ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বঙ্গবন্ধু, জাতির মুখচ্ছবি

প্রকাশিত: ১১:৪২, ১৪ জুন ২০১৯

বঙ্গবন্ধু, জাতির মুখচ্ছবি

১৯৭৩ সালে আলজিয়ার্সে জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনে এসেছিলেন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। তাঁকে দেখে এগিয়ে আসেন ফিদেল ক্যাস্ত্রো, কিউবার বিপ্লবী নেতা। হাত বাড়িয়ে দিলেন বঙ্গবন্ধু, সে হাত উপেক্ষা করে তাঁকে জড়িয়ে ধরলেন ফিদেল। পৃথিবীর দুই প্রান্তের দুই নেতা, সংগ্রাম ও ত্যাগ যাদের এক অভিন্ন সূত্রে আবদ্ধ করেছে। তাঁদের মুখচ্ছবিতে প্রস্ফুটিত যার যার জাতির স্বপ্ন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরিচিত হবার পর ফিদেল বলেছিলেন, আমি হিমালয় দেখিনি, কিন্তু আমি শেখ মুজিবকে দেখেছি। তাঁর ব্যক্তিত্ব ও সাহসের একমাত্র তুলনা চলে হিমালয়ের সঙ্গে। তাঁকে দেখেই আমি হিমালয়কে দেখার অভিজ্ঞতা পেয়েছি। নব্বই দশকের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বাংলাদেশে এই হিমালয়-সদৃশ মানুষটির প্রতি বাঙালী জাতি নানাভাবে তাঁদের শ্রদ্ধা ও ভালবাসা জানিয়েছে। গল্পে, কবিতায়, গানে, শিল্পীর তুলিতে, ঐতিহাসিকের বিশ্লেষণে নানাভাবে তাঁকে আমরা আবিষ্কার করেছি। এই তালিকায় সর্বশেষ যে গ্রন্থটি যুক্ত হলো তার নাম ‘বঙ্গবন্ধু, এপিটোম অফ এ নেশন’, লেখক এনায়েতুল্লাহ খান। ঢাকা থেকে প্রকাশ করেছে কসমস বুকস। মোট ১৬৮ পাতার এই বইটি নানা দিক দিয়ে ব্যতিক্রমী। বইটি ইংরেজীতে, ফলে অনুমান করি এর মূল লক্ষ্য বিদেশী পাঠক, যারা বাংলাদেশের জাতির পিতার জীবন ও তাঁর কর্মের সঙ্গে সম্যক পরিচিত নন। কফি টেবিল বই হিসাবে মুদ্রিত এই বইটি লেখকের ব্যক্তিগত শ্রদ্ধাঞ্জলি, কিন্তু শুধু কথা দিয়ে সেই শ্রদ্ধাঞ্জলি নির্মিত হয়নি। এনায়েতুল্লাহ বঙ্গবন্ধুর জীবন ও সংগ্রামের ইতিহাসের আনুপুঙ্খিক বিবরণের বদলে সেই ইতিহাসকে লিপিবদ্ধ করেছেন ছোট ছোট ঘটনায় ও তার অলঙ্করণ হিসাবে সুনির্বাচিত আলোকচিত্রের মাধ্যমে। এর মুদ্রন, বাঁধাই, ছবির নির্বাচন ও সীমিত কথার ব্যবহার এতটাই সুচিন্তিত ও সৌকর্য মন্ডিত যে একদম অনাগ্রহী পাঠককেও তার প্রতি আকর্ষিত করবে। মোট ২৭-টি অধ্যায়ে বিভক্ত গ্রন্থটিতে জাতির জনকের জীবনের বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য অধ্যায় কথায় ও ছবিতে আলোকিত হয়েছে। রয়েছে বঙ্গবন্ধুর সংক্ষিপ্ত জীবনী, তাঁর বিভিন্ন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, মার্চের ঘটনাক্রম, পাকিস্তানের কারাগারে তাঁর অভিজ্ঞতা এবং ১৫ আগস্টের সেই কালরাত্রির বিবরণ। এই গ্রন্থটিকে আরও বিশিষ্টতা দিয়েছে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার একটি সাক্ষাতকার ও তাঁর দীর্ঘদিনের সহকর্মী ড. কামাল হোসেনের একটি স্মৃতিচারণ। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের হত্যা ঠেকাতে ঘাতকের বুলেট নিজ শরীরে গ্রহণ করেছিলেন কর্নেল জামিল উদ্দিন আহম্মদ। এই গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত তাঁর আত্মাহুতির একটি মর্মস্পর্শী বিবরণ পাঠককে আবেগাক্রান্ত করে। অধ্যায়সমূহের নির্বাচনের পেছনে সর্বদা কালানুক্রমিক অনুক্রম অথবা ঐতিহাসিক গুরুত্বের বদলে লেখকে ব্যক্তিগত আবেগ ও অগ্রাধিকার অনুসৃত হয়েছে। এর ফলে পুনরাবৃত্তির দুষ্টতা ছাড়াও দুর্বল সম্পাদনা গ্রন্থটিকে আহত করে। গ্রন্থটির আসল শক্তি গ্রন্থে অন্তর্ভুক্ত চিত্রসমূহ। ব্যবহৃত চিত্রসমূহ অথবা তার অনুরূপ অনেক ছবিই আমাদের পরিচিত, কিন্তু কফি টেবিল সাইজের এই বইটিতে সেই ছবিই সম্পূর্ণ নতুন বৈশিষ্ট্য নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে। উদাহরণ হিসাবে বইটির শুরুতে দুই পাতাজুড়ে, ছবিটতে ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের যে ছবিটি রয়েছে তার কথা ধরা যাক। সেদিন রেসকোর্সের মাঠে যারা সে ভাষণ শুনেছে, বুকের মধ্যে সেদিনের উত্তেজনা, তার প্রতিশ্রুতির প্রত্যয়, আশায় ও উদ্বেগে থর থর সে কম্পন এখনও অমলিন। এই ছবিটি তার রাজসিক ব্যাপ্তিতে পুনরায় সেই দিনটি ফিরিয়ে আনে। নতুন প্রজন্মের পাঠক অথবা যে কোন বিদেশী অলক্ষ্যে বইটি উল্টাতে গিয়ে গিয়ে যে তা দেখে আবেগাক্রান্ত হবেন, এ কথায় কোন ভুল নেই। ৭ মার্চের পুরো ভাষণটির ইংরেজী অনুবাদ অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় সেই অভিজ্ঞতা আরও সমৃদ্ধ হয়েছে, এ কথাও অনায়াসে বলা যায়। এই রকম ছোট-বড় প্রায় ২০০ ছবি বইটিকে একটি প্রামাণিক দলিলের মর্যাদা দিয়েছে। প্রতিটি ছবির পাশে তার চিত্রগ্রাহকদের নাম অন্তর্ভুক্ত থাকলে গ্রন্থটির দালিলিক চরিত্র পরিপূর্ণতা পেত। গ্রন্থের পরবর্তী সংস্করণে লেখক এই ত্রুটি শুধরে নেবেন, এই আশা রইল। প্রচ্ছদে রয়েছে শিল্পী শাহাবুদ্দিনের আঁকা একটি তেল রঙ, যা এই গ্রন্থটিকে ভিন্ন মাত্রায় অভিষিক্ত করেছে। শিল্পীর তুলিতে ফুটে উঠেছে বঙ্গবন্ধুর সেই আত্ম-প্রত্যয়ী মুখাবয়ব, তাঁর সাদা পাঞ্জাবি ও মুজিব কোট, উত্থিত তর্জনি, এসবই আমাদের মনে করিয়ে দেয় ফিদেলের বলা কথা। বাংলাদেশের সীমানায় হিমালয় পড়েনি, কিন্তু হিমালয়-সদৃশ এক মহামানব তার ইতিহাসকে আলোকিত করেছিল। এনায়েতুল্লাহ খানকে ধন্যবাদ, এই বইটির মাধ্যমে সেই মহামানবের জীবনকাব্যের সঙ্গে নতুন করে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাওয়া গেল।
×