ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বহুমাত্রিক শিল্পরেখায় প্রস্তুত জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনী

প্রকাশিত: ১০:১৬, ১৭ জুন ২০১৯

 বহুমাত্রিক শিল্পরেখায় প্রস্তুত জাতীয়  চারুকলা প্রদর্শনী

মনোয়ার হোসেন ॥ বিশ্বব্যাপী প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল চারুকলার গতি-প্রকৃতি। সেই সুবাদে পরিবর্তিত হয় চিত্রশিল্পীর ছবি আঁকার বিষয় থেকে আঙ্গিক। চিত্রকর্ম সৃজনে যুক্ত হয় নতুন ভাবনার খোরাক। রং আর রেখার আঁচড়ের মাঝে উঁকি দেয় নতুনত্বের আহ্বান। সেই নতুনে আবাহনে পরিবর্তনশীলতাকে ধারণ করে শুরু হচ্ছে জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনী। এখন চলছে চূড়ান্ত মুহূর্তের প্রস্তুতি। জমা পড়েছে সারাদেশের নানা প্রান্তের শিল্পীদের বিভিন্ন মাধ্যমের শিল্পসম্ভার। জল রং, তেল রং, মিশ্রমাধ্যম, ছাপচিত্রসহ চিত্রকলার নানা ধারা নিয়ে হাজির হয়েছেন চিত্রকররা। থাকবে নয়ন জুড়ানো ভাস্কর্য থেকে মন মাতানো স্থাপনাশিল্প। বৈচিত্র্য ছড়াবে ভিডিও আর্ট বা নিউ মিডিয়ার কাজ। এসবের বাইরে ২৩তম আসরে থাকবে পারফরমেন্স আর্ট প্রেজেন্টেশন। এভাবে বহুমাত্রিক শিল্পরেখায় শিল্পকলা একাডেমির চারুকলা বিভাগের আয়োজনে ২৮ জুন থেকে শুরু হচ্ছে একুশ দিনব্যাপী এই প্রদর্শনী। এবারের প্রদর্শনীতে দেখা মিলবে ৩১০ নির্বাচিত শিল্পীর ৩৩০টি শিল্পকর্ম। শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালার কয়েকটি গ্যালারিজুড়ে বিন্যস্ত হবে নানা মাধ্যমের বিবিধ বিষয়ক কাজ। তেইশতম জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনী উপলক্ষে এখন দারুণ ব্যস্ত শিল্পকলা একাডেমির চারুকলা বিভাগ। শিল্পীদের কাজগুলো কতটা সুন্দরভাবে উপস্থাপিত হবে, কোন শিল্পকর্মগুলো পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত হবেÑএমন নানা বিষয়ে জোর প্রস্তুতি চলছে সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। এ বিষয়ে চারুকলা বিভাগের পরিচালক আশরাফুল আলম পপলু জনকণ্ঠকে জানান, আগামী ২৮ জুন প্রদর্শনী সূচনার বিষয়টি চূড়ান্ত। এবারের প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণের জন্য ৬৪ জেলা থেকে জমা পড়ে ৮৫০ শিল্পীর কাজ। সেগুলো থেকে পাঁচ সদস্যের শিল্পকর্ম নির্বাচকম-লীর সদস্যরা ৩১০ শিল্পীর ৩৩০টি শিল্পকর্মকে প্রদর্শনীর জন্য চূড়ান্তভাবে নির্বাচন করেছেন। এই ৩৩০টি শিল্পকর্ম থেকে আবার বিচারকম-লীর রায়ের ভিত্তিতে নয় শিল্পীকে প্রদান করা হবে ৯টি পুরস্কার। ২৮ জুন প্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে পুরস্কারগুলো তুলে দেয়া হবে পুরস্কারজয়ী শিল্পীদের হাতে। এবারের প্রদর্শনী নিয়ে কথা হয় শিল্পকর্ম নির্বাচনে গঠিত নির্বাচকম-লীর সদস্য আনিসুজ্জামানের সঙ্গে। প্রদর্শনীটির গুরুত্ব তুলে ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাপচিত্র বিভাগের এই অধ্যাপক বলেন, নিঃসন্দেহে দেশের চারুশিল্প ভুবনে এটি অনন্য এক আয়োজন। এ ধরনের শিল্পায়োজনে দেশের চারুশিল্প ভুবনের গতি-প্রকৃতি উপলব্ধি করা যায়। প্রবীণদের অংশগ্রহণ কম হলেও সারাদেশের নবীন শিল্পীরা কেমন কাজ করছে-সেই ধারণা পাওয়া যায়। বিশ্ব চিত্রকলায় পরিবর্তনশীলতার ধারাটি দেশের শিল্পীরা কতটা ধারণ করতে পারছেন, সেটাও বোঝা যায়। এবারের প্রদর্শনীতে জমা পড়া কিছু শিল্পীর কাজে সেই পরিবর্তনশীলতার