ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

মীম মিজান

পলায়নপর জীবনের আখ্যান

প্রকাশিত: ১১:৪১, ১৪ জুন ২০১৯

 পলায়নপর জীবনের আখ্যান

আমরা সবাই পলায়নের উপরেই আছি। কেউবা দেশ-জাতির কাছ থেকে। কেউ কেউ প্রেমাস্পদ বা অঙ্গিকারভুক্ত কোন মানুষ থেকে। কেউ দারিদ্র্য থেকে মেকি ঢনাঢ্য মরীচিকার দিকে। কেউবা প্রাসাদ ছেড়ে দু’দণ্ড শান্তির জন্য জীর্ণ নীড়ে। কেউ ঠকিয়ে পালাই। কেউ ঠকাতে পারব না বলে পালাই। আর কতটুকু পথ গেলে সাঙ্গ হবে আমাদের এই পলায়ন পর্ব? কত সময় অতিক্রম হলে? পলায়নই কি সমাধান? মানুষ নিরুপায় হলে তো এই পলায়ন ছাড়া কি কোন গত্যন্তর থাকে? আষ্টেপৃষ্ঠে যেভাবে জড়িয়ে আছে আবডালি বুর্জোয়া। হায়েনার মতো খুবলে খাবার জন্য ওঁৎ পেতে থাকে নারীলোভী। রাজনীতির লেবাস পরিহিত সমাজের নরপিশাচ। তাদেরই লেজুড়বৃত্তি করে কায়েম করেছে ভাগাড় সমাজ। সেখানে নিজেকে বাঁচাতে, করতে রক্ষা পথ একটাই। তা হচ্ছে চোখ বন্ধ করে থাকা। বধির হওয়া। আর সবছেড়ে দূরে কোথাও পারি জমানো। উপরোক্ত কথাকলি হচ্ছে ‘পলায়ন পর্ব’ নামক উপন্যাসের সারাৎসার। ঔপন্যাসিক, গল্পকার, কবি, সাংবাদিক ও নির্মাতা মাহবুব আজীজের তৃতীয় উপন্যাস ‘পলায়ন পর্ব’। যাতে ঢাকা ও ময়মনসিংহ অঞ্চলের বদিহাটি এলাকার নানা ঘটনা আবর্তিত হয়েছে। মূলত ঔপন্যাসিক তার গ্রামীণ এলাকা ঘিরে গল্প বুনতে ও বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। উপন্যাসের ভাইটাল ক্যারেক্টার রঞ্জু। যে নিজের গল্প বলে যাচ্ছে পাঠককে। সে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। সাম্যবাদী রাজনীতি তার পছন্দের। তাই মননদা নামক একজন নেতার হাত ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সাম্যবাদী চিন্তার পাঠ দিতে থাকে। যদিও ছাত্রজীবন শেষে এই বিপ্লবী মানসগুলো নিষ্প্রভ হয়ে যায় মূলধারার নেতাদের কার্যক্রম দেখে। একদিন ঝড়ের রাতে হোটেলে খেতে বসে তারই দু’ক্লাসের সিনিয়র শম্পার সঙ্গে সাক্ষাৎ। তৈরি হয় এক অসম প্রেম। ব্যক্তিত্বে পরিপূর্ণ শম্পা মাঝে মাঝে খেই হারাতে বসে নবীন রঞ্জুর প্রেমে। কিন্তু নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে সামগ্রিকভাবে মানুষের জন্য কিছু করতে প্রত্যয়ী হয়। পড়াশোনো শেষ করে ঢাকায় একটি সংস্থা খুলে বিভিন্ন প্রজেক্ট নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করে। তার সহযোগী হয় রঞ্জু। রঞ্জু মেঘের ছবি তুলতে ভালোবাসে। মেঘকে তার ভিন্নরূপী মনে হয়। নানা সম্ভাবনা থাকে মেঘে। সে বিষয়ে রঞ্জু শম্পাকে বলছে, ‘মেঘ একই সঙ্গে সম্ভাবনা যেমন বয়ে আনে; তেমনি আশঙ্কা ও ভয়ও যেন তাতে ভর করে থাকে...। কী ভয়ঙ্কর সৌন্দর্য!’ রঞ্জুর বাবা তৈরি পোশাক শিল্পে কর্মরত অবস্থায় শ্রমিক মেরে নানা কূটচালে ফুলে ফেঁপে ওঠেন। এখন তিনি বুর্জোয়া রাজনীতির বিশাল বড় নেতা। নিজ এলাকায় সাংসদ হবেন। এই অদম্য খায়েশ। রঞ্জু তার বাবার প্রচলিত রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী নয়। তবুও বাবার আবদারে কয়েকজন সঙ্গী সাথী নিয়ে নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়েছিল। এখানে মূলত তিনটে পলায়নের ঘটনা সমান্তরালভাবে আচরিত। বদিহাটিতে স্কুল শিক্ষক রফিকুলের কলেজ পড়ুয়া কন্যা মালাকে উত্ত্যক্ত করে তুলে নিয়ে গণধর্ষণ করে ক্ষমতাসীন দলের লেজুড়বৃত্তিকারী বখাটে নামধারী কতিপয় ছাত্র। তাদের দৌরাত্ম্য দেখে মালার বাবা মামলার নানা জটিলতায় নিরুপায় হয়ে পলায়ন করে রংপুরের দিকে। সেখানে রঞ্জু বিচারের পক্ষে থাকলেও অনন্যোপায়। শম্পার সঙ্গে ফেসবুক মেসেঞ্জার, মোবাইল ইত্যাদিতে নানা সময় দীর্ঘক্ষণ প্রেমের কথা চলে রঞ্জুর। ঢাকার বনানীর শম্পার অফিসে সপ্তাহে নিয়ম করে যেত রঞ্জু। নানা জায়গায় নিজের ওপর আসা খুবলে খাওয়ার ইঙ্গিতের কথা জানায় শম্পা। সম্পা রঞ্জুর সেরা কয়েকটা মেঘের ছবি নেয়। একদিন হঠাৎই শম্পার অফিসে যেয়ে দেখে যে শম্পা ফোটোগ্রাফির ওপর স্কলারশিপ নিয়ে ইউএসএ চলে গেছে। অফিসের সমগ্র দিয়ে গেছে রঞ্জুকে। শম্পা পলায়ন করল নিরুপায় হয়ে। এদেশে সে থাকতে পারছিল না তার লাস্যময়ী অবয়ব নিয়ে। তাই পলায়নই পরিণতি। স্কলারশিপের জন্য জমা দেয়া ফটোগুলো কিন্তু রঞ্জুর তোলা ছিল। রঞ্জু অনেকটা প্রচলিত চিন্তাধারার বাইরের মানুষ। তার বাবার চাপ সত্ত্বেও অঢেল সম্পত্তি আর কারখানার দায় দায়িত্ব নিতে অস্বীকৃতি জানায়। নিজেদের ঢাকার বাড়িতে গেলেও বাবা মা’র সঙ্গে খুব কম মিশেছে। ছাদে যায়। মোবাইল বন্ধ করে নিজেকে নিজেই উপলব্ধি করার চেষ্টা করে। বদিহাটির তাদের নিজ মঞ্জিলে থাকতে তার স্বচ্ছন্দতা। যদিও বৈদ্যুতিক সরবরাহ খুবই জঘন্য। ঔপন্যাসিক ঘুমকে এক প্রকার পলায়ন বলেছেন। এবং সবকিছু থেকে বাঁচতে তিনি ঘুমোনোর মধ্যে রঞ্জুকে প্রশান্তিদানের প্রয়াসী হয়েছেন। ‘আমার আছে জল’ একটি বাংলা প্রোজ্জ্বল সিনেমা। সিনেমার নায়ক ঢাবির শিক্ষার্থী। তারই সহপাঠিনীর প্রেমে পড়ে। কিন্তু যখন জানতে পারে যে প্রেমিকার বাবা একজন ভিক্ষুক তখন নায়ক বিদেশে পলায়ন করে। আর চিঠিতে লিখে যায়, ‘আমার একার পক্ষে এ সমাজ পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। তাই...।’ উপন্যাস আর সিনেমার পলায়ন সমরেখার। এই নিরুপায় পরিণতি পলায়নই কি আমাদের সবার নিয়তি? আমরা কি তবে পালিয়েই বাঁচব? সবাই পালালে পরিবর্তক হবে কে? এই প্রশ্ন ঘুরেফিরে অনুরণন করছে আজ চারিপাশ।
×