ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলায় জেনোসাইড কনভেনশন লঙ্ঘন ॥ ১৭ জুন, ১৯৭১

প্রকাশিত: ০৯:০৩, ১৭ জুন ২০১৯

 বাংলায় জেনোসাইড  কনভেনশন লঙ্ঘন ॥ ১৭ জুন, ১৯৭১

১৯৭১ সালের ১৭ জুন দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। একাত্তরের এই দিনে টাঙ্গাইলের বাশাইল থানার পশ্চিমে কামুটিয়া নর্থখোলা খেয়া পারে পাকবাহিনীর সঙ্গে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের সংঘর্ষ হয়। এ সংঘর্ষে পাকবাহিনীর ৫ জন সৈন্য নিহত হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি ব্যাটালিয়ন ট্যাঙ্ক, আর্টিলারি ও মর্টার সহযোগে চট্টগ্রামে মুক্তিবাহিনীর চাঁদগাজী ঘাঁটির ওপর আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানীদের এ ব্যাপক হামলা ক্যাপ্টেন অলি, ক্যাপ্টেন শামসুল হুদা, ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান তাদের নিজ নিজ বাহিনী নিয়ে সার্থকতার সঙ্গে মোকাবেলা করেন। এ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর কিছু ক্ষতি হলেও পাকবাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয় এবং পাকবাহিনীর ৪৫ জন সৈন্য নিহত হয়। এদিন বিলোনিয়ায় মুক্তিবাহিনীর ঘাঁটির ওপর পাকবাহিনী অতর্কিত আক্রমণ চালায়। দিনাজপুর জেলার ঠনঠনিয়াপাড়া নামক স্থানে পাকবাহিনীর অবস্থানের ওপর আক্রমণের উদ্দেশ্যে মুক্তিবাহিনী অগ্রসর হয়। কোম্পানির দুটি কলামে বিভক্ত হয়ে একটি কলাম সন্মুখভাগ আক্রমণের জন্য মেজর নাজমুল হকের নেতৃত্বে এবং অপর কলাম সুবেদার মেজর এ. রবের নেতৃত্বে বিরল-ঠনঠনিয়া সড়কের ১৫০ গজ বামে ‘কাট অফ’ পার্টি হিসেবে ডিফেন্স নেয়। যুগোস্লাভ পররাষ্ট্র দফতরের এক মুখপাত্র বলেন, শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির দায়িত্ব পাকিস্তান সরকারের। পাকিস্তান সরকারের কার্যকলাপের দরুন আজ প্রায় ৬০ লাখ বাঙালী উদ্বাস্তু হিসেবে ভারতে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং শরণার্থী সমস্যা নিয়ে ওয়াশিংটনে মার্কিন কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হন। পূর্ব পাকিস্তান সফররত ৩ সদস্যের ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি দলের সদস্য মি. জেমস টিন বলেন, ‘ব্রিটিশ পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের সঙ্গে দেশের অবস্থা সঙ্গতিপূর্ণ নয়। ভারতের একতরফা প্রচারের কারণেই বিদেশী পত্রিকায় সঠিক খবর প্রকাশিত হচ্ছে না।’ দলের আরেক সদস্য মিসেস নাইট বলেন, ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনী দুষ্কৃতকারী দমনে অত্যন্ত দ্রুত ও কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে। তবে এই নির্মমতার দরকার ছিল।’ এদিন পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করে, ‘ভারতীয় সেনাবাহিনীর অসম ও পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তে বিনা উস্কানিতে মর্টার ও মেশিনগানের গোলাবর্ষণ করে অসংখ্য বেসামরিক লোককে হত্যা করেছে। কুমিল্লা, যশোর, রংপুর, রাজশাহীর সীমান্তবর্তী এলাকায় এসব ঘটনা নিয়মিত ঘটছে। স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে প্রচারিত খবরে বলা হয়েছে ‘বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের বর্বরতা ও ব্যাপক গণহত্যা অপরাধকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য ইয়াহিয়ার সামরিক চক্র এক ঘৃণ্য কৌশল অবলম্বন করেছে। এদিন ব্রিটিশ পার্লামেন্টের শ্রমিক দলের ১২০ জনের বেশি সদস্য বাংলাদেশে গণহত্যার জন্য ইয়াহিয়ার সরকারকে এককভাবে দায়ী করে এক