ছোঁয়া পাওয়া গেছে। তারা নতুন কিছু করার চেষ্টা করেছেন। বিশ্বমানের সঙ্গে তাল রেখে তারা শিল্প সৃজন করেছেন। দেশের চিত্রকলা যে একই জায়গায় থমকে নেই, সেই ইঙ্গিতটি পাওয়া গেছে তাদের কাজে। সেই সূত্রে এবার স্থাপনাশিল্প ও ভাস্কর্য বিভাগে নতুন আঙ্গিকের ভাল কিছু কাজ দেখতে পাবেন দর্শনার্থীরা। ঢাকার তুলনায় এবার খুলনা ও চট্টগ্রামের শিল্পীদের কাজ বেশি জমা পড়ার কথা জানান তিনি। আয়োজনের একটি ত্রুটির কথা উল্লেখ করে এই শিল্পী বলেন, সাধারণত বিশ্বের অন্যান্য দেশে এ ধরনের প্রদর্শনী আয়োজনের অন্তত ছয় মাস আগেই ঘোষণা দেয়া হয়। বিজ্ঞাপনসহ নানাভাবে অবহিত করা হয় শিল্পীদের। ফলে শিল্পীরাও তাদের শিল্পকর্ম সৃষ্টিতে চিন্তা-ভাবনার যথেষ্ট সুযোগ পায়। কিন্তু জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনীর মাত্র দুই/এক মাস আগে ঘোষণা দেয়া হয়েছে এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যে শিল্পীদের কাছ থেকে কাজ জমা নেয়। যে কারণে অনেকেই গুছিয়ে ভাল কাজটি করতে বা জমা দিতে পারেননি। প্রদর্শনীতে সব মাধ্যমের ভেতর থেকে বাছাইকৃত একটি শিল্পকর্মকে শ্রেষ্ঠ বিবেচনায় প্রদান করা হবে দুই লাখ টাকা মূল্যমানের বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার। ভাস্কর্য বিভাগে শিল্পকলা একাডেমি সম্মানসূচক পুরস্কারপ্রাপ্ত শিল্পী পাবেন এক লাখ টাকা। এছাড়া ছাপচিত্র, চিত্রকলা ও নিউ মিডিয়া বিভাগে শিল্পকলা একাডেমি সম্মানসূচক পুরস্কারপ্রাপ্ত তিন শিল্পীর প্রত্যেকে পাবেন এক লাখ টাকা। বেঙ্গল ফাউন্ডেশন পুরস্কারপ্রাপ্ত শিল্পীকে প্রদান করা হবে এক লাখ টাকা। এবি ব্যাংক পুরস্কারজয়ী শিল্পীকে দেয়া হবে ৫০ হাজার টাকা। দীপা হক পুরস্কারপ্রাপ্ত শিল্পী পাবেন কুড়ি হাজার টাকা। চিত্রশিল্পী কাজী আনোয়ার হোসেন পুরস্কারজয়ী শিল্পীকে দেয়া হবে ৫০ হাজার টাকা। এবারের প্রদর্শনীতে ধাবমান পৈশাচিক উল্লাস শিরোনামে ভাস্কর্য গড়েছেন ভাস্কর রাসা। এর মাধ্যমে একাত্তরে বাঙালীর ওপর চালানো পাকবাহিনীর গণহত্যার ভয়াল ও মর্মস্পর্শী অধ্যায়টি দেখতে পাবেন দর্শকরা। সীমাবদ্ধতার যন্ত্রণা নামের ভাস্কর্য উপস্থাপন করবেন আরেক ভাস্কর হাবিবা আখতার পাপিয়া। অন্তরতর কথন শীর্ষক সিরিজের মাধ্যমে নিজেকে উপস্থাপন করবেন মোঃ আমিনুল ইসলাম। চকবাজার চুড়িহাট্টার ভয়াবতা উঠে আসবে বিপুল কুমার মালোর কাজে। মিনি করিমের ক্যানভাসে ভেসে উঠবে সুন্দরবন। ফারেহা জেবার শিল্পকর্মের শিরোনাম বীজের গল্প। সুমনা হককে খুঁজে পাওয়া যাবে রং ও রেখা শীর্ষক চিত্রপটে। শিশুবেলার স্মৃতিতে ক্যানভাস সাজিয়েছেন সামিনা নাফিজ। অনন্যা দাসের শিল্পের শিরোনাম প্রকৃতি ও নারী। এছাড়া বিশিষ্ট শিল্পীদের মধ্যে সিদ্ধার্থ দে, ঋতেন্দ্র কুমার শর্মা, সুলতানুল, ইসলাম, সুফিয়া বেগম, বিশ্বজিৎ গোস্বামীর নানা আঙ্গিকের শিল্পকর্ম দেখতে পাবেন শিল্পপ্রেমীরা। তেইশতম আয়োজনে আউট অব মাইন্ড, হিউম্যানিটি, আমার পুনর্জন্ম, মানবদেহ পাখিতে রূপান্তর, প্রেমপত্র ও শিল্পিত বাংলাদেশ শীর্ষক ছয়টি পারফরমেন্স আর্ট উপস্থাপন করবেন ছয় শিল্পী। এই পারফরমেন্স আর্টিস্টরা হলেন রুবাইয়া সাওম দীনা, সৌরভ সাহা প্রেম, এস এম রিয়াদ, নাজমুল হোসেন, সুমনা আক্তার ও সুজন মাহাবুব। ২৮ জুন শুরু হওয়া একুশ দিনব্যাপী প্রদর্শনী প্রতিদিন সকাল ১১টা থেকে রাত আটটা এবং শুক্রবার বেলা তিনটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।
×