। স্বাধীনতাউত্তরকালে তিনি দৈনিক গণকণ্ঠ পত্রিকায় যোগ দেন। মতপার্থক্য হওয়ায় তিনি আবার সংবাদে ফিরে আসেন। ১৯৭২ সালে প্রকাশিত হয় নির্মলেন্দু গুণের কাব্যগ্রন্থ না প্রেমিক না বিপ্লবী। এখন তাঁর অসংখ্য কাব্যগ্রন্থ পাঠক মহলে সমাদৃত। নির্মলেন্দু গুণ প্রচলিত প্রথার বাইরে থেকে সাহিত্য করেছেন। তাঁর স্বনির্মিত সীমানায় পরিণত আলোর পথে তিনি হেঁটে যাচ্ছেন। তিনি আত্মস্বার্থ বিসর্জিত রাজনীতির একটি শুদ্ধ পরিমণ্ডল প্রত্যাশা করেন। আদর্শের রাজনীতির চাকা তিনি চলমান দেখতে চান। স্বার্থপরতা নয়, গণমানুষের স্বার্থ আদায়ের লড়াইয়ে নির্মলেন্দু গুণ লড়াকু ভূমিকা পালন করেন। তাঁর রাজনৈতিক ভাবনা হৃদয়চেরা বিশ্লেষণে শিল্পমণ্ডিত উপস্থাপনায় কবিতায় বন্দী হয়। প্রেমের কবিতার ক্ষেত্রেও গুণ অনন্য। স্বমহিমায় ভাস্বর। উজ্জ্বল তাঁর উপস্থিতি। ভালবাসার বাণীতে বর্ণিল তাঁর প্রেমের ভুবন। প্রেমের অমোঘ অনুভব তাঁর কবিতায় অনুরিত হয়। আবেগময় প্রেমের উপলব্ধি ভালবাসার উচ্ছ্বাস তাঁর কবিতায় নানাভাবে ঘুরে ফিরে আসে। কবিতা আবর্তিত হয় রাজনীতি কিংবা আদর্শকে কেন্দ্র করে। তোমাকে নিশ্চয়ই একদিন আমি কিনে দিতে পারব এক সেট সোনার গহনা, নিদেন পক্ষে নাকের নোলক একখানা তোমাকে নিশ্চয়ই একদিন আমি কিনে দিতে পারব একটি আশ্চর্য সুন্দর ইজিপ্সিয়ান কার্পেট। মখমল নীল শাড়ি পরে তুমি ভেসে বেড়াবে সারা ঘরময় রাজহাস। কিন্তু তার আগে চাই সমাজতন্ত্র। নির্মলেন্দু গুণের অগ্নিময় কবিতার জগত এদেশের গৌরবময় ঐতিহ্য। তাঁর তেজোদীপ্ত কবিতা রাজনৈতিক এবং মানবিক বিপর্যয় রোধে কার্যকরী। এ দেশের যাবতীয় সঙ্কট মোকাবেলার শক্তি গুণের কবিতায় পাওয়া যায়। তাঁর মোহন সৃষ্টি কর্ম আমাদের সাহিত্যের অগ্রসরতা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। বিশ্বপরিমণ্ডলে আমাদের পরিচিত করিয়ে দেয়। এই কবি দুঃসময় পেরিয়ে এগিয়ে যায় আপন আলোয় উদ্ভাসিত পথে। বাংলাদেশের হাত ধরে। বিরলপ্রজ কবি নির্মলেন্দু গুণের দীর্ঘায়ু কামনা করি।
×