ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

কলকাতা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল

প্রকাশিত: ১১:৫৬, ১৪ জুন ২০১৯

কলকাতা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল

প্রতিবেশী দেশের কাছের শহর কলকাতা। পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী। মাঝে মধ্যেই নানা ছুতানাতায় কলকাতা যাওয়ার সুযোগ এসে যায়। বয়সের দিক দিয়ে প্রাচীন এ শহরটিতে রয়েছে দর্শনীয় অসংখ্য স্থাপত্য। কলকাতা যাব অথচ দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে দেখব না, এমনটা ভাবাই যায় না। সময় সুযোগ মিললে যেদিকে খুশি, এক চক্কর বেরিয়ে পড়া অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে। শীত শেষে বসন্তের এক সকালে দলবেঁধে এমনই বেরিয়ে পড়া। সঙ্গী মাধুরী, সন্দীপন, বন্যা আর তিন বছর বয়সী খুদে পর্যটক সমৃদ্ধি। ট্যাক্সি নিয়ে সোজা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। সকাল নয়টার মধ্যেই ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের গেটে দেশী-বিদেশী পর্যটকদের ভিড় জমে গেছে। টিকিট কাটার লম্বা লাইন। সন্দীপনকে লাইনে দাঁড় করিয়ে এদিক- সেদিক ঘুরে বেড়াই। রাস্তার ওপারে ঘোড়ার গাড়ির বড়সড়ো সারি। দূর থেকে দেখি প্রতিটি গাড়িকে রাজকীয় সাজে সজ্জিত করা। কাছে যেতেই সহিসরা বলে ওঠেন, চলুন শহর ঘুরে দেখাই। সহিস মানে চালকদের কথায় বুঝতে পারি, পর্যটকদের আকৃষ্ট করতেই ঘোড়ার গাড়িগুলোকে এমন দৃষ্টিনন্দন সাজে সাজানো হয়েছে। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের গেটের কাছে ফিরে আসতেই সন্দীপন টিকিট ধরিয়ে দেয়। টাকার অঙ্ক দেখে আক্কেলগুরুম। প্রতিটি টিকিট পাঁচ শ’ টাকা। বিদেশি পর্যটকদের জন্য এ হার। ভারতীয়দের জন্য প্রবেশ মূল্য মাত্র পঞ্চাশ টাকা। বিষয়টি একটু বেমানান মনে হয়। অন্তত আমাদের কাছে। কারণ যখন এই ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল তৈরি হয়, তখন কলকাতা আমাদের অর্থাৎ তৎকালীন পূর্ববঙ্গেরও রাজধানী ছিল। এটি তৈরিতে ওই সময়ে নিশ্চয়ই আমরাও অর্থ দিয়েছি। অথচ এখন আমাদেরও অন্য বিদেশীদের মতো বেশি দামে টিকিট কাটতে হচ্ছে। প্রধান প্রবেশ ফটকের ওপরে দুই পাশে দুটি সিংহের আবক্ষ মূর্তি। বাইরে থেকেই ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল অর্থাৎ রানী ভিক্টোরিয়ার স্মৃতিসৌধ দেখে চোখ জুড়িয়ে গেল। দুধ সাদা মার্বেল পাথরে তৈরি যেন অনেকটাই অবিকল তাজমহল। ভেতরে ঢুকতে প্রধান সড়কের দু’পাশে চোখ-মন কেড়ে নেয়া ফুলের বাগান। দৃষ্টিসীমা যতদূরে প্রসারিত হয়, ততটাই বাহারী ফুলের বাগান। ভেতরে ঢুকে কয়েক মুহূর্তে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম, আজ পুরো দিনটা এখানে কাটাব। সামনে পা বাড়াতে গিয়ে হোঁচট খেলাম। যেখানে পায়ে চলার পথ, সেখানেই পাথরের নুড়ি দিয়ে ভর্তি। এর কারণ ব্যাখ্যা করে সন্দীপন জানাল, যাতে কেউ কোন ধরনের অঘটন ঘটিয়ে দৌড়ে পালাতে না পারে, এজন্য পথ জুড়ে পাথর বিছিয়ে দেয়া হয়েছে। আর প্রতিটি পাথর ঘষে বেশ মসৃণ করা হয়েছে। যাতে আবার দর্শনার্থী-পর্যটকদের হাঁটা-চলায় সমস্যা না হয়। পাথরকুচি এড়িয়েও ভেতরে ঢোকার পৃথক লেন রয়েছে। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের চারপাশে ফুলের বাগানগুলোতে সেই সাত সকালে খাবার-দাবারসহ বহু পর্যটক পরিবার-পরিজন নিয়ে বসে পড়েছে। জোড়া বেঁধেও এসেছে অনেকে। বেশ পিকনিক পিকনিক ভাব। দু’পাশে ফুলের বাগান রেখে প্রধান সড়ক ধরে কয়েক শ’ গজ সামনে এগোতে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের মূল ভবন। উঁচু লম্বা সিঁড়ি। যার মাথায় রয়েছে বেশ কয়েকজন রক্ষী। তারা দর্শনার্থী-পর্যটকদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ভেতরে ঢুকতে দিচ্ছে। এর আগে প্রধান প্রবেশ পথেও একদফা চেক করা হয়েছে। সিঁড়ি ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকতে মনে হলো এক অজানা জগতে এসে পড়েছি। বিশাল হলঘরের মাঝখানে রানী ভিক্টোরিয়ার আবক্ষ মূর্তি। অনেকটা বিষণ্ণ বদনে দাঁড়িয়ে আছেন মাথা উঁচু করে। মূল হলঘরটি ‘কুইন্স হল’ নামকরণ করা হয়েছে। মূলত এটিই আকর্ষণের অন্যতম কেন্দ্র। মূল হলঘরের আশপাশে আরও পঁচিশটি গ্যালারি রয়েছে। যার প্রত্যেকটি বেশ বড় বড় কক্ষ। এগুলোর প্রত্যেকটিকে জাদুঘরে রূপ দেয়া হয়েছে। এর কোনটিতে লর্ড ক্লাইভ, আবার কোনটিতে হেস্টিংস কিংবা কর্নওয়ালিশের আবক্ষ ভাস্কর্য। একটি গ্যালারির জাদুঘরে তুলে ধরা হয়েছে তৎকালীন কলকাতা শহরের দৃশ্যপট। দোতলা বাড়ি। দোকানপাট। রাস্তা। বোঝা বইছে মুঠে। কামারশালা। আধো আলো-আঁধারে মনে হবে যেন আমি ঐতিহাসিক যুগে দাঁড়িয়ে আছি। একটি জাদুঘরে রয়েছে বিভিন্ন সময়ে ব্রিটেন থেকে ভারতবর্ষে আসা বিখ্যাত ব্যক্তিদের প্রতিকৃতি। দেশীয় বিখ্যাতদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তার পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর, কেশবচন্দ্র সেন এবং মাইকেল মধুসূদন দত্তসহ আরও কয়েকজন বরেণ্য ব্যক্তির প্রতিকৃতি। আছে নন্দকুমারের কথিত জালিয়াতি সম্পর্কিত দলিল। যাকে অন্যায়ভাবে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছিল। পলাশীর যুদ্ধে ব্যবহৃত কামানটিও এখনে সযত্নে রক্ষিত রয়েছে। কুইন্স হলসহ গ্যালারিগুলোর দেয়ালে দেয়ালে মহারানী ভিক্টোরিয়ার বিভিন্ন ধরনের ঘোষণাসহ তার জীবন ও কর্ম লিপিবদ্ধ করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। আছে তার স্মৃতিবিজড়িত বিভিন্ন ঘটনার চিত্রাবলী। যেমন তার সিংহাসনারোহণ, তার বিয়ে, তার পুত্র ও উত্তরাধিকারীর ব্যাপটিস্টকরণ, রাজপুত্রের বিয়ে প্রভৃতি। আছে রানীর ব্যবহৃত সামগ্রী। যেমন- শৈশবে ব্যবহৃত পিয়ানো, দৈনন্দিন চিঠিপত্র লেখার টেবিল-চেয়ার, ভারতীয় প্রজাদের উদ্দেশ্যে লেখা তার শেষ চিঠি। জাদুঘর বা গ্যালারিগুলোতে ব্রিটিশ আমলে ব্যবহৃত অস্ত্র, নৌজাহাজসহ বিভিন্ন ধরনের এমন আকর্ষণীয় সাড়ে তিন হাজার নিদর্শন রাখা আছে। যেগুলো দেখে অনায়াসে বেশ কয়েকদিন কাটিয়ে দেয়া যেতে পারে। বাইরের ফুল বাগানগুলোতেও অনিন্দসৌন্দর্যের প্রচুর ভাস্কর্য রয়েছে। যার বেশির ভাগ ব্রিটেন থেকে তৈরি করে আনা হয়েছে। যার অন্যতম একটি হচ্ছে- মেমোরিয়ালের উত্তর পাশে সিংহ মস্তক মূর্তি। এ মূর্তি থেকে জলের চারদিকে চারটি ধারা বইছে। যা ভারতের প্রধান চারটি নদী সিন্ধু, গঙ্গা, যমুনা ও কৃষ্ণার প্রতীক। মেমোরিয়ালের পথে পথে এমন নানান নান্দনিকতা যে কাউকে নিয়ে যায় ভিন্ন জগতে। কলকাতা শহরের অন্যতম দর্শনীয় ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের ঐতিহাসিক তথ্য বলছে-৬৪ একর জমি নিয়ে এই দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা তৈরি হয়েছে। হুগলী নদীর তীরে জওয়রলাল নেহরু রোডের ওপরে এর অবস্থান। ১৭৫৭ সালে ভারত ব্রিটিশ শাসনে আসে। প্রায় পৌনে দু’ শ’ বছর ব্রিটিশরা ভারত শাসন করে। এর মধ্যে ১৭৭২ থেকে ১৯১১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কলকাতা ছিল ভারতের রাজধানী। ১৯০১ সালে ৯৪ বছর বয়সে মহারানী ভিক্টোরিয়া মারা যান। রানী ভিক্টোরিয়া স্মরণে স¤্রাট শাহজাহানের নির্মিত তাজমহলের আদলে লর্ড কার্জন এ স্মৃতিসৌধ নির্মাণের পরিকল্পনা ও উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৯০৬ সালের ৪ জানুয়ারি প্রিন্স অব ওয়েলস পরবর্তী কালের রাজা পঞ্চম জর্জ আনুষ্ঠানিক ভাবে এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন এবং রাজা অষ্টম এ্যাডওয়ার্ড ১৯২১ সালের ২৮ ডিসেম্বর এর উদ্বোধন করেন। মূল ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ভবনের দৈর্ঘ্য ১০৩ দশমিক ০২ মিটার এবং প্রস্থ ৬৯ দশমিক ৪৯ মিটার। উচ্চতা ৫৬ দশমিক ০৮ মিটার। ভবনটির শীর্ষে ৪ দশমিক ৮৮ মিটার উচ্চতার বিউগল হাতে ‘অ্যাঞ্জেল অব ভিক্টরি’ নামের এক নারী দেবীর ভাস্কর্য রয়েছে। ব্রোঞ্চ দ্বারা নির্মিত সাড়ে তিন হাজার কিলোগ্রাম ওজনের এ ভাস্কর্যটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে-বাতাসের গতিবেগ অনুযায়ি এটি ঘুরতে পারে। ভবনের মোট ওজন ৮০ হাজার ৩০০ মেট্রিকটন। মেমোরিয়াল নির্মাণে ব্যবহৃত হয়েছে ৪৫০ দশমিক ২৪ ঘন মিটার মার্বেল পাথর। যার পুরোটা আনা হয়েছে রাজস্থানের মাকরানা থেকে। স¤্রাট শাহজাহান তাজমহল নির্মাণে এখান থেকে পাথর সংগ্রহ করেছিলেন। মহারানীর এ স্মৃতিসৌধের নকশা করেন ব্রিটিশ ইনস্টিটিউট অব আর্কিটেক্টের প্রেসিডেন্ট স্যার উইলিয়ামস। নির্মাণকাজ তত্ত্বাবধান করেন ভিনসেন্ট জে ইসচ। নির্মাণ কাজ বাস্তবায়ন করে কলকাতার মার্টিন এ্যান্ড কোম্পানী। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের সম্পূর্ণ কাজ সমাপ্ত করতে ব্যয় হয়েছিল ওই সময়ের এক কোটি পাঁচ লাখ টাকা। যা মুদ্রাস্ফিতির হিসেবে আজকের দিনে প্রায় সোয়া দুই কোটি ডলারের সমান। এ অর্থের পুরোটা যোগান দিয়েছিল ব্রিটিশদের অনুগ্রহভাজন ব্যবসায়ী ও দেশিয় রাজন্যবর্গ। অসংখ্য বৈশিষ্ট্যে সমৃদ্ধ ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল নির্মাণে একটি শঙ্কর রীতির প্রকাশ ঘটেছে। এখানে যেমন দেখা মিলবে ইতালিয় রীতির মূর্তির। তেমনি দেখা যাবে মুঘল রীতির গম্বুজ। আছে ভারতীয় নিজস্ব ঘরানার উন্মুক্ত সুউচ্চ স্তম্ভশ্রেণী। ইউরোপীয় এবং ইন্দো-ইসলামিক রীতিরও যথার্থ মিশ্রন আছে। কলকাতা যাচ্ছি বা গেলাম। অথচ মহারানীর স্মৃতিসৌধ বা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ঘুরে দেখা হলো না, এটি অনেকটা বৃথা ভ্রমণ। কাজের ফাঁকে কিংবা শত ব্যস্ততার মাঝেও সময়-সুযোগে ঘুরে দেখা যেতে পারে অনন্য এ স্থাপনা। সূর্যের হেলে পড়া শেষ বিকেলে যখন বেরিয়ে আসি, বারবার কেন যেন মহারানী ভিক্টোরিয়ার বিষন্ন মুখখানা চোখের সামনে ভেসে উঠছিল। হয়তো ভাবছিলাম, আর কখনও আসা হবে কিনা। এ দৃশ্য দীর্ঘদিন স্মৃতিকাতর করে রাখবে নিঃসন্দেহে।
×