প্রস্তাবে স্বাক্ষর করেছেন। এই দিন লন্ডনের দি স্টেটসম্যানের সংবাদে বলা হয়েছে, এক শ’ বিশ জন লেবার দলীয় এমপি. গত রাতে হাউস অব কমন্স সভায় বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে স্বীকৃতি দানের দাবি জানিয়েছেন। দাবি উত্থাপনকারীদের মধ্যে ছিলেন লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মি. ইয়ান মিকার্ডো এবং প্রধান দাবি উত্থাপনকারী ছিলেন মি. জন স্টোনহাউস, যিনি গত এপ্রিলে পশ্চিম বাংলাদেশ সফর করে এসেছেন। এই প্রস্তাবে পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনীর বাংলাদেশে আক্রমণের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতিকে আন্তর্জাতিক শান্তির পথে মারাত্মক হুমকি ও জেনেভা কনভেনশনের পরিপন্থী বলে বর্ণনা করা হয়েছে। প্রস্তাবে এ ব্যাপারে জাতিসংঘকে হস্তক্ষেপ করার আহ্বান জানানো হয়েছে। এদিন মার্কিন প্রতিনিধি সভার এশিয়া বিষয়ক সাব কমিটির চেয়ারম্যান মিঃ কর্নেলিয়াস গ্যালাঘার পাকিস্তানকে সবরকম সাহায্য বন্ধ করে দেয়ার জন্য গতকাল একটি সংশোধনী প্রস্তাব এনেছেন। মার্কিন সিনেটেও এ ধরনের একটি প্রস্তাব আনা হয়েছে। এদিকে ইউরোপের বহু দেশ সুস্পষ্টভাবে একথা জানিয়ে দিয়েছে যে, পাকিস্তান বাংলাদেশে এক তরফা সামাধান চাপিয়ে দিতে পারে না। সুইডেন, হল্যান্ড, ইতালি, অস্ট্রিয়া ও হাঙ্গেরী সমেত ইউরোপীয় দেশগুলো এ ব্যাপারে একমত হয়েছে যে, পাকিস্তান বাংলাদেশের ওপর একতরফাভাবে কোন সমাধান চাপিয়ে দিতে পারে না। ইউরোপের এসব দেশ তাদের মিত্র দেশসমূহের সঙ্গে একত্রে মিলে ইয়াহিয়া সরকারকে তাদের এই মনোভাব জানিয়ে দেবে। ’বাংলাদেশে রাজনৈতিক সমাধান দরকার’ শিরোনামে ওয়াশিংটন জাতীয় প্রেস ক্লাবে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং এক বক্তৃতায় বলেন, আমি আপনাদের নেতাদের সঙ্গে একটি সমস্যার শান্তিপূর্ণ অস্থায়ী সমাধানের জন্য এখানে এসেছি। সমস্যাটি প্রেসে ইতোমধ্যে বিষদভাবে রিপোর্ট করা হয়েছে। নিশ্চয়ই আমেরিকান প্রেস জনমত গঠনে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। পূর্ববাংলার ট্র্যাজেডি আজ ভারতের জন্য বড় সমস্যা। এশিয়া জুড়েও এটা এখন গুরুত্বপূর্ণ। ... পূর্ববাংলায় অস্থিরতার জন্য যে উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা আমাদের সামনে হাজির হয়েছে তা শুধু ভারতের একার নয় আপনাদেরও। পূর্ববাংলার ঘটনাবলীর ধরন ও মাত্রা এমন যে সেটি পাকিস্তানের সীমানা অতিক্রম করে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে উদ্বেগের বিষয় হতে বাধ্য। আমাদের দুই দেশের গণতান্ত্রিক নীতি ও মূল্যবোধের প্রতি একটি সাধারণ অঙ্গীকার আছে। এই একই মূল্যবোধ ও নীতিগুলোকে পূর্ববাংলায় নৃশংসভাবে দমন করা হচ্ছে। পূর্ববাংলায় সেনাবাহিনী গণতান্ত্রিক নীতি দমনে নিয়োজিত থাকায় এটি সেখানে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে রূপ নিচ্ছে। গত ডিসেম্বরে সেখানে নির্বাচন হয়েছে একটি এসেম্বলি করে পাকিস্তানে সংবিধান প্রণয়ন করার জন্য। এটা মনে রাখতে হবে যে আওয়ামী লীগের ৬ দফা দাবিগুলো বিচ্ছিন্নতাবাদী কিংবা স্বাধীনতার দাবি ছিল না, স্বাধীনতার দাবি ওঠার পেছনে ছিল মার্চ মাসের ঘটনাগুলো এবং ২৫ মার্চের গণহত্যা শুরুর মাধ্যমে এই দাবি জোরালো হয়। সেনা সন্ত্রাসের ফলে ৬ মিলিয়ন মানুষ পূর্ববাংলা থেকে তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে এবং ভারতে শরণার্থী হিসেবে অবস্থান নিয়েছে। এবং এটি চলমান আছে। প্রতিটি দিন প্রায় ১ লাখ মানুষ আমাদের দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করছে