ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৯ মার্চ ২০২৪, ৫ চৈত্র ১৪৩০

মমতাজ লতিফ

কেন ব্যয়বহুল উচ্চশিক্ষা বেকার তৈরি করবে?

প্রকাশিত: ০৮:৫৭, ১৭ জুন ২০১৯

কেন ব্যয়বহুল উচ্চশিক্ষা বেকার তৈরি করবে?

এটা কি বিস্ময়কর নয় যে- দেশের উচ্চশিক্ষা গ্রহণকারী গ্র্যাজুয়েটরা আমাদের দেশের কর্পোরেট অফিস, গার্মেন্টস ম্যানেজমেন্টের পদগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় যোগ্যতা ও দক্ষতা প্রমাণ করতে পারছে না! এর পরিণতিতে, ঐসব ভাল অঙ্কের বেতনের চাকরিগুলোতে নিয়োগ করতে হচ্ছে ভারতীয় ও শ্রীলঙ্কার গ্র্যাজুুয়েটদের! জানতে পারছি, এই খাতে উচ্চমানের দক্ষতা ও যোগ্যতার বলে উচ্চ বেতনে চাকরি করা ভারতীয়রা তাদের দেশের সর্বোচ্চ রেমিটেন্স দেশে পাঠায় বাংলাদেশ থেকেই। এ অবস্থা যদি দুই এক বছর বিরাজ করত, তাহলেও একটা কথা ছিল। কিন্তু এ অবস্থার কথা শুনে চলছি প্রায় এক দশক ধরে! তাহলে আমার প্রশ্ন, আমাদের দেশে প্রচলিত আইবিএ, বিবিএ, এমবিএ এর কারিকুলামে কি কি বিষয়বস্তু ও দক্ষতা অর্জনের অভাব রয়েছে যা আমাদের দেশের ব্যবসা, শিল্প, বাণিজ্য পরিচালনার অফিসগুলোর উপযোগী যোগ্য জনসম্পদের চাহিদা মেটাতে সক্ষম হচ্ছে না? এ কাজটি কারিকুলাম প্রণেতা, বিশেষত, বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষার আইবিএ, বিবিএ ও এমবিএ এর কারিকুলামের সঙ্গে পাশের প্রতিবেশী দেশ ভারত, শ্রীলঙ্কার বাণিজ্য শাখার শিক্ষার কারিকুলামের সঙ্গে তুলনা করে আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের, অন্তত আইবিএ, বিবিএ ও এমবিএর কারিকুলামকে পরিমার্জন করে বাজারের চাহিদা পূরণে যোগ্যতার সঙ্গে এসব অফিস পরিচালনায় সক্ষম গ্র্যাজুয়েট তৈরি কোন বড় সমস্যা নয় বলে মনে করি। আমার মনে পড়ে, এনসিটিবিতে আমরা যখন প্রাথমিক স্তরের কারিকুলাম পরিমার্জন ও উন্নয়ন করছিলাম, সে সময় পশ্চিমবঙ্গের প্রাথমিক স্তরের কারিকুলাম, পাঠ্যপুস্তক এনে পর্যালোচনা করে আমাদের প্রাথমিক শিক্ষার শ্রেণীগুলোর শিক্ষার মান সমপর্যায়ে রাখার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিল। এভাবে যোগ্যতাভিত্তিক কারিকুলামে অর্জনযোগ্য জ্ঞান, দক্ষতা ও দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয়ে প্রান্তিক যোগ্যতা, শ্রেণী ও বিষয়ভিত্তিক যোগ্যতা প্রণয়ন করা হয়েছিল। বর্তমানে তথ্য প্রযুক্তির বিকাশের ফলে যে কোন দেশের যে কোন ফেকাল্টির শিক্ষক পরিচিতি, কারিকুলাম ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে তথ্য কয়েকটি ক্লিকের সাহায্যে মুহূর্তের মধ্যে বের করা সম্ভব। এমন কি কম্পিউটারে রক্ষিত জ্ঞান ভান্ডার থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য তুলে নিয়ে লিখিত হচ্ছে প্রবন্ধ, থিসিস, মনোগ্রাফ, গবেষণা পত্রসহ সবকিছু। আমার খুবই দুঃখ হয় যে- আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে, সরকারী, বেসরকারী উভয় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অনেক যোগ্য, দক্ষ, বিদেশ থেকে ডিগ্রী অর্জনকারী শিক্ষক, শিক্ষিকা পাঠদান করছেন, অথচ তাদের হাতে তৈরি গ্র্যাজুয়েটরা যথাযোগ্য দক্ষতা তাদের পাঠ্য কারিকুলামে ও বিষয়বস্তুতে না থাকার কারণে তারা চাকুরীর ক্ষেত্রে অযোগ্য বিবেচিত হচ্ছে! সত্যিকার অর্থে, সৎ, আন্তরিক তরুণ, তরুণীরা বিবিএ, এমবিএ পাশ করে ভারতীয় একই বিষয়ে পাশ করা গ্রাজুয়েটদের কাছে মার খাচ্ছে। একই ডিগ্রীধারী প্রতিবেশী তরুণ, তরুণীদের পাশে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে। এ অবস্থা আমরা শিক্ষক, অভিভাবক শ্রেণী কোনভাবে চলতে দিতে পারি না। আরও দেরি হয়ে যাবার আগেই সরকারী, বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়নের লক্ষ্যে তরুণ, তরুণী মেধাবী শিক্ষক শিক্ষিকাদের এখনই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। তাদের, সব শিক্ষকের একটি প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে- তাদের হাতে তৈরি গ্র্যাজুয়েটরা বাজারের চাহিদা পূরণে সক্ষম হয়ে নানারকম অফিসে উচ্চপর্যায়ের পদে যোগ্যতার সঙ্গে চাকরি লাভ করে দেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে কর্মরত থাকবে। দেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে বেকার তৈরি হবে- এ আমরা আর দেখতে চাই না। উচ্চশিক্ষাকে উচ্চ বেতনের চাকরির জন্য উপযোগী করে তুলতে হবে। দায়িত্বগুলো মানসম্পন্নভাবে পালন করতে হবে। একদিকে আমাদের ছোট আয়তনের দেশে বিপুল জনসংখ্যক নিরক্ষর কর্মহীন বেকার তৈরিতে বড় ভূমিকা রাখছে। অন্যদিকে এ জনসংখ্যার একটি ক্ষুদ্র অংশ উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করবার পরও বেকার থাকবে বা যোগ্যতার চাইতে নিম্ন পর্যায়ের চাকরি গ্রহণে বাধ্য হবে, আর তাদের বিপরীতে বিদেশী তাদের সমবয়সী, তাদের মতো একই ডিগ্রী অর্জন করে এদেশের উচ্চ বেতনের পদগুলো দখল করে যোগ্যতার সঙ্গে সেসব পদের দায়িত্ব পালন করে যাবে- এ দৃশ্য আমাদের তরুণ তরুণীরা কিভাবে গ্রহণ করবে? এদেরকে হতাশার হাত থেকে রক্ষা করতে পারে আন্তরিক, দেশপ্রেমিক, যোগ্য ও দেশের উন্নয়নে অঙ্গীকারবদ্ধ তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষ তরুণ-তরুণী, শিক্ষক শিক্ষিকাবৃন্দ। এছাড়াও ব্যাংকিং খাতে ম্যানেজারদের ব্যাংকিং পরিচালনার দক্ষতার অভাব প্রকট যা তাদের ইন্টার্নদের প্রশিক্ষণের কারিকুলাম ভারত, শ্রীলঙ্কার ব্যাংকিং খাত পরিচালনার প্রশিক্ষণের কারিকুলামের সঙ্গে মিলিয়ে উন্নত ব্যাংক সেবা প্রদানে দক্ষ, যোগ্য ব্যাংকার তৈরিতে মনোযোগ দিতে হবে। ব্যাংকগুলোর উচ্চপর্যায়ের ম্যানেজমেন্টের ঋণ প্রদানের ক্ষমতাও সীমিত করতে হবে যাতে দেশে ঋণখেলাপী, অলস ঋণ তৈরি হতে না পারে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভূমিকা অনেক বেশি কার্যকর ও শক্তিশালী করতে ঐ ব্যাংকে উপযুক্ত দক্ষ আন্তরিক অর্থনীতিবিদদের নিয়োগ দেয়া জরুরী বলে মনে হয়। দেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেও বেকার তৈরি হবে- এ আমরা আর দেখতে চাই না। উচ্চশিক্ষাকে উচ্চ বেতনে চাকরির জন্য উপযোগী করে তোলার কোন বিকল্প নেই। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক
×