মানুষ পরিপূর্ণ হয় কিসে? যখন তার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, ইচ্ছা, আকাক্সক্ষার সঙ্গে স্বপ্ন মিলে যায়, পূরণ হয় মনোবাসনা। তখন মানুষ শিল্পী হয়ে ওঠে, সর্বস্তরের উজ্জ্বল উদাহরণ হয়ে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে কিরণ¥য় দ্যুতি ছড়িয়ে বেড়ান। এমন একজন মানুষ, সমাজ সংগঠক, রাজনৈতিক সচেতন, শিল্প-সংস্কৃতি, ইতিহাস-ঐতিহ্যের সারথী, সন্তানদের সুশিক্ষায় উচ্চশিক্ষিত ও সুপ্রতিষ্ঠিত করা, চব্বিশ প্রহর হাসিমুখ যার, মানুষের সঙ্গে সৌহার্দিক আচরণ করা সোনার মানুষ হলেন মমতাজ বেগম।
দিন শেষে যিনি একজন মা। এমন মায়ের তিনটি সন্তান আজ সমাজ, রাষ্ট্রে সুপ্রতিষ্ঠিত। তিনটি রত্নগর্ভে ধারণ করেছেন মমতাময়ী এই মা। মমতাজ বেগমের প্রথম সন্তান ব্যারিস্টার সেলিম আলতাফ জর্জ বর্তমানে ৭৮ (কুষ্টিয়া-৪; কুমারখালী-খোকসা) এর সংসদ সদস্য। তিনি এক সময়ের কৃতী ফুটবলার হিসেবেও সমধিক পরিচিত ছিলেন। তার স্ত্রী জান্নাতুন নাইম (সমাজবিজ্ঞানে এমএ)। দ্বিতীয় সন্তান ফাতিমা ইমরোজ ক্ষণিকা ঢাকা মহানগরের এডিশনাল জজ হিসেবে কর্মরত আছেন। তার স্বামী সাজেদুর রহমান অবসরপ্রাপ্ত জেলা জজ। কনিষ্ঠা সন্তান জেরিন ফেরদৌস এ্যান্থনি শের-এ বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার হিসেবে কর্মরত আছেন। তার স্বামী খালিদ হোসেন ইয়াদ মাদারীপুর পৌরসভার বর্তমান মেয়র।
১৯৫৫ সালের ১৪ জানুয়ারি পিরোজপুরের ভা-ারিয়ায় জন্ম নেয়া এই রত্নগর্ভার বাবার নাম সাইদুর রহমান যিনি ওসি সাইদুর রহমান নামে বেশি পরিচিত। ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে যাঁর অবদান অবিস্মরণীয় ও মা আমবীয়া খাতুন। বাবা-মায়ের বড় সন্তান হওয়ায় মমতাজ বেগমের দায়িত্ব ও কর্তব্য ছিল বেশি। আশৈশব থেকে ভাইবোনদের প্রতি যেমন অবিচল আস্থা ও নির্ভরতার প্রতীক হয়ে উঠেছেন এই নারী, তেমনি ১৯৭৩ সালে কুষ্টিয়ার কুমারখালীর সেরকন্দিতে বিয়ের পর থেকে স্বামীর পারিবারিক ঐতিহ্যের প্রতিও নেকনজর রেখে চলেছেন মহতী এই নারী। মমতাজ বেগমের শ্বশুরবাড়ির পারিবারিক ঐতিহ্য ভরপুর। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের কুষ্টিয়া ও কুমারাখালী-খোকসা অঞ্চলের অন্যতম প্রধান সংগঠক শহীদ গোলাম কিবরিয়ার ভূমিকা প্রাতস্মরণীয়। তিনি কুমারখালী-খোকসার সংসদ সদস্য ছিলেন এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও বাংলাদেশের সংবিধানের সিগনেটরি মেম্বরও ছিলেন।
রাজনীতির এক সমৃদ্ধ পরিবার-তাঁর স্বামীর বড় ভাই মরহুম আবুল হোসেন তরুণ, স্বামীর ভাইয়ের স্ত্রী সুলতানা তরুণও সংসদ সদস্য ছিলেন। এখন সন্তান সংসদ সদস্য আর স্বামী মরহুম আলতাফ হোসেন কিরণ ছিলেন একজন মহান মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭৫ পরবর্তী সামরিক শাসক ও স্বৈরাচারী সরকারের দ্বারা নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার গুণী ক্রীড়া সংগঠক, অভিনেতা এবং শিক্ষক আলতাফ হোসেন কিরণ জীবনের শেষদিন পর্যন্ত অসুস্থ অবস্থায় থেকে এই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন। একদিকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চাকরি করে স্বামী সংসারে স্বামীর সেবাপরিচর্যা করে সন্তানদের লেখাপড়ার প্রতি সমান সময় ব্যয় করেছেন। মননে স্বপ্ন বুনেছিলেন সন্তানদের শুধু উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত নয় সুশিক্ষায় প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্য। সেই লক্ষ্য, সেই স্বপ্নের গহীন অরণ্যে বসতি গেঁড়ে বাস্তবায়ন করে সন্তানদের প্রতি মায়ের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি স্বপ্ন পূরণ ও প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
অসুস্থ স্বামীর সেবাপরিচর্যায় ব্যস্ততার পরও সামাজিক-সাংস্কৃতিক কাজে নিয়োজিত এ নারী আজ অবধি আর্তমানবতা, সুবিধাবঞ্চিত মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি গত ৩০ বছর ধরে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ কুমারখালী শাখার সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং বিগত ২০ বছর ধরে কুমারখালী মহিলা সমিতির সভাপতি হিসেবে নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছন। তার নিষ্ঠা, সততা, একাগ্রতা, ধৈর্য তাকে আরও অন্যান্য সংগঠনে সম্পৃক্ত করেছে এবং তাঁকে আর সব নারী থেকে আলাদা করেছে। সদা হাস্যোজ্জ্বল এই নারী সহস্র আঘাত, বেদনার মধ্যেও সর্বদা হাসিমুখে থাকেন। এই ভিন্ন নারী বোহেমিয়ান ব্যথাকে আগলে রেখে, নারী থেকে মানুষ হয়ে ওঠার যে ধারাবাহিক যাত্রার অভিযাত্রী হয়েছেন, তা সত্যিই কসমিক উইলো!