পূর্ববাংলার সীমান্তজুড়ে পাকিস্তান আর্মিরা তাদের তাড়িয়ে দিচ্ছে। সহজ করে বললে প্রতি সেকেন্ডে ১ জন শরণার্থী আমাদের দেশে প্রবেশ করছে। আমরা এই উদ্বাস্তুদের সামর্থ্য অনুযায়ী ত্রাণ দিচ্ছি। আমাদের পূর্ব বাংলার রাজ্যের শিশুদের স্কুলগুলো শরণার্থীদের আশ্রয় প্রদান করার জন্য বন্ধ হয়ে গেছে। আমাদের স্বাস্থ্যসেবা সীমিত এবং সেখানে পরিবহন ও তাঁবু, খাদ্য ও ওষুধ এবং অন্যান্য সম্পদ সঙ্কট আছে। ত্রাণ খরচ মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে।... আমরা মুজিবের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা এবং সুস্থতা নিয়ে চিন্তিত। তিনি খুব উচ্চমর্যাদা এবং বিরল মানবিক গুণাবলীর একজন মানুষ যিনি পূর্ব বাংলার সমগ্র জনগণের প্রাণপ্রিয় নেতা। আমরা আশা করি যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে পাকিস্তানের শাসকদের ওপর সব প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবেন এবং পূর্ব বাংলার মানুষের আশা, আকাক্সক্ষা ও উজ্জীবনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করবেন যা প্রতিফলিত হয়েছিল গত ডিসেম্বরের শেষের দিকে। আমরা সামগ্রিকভাবে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং বিশেষ করে যেসব দেশের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক ভাল তাদের অনুরোধ করছি একটি রাজনৈতিক সমাধানের জন্য পাকিস্তান সরকারকে প্রভাবিত করতে। আমরা যতদিন না একটি রাজনৈতিক সমাধান আসে ততদিন পাকিস্তানে তাদের মিলিটারি ও অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ করার ব্যাপারে সব দেশের প্রতি আহ্বান করছি। আমি আশা করি যে, এই দেশের মানুষ বুঝতে পারবে কেন আমরা পূর্ববাংলার পরিস্থিতির ওপর আমাদের উদ্বেগ প্রকাশ করছি। মার্চ ২৫ থেকে পূর্ববাংলায় যে হত্যাকা- হচ্ছে তার ফলাফল আমাদেরও প্রভাবিত করছে। ...পাকিস্তানের তৈরি সমস্যা যা আমাদের ফসলের ওপর হুমকি এবং আমাদের শান্তি ও আমাদের সন্তানদের জন্য অগ্রগতির প্রত্যাশা হুমকির সম্মুখীন করে তুলেছে। যে কোন দায়িত্বশীল সরকারের জন্য এটি একটি অসহনীয় অবস্থা। তাই আমাদের উদ্বেগ অতি দ্রুত পূর্ব পাকিস্তানে একটি রাজনৈতিক সমাধান তৈরি করা যা বাঙালী এবং তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে গ্রহণযোগ্য। যাতে শান্তি ফিরে আসতে পারে এবং উদ্বাস্তুদের যারা আমাদের দেশে এসেছে তারা বাড়ি ফিরে যেতে পারে। এদিন গায়ানা ইভনিং পোস্ট এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে লিখেন, ছয় কোটি মানুষের হঠাৎ অন্তঃপ্রবাহ ভারতের জনগণের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে মারাত্মকভাবে প্রভাব সৃষ্টি করেছে, কিন্তু মানবতার কারণে এই ছাড় দিতে হবে। মিসেস গান্ধীর মতে, বিশ্বের অন্য কোন দেশে এই মাত্রার অনুপ্রবেশ ঘটেনি। এমনকি এর দশ ভাগের এক ভাগও না। কিন্তু, মিসেস গান্ধী বলেন, শরণার্থীদের সাহায্য করার জন্য ভারত প্রয়োজনবোধে ‘জাহান্নামের মধ্য দিয়ে যাবে’। কিন্তু স্পষ্টতই, এই অবস্থা শুধু ভারতকে উদ্বিগ্ন করার কথা না। পুরো বিশ্বের সহায়তা প্রয়োজন। সবচেয়ে জরুরী প্রয়োজন খাদ্য, আশ্রয় ও ওষুধ। গায়ানার জনগণ তহবিল সংগ্রহ করতে পারেন। ভারতের এই সঙ্কটের মধ্যে গায়ানার এগিয়ে আসা উচিত। গায়ানা নিজেই একটি দরিদ্র দেশ কিন্তু ভারত যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে তাতে গায়ানার মানুষকে ত্যাগ স্বীকার করতে হবে এবং গায়ানার মানুষ জানে কিভাবে ত্যাগ স্বীকার করতে হয়। লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক [email protected]
×