ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বিষমুক্ত সবজি চাষে বিপ্লব

প্রকাশিত: ০৯:৪২, ১৫ জুন ২০১৯

 বিষমুক্ত সবজি চাষে বিপ্লব

মাচা ও বিষমুক্ত সবজি চাষে বিপ্লব ঘটেছে। এ পদ্ধতিতে লাউ, পানি কুমড়া, কায়তা ও করলার বাম্পার ফলনে দেখা দিয়েছে সম্ভাবনার নবদিগন্ত। এতে একই জমির বহু ব্যবহারে কৃষকের আয় যেমন কয়েক গুণ বাড়ছে, তেমনি দেশের সবজির চাহিদা মেটাতেও রাখছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। এই পদ্ধতিতে সবজি চাষ করে নীলফামারীর জলঢাকা উপজেলার শিমুলবাড়ি ইউনিয়নের হাড়োয়া শিমুলবাড়ি গ্রামের রশিদুল ইসলাম (৩৭) এলাকায় মডেল কৃষক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। তার উৎপাদিত সবজি এলাকার চাহিদা মিটিয়ে রাজধানীর বাজারেও স্থান করে নিয়েছে। অপর দিকে এক বিশেষ পদ্ধতিতে সবজি বীজ উৎপাদন করে লাভবান হচ্ছেন নীলফামারী জেলা সদরের খোকশাবাড়ি ইউনিয়নের শাহপাড়া গ্রামের কৃষকেরা। বতর্মান সরকার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে কৃষি খাতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব প্রদান করে কৃষির উন্নয়ন ও কৃষকের কল্যাণকে সর্বোচ্চ বিবেচনায় নিয়ে কাজ করছে। ২০১৫ সালে কৃষিতে বাংলাদেশকে বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে। শেখ হাসিনার সরকার সার, ডিজেল, বিদ্যুত ইত্যাদি খাতে আর্থিক সহযোগিতার পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করেছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত সব খাতে মোট ৬৫ হাজার ৪৪৭ কোটি টাকার আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করা হয়েছে। বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকার ২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে প্রণোদনা/কৃষি পুনর্বাসন চালু করে। এ কর্মসূচীর মাধ্যমে গত অর্থবছর পর্যন্ত ৮২৭ কোটি ১৭ লাখ টাকা প্রদান করা হয়েছে। যার মাধ্যমে ৭৪ লাখ ৫৪ হাজার ৩১৩ জন কৃষক উপকৃত হয়েছেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া এবং বিভিন্ন ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের কৃষি প্রণোদনা এবং পুনর্বাসন বাবদ ১০০ কোটি টাকা ব্যয়ে বিনামূল্যে কৃষি উপকরণ ও আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছে। কৃষি বিভাগ সূত্র মতে, বিষমুক্ত ফসল উৎপাদনে কৃষকদের এবার সচেতন করা হচ্ছে। কারণ অধিক ফসল ফলন পেতে বর্তমানে বাংলাদেশে প্রচলিত পদ্ধতির চাষাবাদে উচ্চমাত্রায় রাসায়নিক সার ও বালাইনাশক বিশেষ করে কীটনাশকের ব্যবহার দিন দিন বেড়েই চলছে। এতে একদিকে যেমন উৎপাদন খরচ বাড়ছে, কমছে মাটির উর্বরতা ও উৎপাদন ক্ষমতা। অন্য দিকে এসব রাসায়নিক পদার্থের ক্ষতিকর প্রভাব মাটিতে ও কৃষি পণ্যে পড়ছে। বিশেষ করে মাটি, পানি, বায়ুসহ আমাদের পরিবেশ প্রতিবেশ দারুণভাবে দূষিত হচ্ছে। এমনই পরিস্থিতিতে জীববৈচিত্র্য রক্ষা, পরিবেশবান্ধব কৃষি, নিরাপদ খাদ্যের মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে জীবনযাপন সর্বোচ্চ গুরুত্বের মধ্যে পড়ছে। বিষমুক্ত ফসল উৎপাদনে নীলফামারীর কৃষক রশিদুল ইসলাম বিষমুক্ত মাচা পদ্ধতিতে সবজি চাষ করে এলাকার অন্য কৃষকদের মনবলে শক্তি এনে দিয়েছে। বাংলাদেশ পৃথিবীর একটি জনবহুল দেশ যার অর্থনীতি মূলত কৃষিনির্ভর। জিডিপিতে কৃষি খাতের অবদান ১৬% এবং দেশের প্রায় ৪৫% লোক কৃষি কাজের সঙ্গে নিয়োজিত। বালাইদ্বারা বাংলাদেশে সবজি ফসলের প্রায় ২৫% ক্ষতি হয়ে থাকে তা সত্ত্বেও বাংলাদেশ সবজি উৎপাদনে বর্তমানে বিশ্বের ৩য় স্থানে রয়েছে এবং সবজির আবাদি জমির পরিমাণ বৃদ্ধির দিক দিয়ে প্রথম স্থান অধিকার লাভ করেছে। চলতি বছর নীলফামারীর এই কৃষক প্রায় ১২ বিঘা জমিতে সবজি চাষ করেছে। ভালফলন ও দাম পাওয়ায় দুই দফায় সবজি তুলেই তিনি পেয়েছেন প্রায় তিন লাখ টাকা। সবজি চাষেই ভাগ্য বদলে গেছে রশিদুলের। হাড়োয়া শিমুলবাড়ী গ্রামের মাঠে গিয়ে রশিদুলের দৃষ্টিনন্দন ফসলের সমারোহ লক্ষ্য করা যায়। মোটা নাইলন সুতা ও বাঁশের ফালি দিয়ে তৈরি করা মাচার নিচে ঝুলে আছে নানা জাতের সবজি। কথা প্রসঙ্গে রশিদুল ইসলাম বলেন, ২০১৬ সালে এসএফএসএ-এর সহযোগিতায় প্রশিক্ষণ নিয়ে তাদের থেকে চারা কিনি। প্রথম বছর পরীক্ষামূলকভাবে ৪০-৪৫ শতক জমিতে শসা, লাউ, করলা, কাকরোল, চিচিঙ্গা ও চালকুমড়া আবাদ করি। ওই বছর খরচ বাদ দিয়ে প্রায় ৭০-৭৫ হাজার টাকা লাভ হয়। তারপর জমির পরিমাণ বাড়াতে থাকি। এ বছর নিজের ও বর্গাসহ প্রায় ১২ বিঘা জমিতে সবজির চাষ করেছি। প্রতি মৌসুমে বিঘা প্রতি প্রায় ৩০ হাজার টাকা ব্যয় হয়। এক মৌসুমে ৬-৭ বার সবজি তোলা যায়। এবার সবজির বাম্পার ফলনও হয়েছে, আগাম সবজি বিক্রি করে দামও পেয়েছি ভাল। দুই দফায় সবজি তুলে প্রায় তিন লাখ টাকা বিক্রি করেছি। তিনি বলেন, এখন আর সবজি নিয়ে বাজারে যেতে হয় না। পাইকাররা গ্রাম থেকেই কিনে নিয়ে যান। এছাড়া রশিদুলের সবজি রাজধানীর বাজারে যাচ্ছে। রশিদুলের বাবা আব্দুল জব্বার (৬৫) বলেন, আমার পরিবারে চার ছেলে ও তিন মেয়ে। এদের মধ্যে রশিদুল বড়। সে সবজি চাষ করে। সংসারে অনেক অভাব ছিল। রশিদুল সবজি চাষ শুরুর পর থেকে অভাব দূর হয়ে গেছে। তাছাড়া এলাকার অনেক বেকার দিনমজুরের ক্ষেতে কাজের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। ওই এলাকার কৃষি শ্রমিকরাও জানায়, রশিদুল ভাই সবজি বাগান করার পর থেকে কাজের অভাব নেই। দৈনিক সাড়ে তিন শ’ টাকা মজুরিতে আমরা কাজ করে। কৃষি অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও রশিদুলকে সহযোগিতা করছে বিষমুক্ত মাচা পদ্ধতিতে সবজি চাষে। অপরদিকে এক বিশেষ পদ্ধতিতে সবজি বীজ উৎপাদন করে লাভবান হচ্ছেন নীলফামারী জেলা সদরের খোকশাবাড়ি ইউনিয়নের শাহপাড়া গ্রামের কৃষকেরা। অনেকে খড়ের ঘরের বদলে টিনের ঘরের মালিক হয়েছেন, জমি কিনেছেন, সংসারে এনেছেন সচ্ছলতা। জেলা সদর থেকে পশ্চিমে নীলসাগর যাওয়ার পথে রাস্তার দুই ধারে ওই গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, মশারির জাল দিয়ে ক্ষেত ঘিরে রেখে বিভিন্ন ধরনের সবজি আবাদ করেছেন কৃষকেরা। আবার মাচা দিয়ে চাষ করা হয়েছে করলা, চাষ করা হয়েছে মরিচ ও মিষ্টিকুমড়া। এভাবে বীজ চাষ করার নাম দেয়া হয়েছে নেট হাউস পদ্ধতি। দেখা গেল, জালের ভেতর (নেট হাউস পদ্ধতিতে) চাষ করা হয়েছে বেগুন। আর জালের ভেতর বসে ক্ষেত পরিচর্যা করছেন কৃষকেরা। এ সময় শাহপাড়া গ্রামের কয়েকজন কৃষক বলেন, এসব ক্ষেতের সবজি বাজারজাত করার জন্য ফলানো হচ্ছে না। এগুলো থেকে বীজ সংগ্রহ করে তা বিক্রি করা হবে। একটি বীজ বিপণনকারী প্রতিষ্ঠান এভাবে সবজি বীজ উৎপাদনে কৃষকদের সহায়তা দিচ্ছে। তারা কৃষকদের মধ্যে উচ্চফলনশীল সবজির বীজ বিতরণ করছে এবং কৃষকদের বীজ উৎপাদনে যাবতীয় পরামর্শ দিচ্ছে। গ্রামের ৫০ জন কৃষক এ পদ্ধতিতে সবজি বীজ উৎপাদন করে উপকৃত হয়েছেন। মোঃ মোমিনুর রহমান (৩৫) বলেন, আগে আমি রাজমিস্ত্রির কাজ করে যে পারিশ্রমিক পেতাম, তা দিয়ে সংসার চালানো সম্ভব হতো না। তখন দেখতাম, গ্রামের নবাব আলী অল্প জমিতে বীজ উৎপাদন করে লাভবান হচ্ছে। ২০০৯ সালে আমি করলা বীজ চাষ শুরু করি। এরপর মিষ্টিকুমড়া। তাতে লাভ ভালই হতে থাকে। গত বছর ৩৫ শতক জমিতে করলা বীজ চাষ করে ৪২ কেজি বীজ পাই। প্রতি কেজি করলা বীজ বিক্রি হয় ২ হাজার ২০০ টাকা দরে। ওই বীজ উৎপাদনে খরচ হয় ১৫ হাজার টাকা। ২০ শতক জমিতে মিষ্টিকুমড়া চাষে খরচ হয় পাঁচ হাজার টাকা। বীজ বিক্রি হয় ৩২ হাজার। এভাবে বীজ উৎপাদন করে আমার সংসারে সচ্ছলতা এনেছি। আগে কুঁড়েঘরে থাকতাম, এখন টিনের ঘর হয়েছে। বড় মেয়ের বিয়েতে তিন লাখ টাকা খরচ করেছি, ৮০ হাজার টাকায় ৭ শতাংশ জমিও কিনেছি। এবারই প্রথম বেগুন বীজ উৎপাদনে চাষ শুরু করেছি। জলঢাকা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মাহফুজুল হক বলেন, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের পক্ষ থেকে সবজির পুষ্টিগুণ উন্নয়নে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। তাছাড়া কেনাবেচার বিষয়ে কৃষকদের সহযোগিতা করতেও কাজ করছি। মাঠ পর্যায়ে উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তারা উঠান বৈঠকসহ হাতে-কলমে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে থাকেন। রশিদুলের মতো যারা উদ্যোক্তা রয়েছেন আমরা তাদের নানা পরামর্শ দিয়ে থাকি। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক আবুল কালাম আজাদ বলেন, এবার জেলায় পাঁচ হাজার ৮৩৫ হেক্টর জমিতে সবজি চাষের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে মাঠে নামে কৃষি বিভাগ। তাতে উৎপাদন হয়েছে এক লাখ ২১ হাজার ৬০৬০ টন সবজি। আগামীতে বিষমুক্ত ফলন আরও বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। তাই কৃষকদের মাঝে কৃষি বিভাগের পক্ষে বিষমুক্ত ফসল উৎপাদনে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। এতে বিষমুক্ত ফসল উৎপাদন পদ্ধতি কৃষকদের আকৃষ্ট করেছে। -তাহমিন হক ববী, নীলফামারী থেকে
×