ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

অজয় দাশগুপ্ত

নক্ষত্রখচিত সিডনি সন্ধ্যা গর্বিত স্বদেশের মুখ

প্রকাশিত: ০৯:০২, ১৭ জুন ২০১৯

  নক্ষত্রখচিত সিডনি সন্ধ্যা গর্বিত স্বদেশের মুখ

সিডনি অনেক সময় বাংলাদেশের প্রতিভার ছটায় জেগে ওঠে। একেকটা সময় মনে হয় এ যেন আমাদের এক মিনি জন্মভূমি। আমি যখন ২৩ বছর আগে এদেশে অভিবাসন নিয়ে আসি কালে ভদ্রে দু একটা বাংলা অনুষ্ঠান আর বাঙালীর অনুষ্ঠান এই ছিল আমাদের অবলম্বন। এখন সে বাস্তবতা নেই। সিডনি জুড়ে বাংলাদেশের উদ্ভাস আর পরিচয় প্রকাশ্য। দু একটা এলাকায় বাঙালীই প্রধান। সব দোকানপাট থেকে সেখানে ঘুরে বেড়ানো মানুষের সবাই মূলত বাঙালী। বাংলাদেশী। আমাদের জাতির প্রধান বৈশিষ্ট্য আমরা কলহ করি আর যাই করি দেশের ব্যাপারে সবাই এক। যেটা আপনি এবার বিশ্বকাপ ক্রিকেটের খেলাগুলোতেও দেখতে পাবেন। এত দেশ এত মানুষ বিশ্বমিডিয়ার নজর কাড়লো আমাদের জাতীয় সঙ্গীত। যার মূল কারণ, এর সুর আর আমাদের দর্শককুলের প্রতিক্রিয়া। মানুষ লন্ডন বা বিলেতের যে কোন মাঠে বুকে হাত দিয়ে নয়নজলে ভাসে বলেই বিশ্ব মিডিয়া লুফে নিয়েছে আমাদের। এই জাতির মন বোঝা বড় মুশকিল। কোন কোন দাওয়াত বা আমন্ত্রণে গেলে মনে হয় দেশের প্রধান দুশমন আওয়ামী লীগ। আর শেখ হাসিনাই টার্গেট। নির্বাচনের পর এর প্রকোপ কমলেও মারমুখী মীরজাফর আর পাকি দালালরা মাঠ ছাড়েনি। এমন সব কথা আর তর্ক আপনি ভাবতেও পারবেন না যে এরা আসলে পাকিস্তানী না বাংলাদেশী? তাতে অবশ্য মূল কাজ থেমে নেই। এদেশের মূলধারার সঙ্গে আমাদের জাতীয় ধারার সঙ্গে পাল্লা দেবে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। তরুণ তরুণীরা একদিকে আরেক দিকে কিছু নিবেদিতপ্রাণ বয়স্ক মানুষ। এদের যৌথ বা সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সিডনি এখন বাংলাদেশকে গর্বের সঙ্গে ধারণ করে। সম্প্রতি এসেছিলেন অভিনয় জগতের সিনেমা ও নাটকের দুই তারকা। তারা বর্তমান বাংলাদেশ ও প্রজন্মের প্রতিনিধি। পরিচালক নির্দেশক মোস্তফা সরয়ার ফারুকী আর নায়িকা তিশা। ফারুকী একসময় সংবাদপত্রে ছিলেন। জনকণ্ঠেও কাজ করেছেন। নানা পথ পেরিয়ে তিনি এখন প্রতিষ্ঠিত একজন নাট্য নির্মাতা ও পরিচালক। ছোট পর্দা ছেড়ে বড় পর্দায় আসার পর তার কাজগুলো বড় হবে এটাই স্বাভাবিক। এখন তিনি ভারতের ইরফান খান নেওয়াজ উদ্দীন সিদ্দিকীদের সঙ্গেও কাজ করছেন। ডুব নামের যে ছবিটি রিলিজ হবার বিতর্ক আর আলোড়ন তুলেছিল তার মূল আধার ছিলেন হুমায়ূন আহমেদ। যেহেতু এটা কোন বায়োপিক ছিল না, তাই পরিচালকের স্বাধীনতা ভোগ করেছেন ফারুকী। ফলে ছবির কাহিনী নিয়ে তর্ক করা যাবে না। আর যাই হোক আমি দেখেছি সিডনির হলভরা দর্শক। টিকেটের জন্য হাহাকার। দেখেছি তারুণ্যের ভেতর সিনেমা দেখার আগ্রহ। সে আগ্রহ প্রমাণ করেছে আমরা যে মৌলবাদ আর অন্ধ সমাজের ভয়ে ভীত তার জানালা খুলতে ফারুকীর মতো পরিচালকের প্রয়োজন। কিন্তু আমরা তো এমন এক জাতি কাউকে বিশেষ সম্মান বা মর্যাদা দেয়াকে মনে করি অপরাধ। তর্ক-বিতর্কের উর্ধে কেউ না। ফারুকীর বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ ভাষা বিকৃতির। আমি অবশ্য গোড়া থেকে এ বিষয়ে একটু কনফিউজড। যদিও নাটকে অপ্রমিত বাংলার প্রচলন আমাদের তারুণ্যকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে। তাদের মুখের ভাষা পাল্টে গেছে। কিন্তু এটা তো মানতে হবে সেটা নিশ্চয় কথ্য ভাষার শক্তি। তার সে শক্তি আছে বলেই সে তা পেরেছে। আমার কনফিউশনের কারণ ছিল ভাষা আর ডায়লেক্টের তফাৎ। কারণ, ফারুকী নিজেও যখন কথা বলেন তখন কিন্তু প্রমিত বাংলাতেই বলেন। আর তার সিনেমাগুলো ক্রমেই প্রমিত বাংলায় ফিরে যাচ্ছে। যা বলা যায় কিন্তু লেখা যায় না তা নিয়ে তর্ক থাকতে পারে কিন্তু হতাশ আর ক্রোধি হবার কারণ দেখি না। ফারুকীর মতো পরিচালকদের কাছে জাতির প্রত্যাশা বাড়ছে। এবার তার সিডনি আসার কারণ সিডনি ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে সদ্য নির্মিত ছবি শনিবারের বিকেল। ছবিটি বাংলাদেশে এখনও সেন্সরবোর্ডের কাঁচিমুক্ত হতে পারেনি। ছবিটির কাহিনী মর্মস্পশী। সংবেদনশীল আর স্পর্শকাতরও বটে। গুলশানের হলি আর্টিজানের ঘটনা আর যাই হোক কলঙ্কের এক ভয়ঙ্কর অধ্যায়। সে করুণ কাহিনী নিয়ে সিনেমা বানানো একদিকে যেমন সাহসের পরিচায়ক আরেক দিকে সাবধানতার। সরকারী চোখ নিশ্চিতভাবেই দেশের ভাবমূর্তির দিকে। আর মানুষের চোখ খোলা। তাই মুক্তমন উদার সমাজ আর চেতনা ও বোধের কারণেই ছবিটি আলোর মুখ দেখা দরকার। কারণ, এখন আর অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ থাকে না। দেশে না চললেও সিডনিতে বাঙালী বিদেশী সবাই দেখে নিয়েছে এই ছবি। ছবিটি নিয়ে খোদ অস্ট্রেলিয়ানদের মতামত কিন্তু পজেটিভ। জঙ্গীবাদকে নির্মোহভাবে তুলে ধরে দেশ ও সমাজকে মুক্ত রাখতে বিনোদনের বিকল্প কোথায়? তাহলে আমাদের বিবেক কি বলে? মুক্ত হোক শনিবারের বিকেল। বলছিলাম বাংলাদেশের গৌরবের কথা। এই প্রজন্ম আমাদের পরবর্তী এরা আমাদের চাইতে অনেক এগিয়ে। তাই আমাদের সীমাবদ্ধ মন ও মনন অনেক সময় তাদের অনেক কিছু নিতে পারে না। ফারুকীরা এখন বাংলা ইংরেজী মিলিয়ে আন্তর্জাতিক ভাষায় কথা বলেন। তাদের জন্ম স্বাধীন বাংলাদেশে। আমরা পরাধীন দেশে জন্মেছিলাম বলে আমাদের মেরুদ-ে সমস্যা আছে। তাদের কেন তা থাকবে? তারা তাই ক্রিকেটারের মতো বা সফল আর কারও মতো মাথা উঁচু করে কথা বলেন। তাদের জানার পরিধিও বড়। আমার ধারণা, আমাদের বয়সীদের বরং সীমার বাইরে পা রাখা উচিত। কান পেতে শোনা দরকার নবীন প্রজন্ম কি বলছে কেন বলছে। সিডনির সন্ধ্যাটিতে হলভর্তি দর্শক শ্রোতার মন ভরিয়েছে ফারুকী আর তিশা। তাদের বিনয় আর ভালবাসা স্পর্শ করেছে প্রবাসী মানুষের মন। সিডনির তারুণ্যের গর্বিত সংগঠন পথ প্রডাকশন আর ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের কল্যাণে আমরা তাদের সঙ্গ পেয়েছি। বুঝতে পেরেছি কোথায় দাঁড়িয়ে আছে আমাদের বিনোদন জগত। প্রভাতফেরী নামের পত্রিকা ছিল এ কাজের পৃষ্ঠপোষক। যা প্রমাণ করে পৃষ্ঠপোষকতার জন্য এখন বাঙালীরাই যথেষ্ট। জয় বাংলার এই এক শক্তি। দেশ স্বাধীন হবার পর আমরা যেসব হতাশা আর সন্দেহে ভুগতাম রাজনীতি যেসব ঝামেলা আমাদের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে দুর্বল করে তুলেছিল সেগুলো এখন আস্তে আস্তে অদৃশ্য প্রায়। নতুন এই বাংলাদেশ যেন অন্য এক আশার প্রতীক। এ দুই তারকা বিশেষত নায়িকা অভিনেত্রী তিশার বিনয়খচিত আচরণ ছিল চোখে পড়ার মতো। আকাশ সংস্কৃতির কল্যাণে এখন যদি আপনি মিডিয়ায় চোখ রাখেন দেখবেন এদের ভক্ত ফলোয়ার আর দর্শকের সংখ্যা দুনিয়ার বহু দেশ এমনকি অস্ট্রেলিয়ার জনসংখ্যার চাইতেও বেশি। সে গর্বের ধারক কেউ যখন ডাউন টু আর্থ বা মাটির কাছাকছি থাকেন তখন বোঝা যায় মাটিতে পা আকাশে মাথা তোলা এদের দিকে ফিরে তাকাতেই হবে আমাদের। আগেই লিখেছি প্রায়ই আমরা চমকে উঠি বাংলাদেশের নানা উজ্জ্বলতায়। আমাদের রাজনীতি যে বিষয়গুলো দিয়ে আমাদের মনে কালো মেঘের ছায়া তৈরি করে শিল্প সংস্কৃতি খেলা বা অন্য কোন একটা বিষয় তার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে দেখিয়ে দেয় দেশ কতটা এগুচ্ছে। মোস্তফা সরয়ার ফারুকীকে নিয়ে যত তর্ক থাকুক না কেন দেশ বিদেশে তিনি বাঙালী তারুণ্যের জন্য আইকন। বরং তাকে সেভাবে দেশের কাজে লাগাতে পারাটাই হবে দরকারী। এই যে তিনি বললেন যদি একজনকে নিয়েও বায়োপিক বানাতে হয় তো তিনি তা বানাবেন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে। আর কেন তা করতে পারবেন না সেটাও বলেছেন সবিস্তারে। বাংলাদেশের গৌরব ও সম্মানের অনিবার্য এক পীঠভূমি সিডনি এখন তারকা ও সাধারণ বাঙালীর পদভারে জমজমাট। [email protected]
×