বর্তমানে তিনি কুমারখালী পাবলিক লাইব্রেরি এবং ’৭১-এর ঘাতক দালাল নিমর্ূূল কমিটির সাধারণ সম্পাদক। এছাড়া শহীদ গোলাম কিবরিয়া ফাউন্ডেশনের কো-চেয়ারম্যান, নাগরিক পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক, কুমারখালী সঙ্গীত বিদ্যালয়ের উপদেষ্টা, কুষ্টিয়া সমিতির সদস্য, মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ সমিতির মহিলা সম্পাদক, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের কুমারখালী শাখার নারী সম্পাদক। আছেন ইতিহাস ঐতিহ্য সংস্কৃতি পরিষদের উপদেষ্টাও। সন্তানদের সুপ্রতিষ্ঠিত এবং স্বপ্ন পূরণ করে তিনি আজ স্বপ্নজয়ী মা, তিনটি রত্ন জন্ম দিয়ে তিনি রত্নগর্ভাও বটে। একজন নারী লেখাপড়া করে চাকরি করে, স্বামী সংসার সামলে সন্তান লালন-পালন করে সামাজিক সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড চালিয়ে নেয়া যে কোন সাধারণ আটপৌরে নারীর পক্ষে সম্ভব নয়। একজন অসম্ভব সাহসী, মেধাবী, উদ্যমী, প্রগতিশীল, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মনস্ক নারী ছাড়া এমন অসম্ভবকে সম্ভবে সাজানো যে কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। স্বামীর পরিবারে ঐতিহ্য যেমন ভরপুর তেমনি বাবার পরিবারও কম নয়। তাঁর বাবা ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় কুমারখালী থানার ওসি হিসেবে কর্মরত ছিলেন।
২৫ মার্চ কালরাতে ঢাকায় গণহত্যার পরপর অন্যান্য অঞ্চলের মতো কুষ্টিয়াতেও গণহত্যা শুরু হলে তৎকালীন ওসি সাইদুর রহমান থানা থেকে মজুদকৃত অস্ত্র, রাইফেল মুক্তিযোদ্ধাদের বিতরণ করে দেন এবং অস্ত্রের প্রশিক্ষণ প্রদান করান। তাঁর এই সাহসিকতা ও অবদান কুমারখালীর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে- তাঁর এ বীরত্বগাথা অমর হয়ে থাকবে। মমতাজ বেগমও অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, বৈষম্যহীন সমাজ গঠনই ছিল তাঁর রাজনৈতিক দর্শন। ছাত্রজীবনে সরাসরি রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকলেও- বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতারের প্রতিবাদে রাজপথে স্লোগান দেয়া, নিজ হাতে পোস্টার লেখাসহ ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচন ও ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে পরোক্ষ ভূমিকা রাখেন ’৭১-এ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক মরহুম আব্দুল আজিজ খানের বাড়িতে বসে রুটি, তরকারি করে দিতেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করতেন। রাজনীতি মনস্ক এই মানুষ ছিলেন কর্তব্যপরায়ণ আর পরোপকারী যার ফলে আজ তিনি এবং তাঁর স্বপ্ন সমান উঁচু।
একজন মানুষ কতভাবে দায়িত্ব ও কর্তব্য করে মমতাজ বেগমকে না দেখলে বোঝা যায় না। সন্তানদের প্রতি যেমন কর্তব্য করেছেন তেমনি তিনটি বোনের সুপাত্রস্থ করেছেন তিনি নিজে। যাদের প্রত্যেকে আজ সুপ্রতিষ্ঠিত ও উচ্চশিক্ষিত। এই মহতি, গুণবতী, রত্নগর্ভা নারী সম্প্রতি বাংলাদেশ মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে মহিলাবিয়ষক অধিদফতরের স্বপ্নজয়ী মা সম্মাননা লাভ করেছেন। বর্তমানে অসহায়, সুবিধাবঞ্চিত নারী, শিশুদের নিয়ে গড়া ‘লাসবো’ নামে একটি মানবিক উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক তিনি-যার মাধ্যমে সমাজ উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছেন। তাঁর শেষ স্বপ্ন বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় সোনার সন্তানরা যেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আদর্শ, চেতনা, দর্শন ধারণ করে সোনার বাংলায়-সবুজ বাংলাদেশকে চিরঞ্জিব করে রাখে সেই রত অবিরত অটুট থাক; এই আকাক্সক্ষা এই মহতী নারী, রত্নগর্ভা স্বপ্নজয়ী মায়ের।
আরো পড়ুন
শীর্ষ সংবাদ: