ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ব্যাংক ঋণে সুদ কমবে কবে? অধিকাংশই এখনও দুই অঙ্কের সুদ নিচ্ছে

প্রকাশিত: ১০:৩৬, ১৭ জুন ২০১৯

 ব্যাংক ঋণে সুদ কমবে কবে? অধিকাংশই এখনও দুই অঙ্কের সুদ নিচ্ছে

রহিম শেখ ॥ ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে (এক অঙ্কে) নামিয়ে আনার ঘোষণা এখন পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি। উল্টো ঋণের ওপর সুদের হার বেড়েই চলেছে। কোন কোন ব্যাংক ঋণ-বিতরণের ক্ষেত্রে ঘোষণা দিয়েই ২০ শতাংশ হারে সুদ আরোপ করছে। কোন কোন ব্যাংক নিচ্ছে ক্রেডিট কার্ডের চেয়েও বেশি সুদ। এই অবস্থায় ঋণ ও আমানতের গড় সুদহারের ব্যবধান ৪ শতাংশের মধ্যে রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে নতুন বাজেটে। বাজেট ঘোষণার দিন সংসদে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, ‘আমরা ব্যাংক ঋণের ওপর সুদের হার এক অঙ্কের ওপর দেখতে চাই না। এ লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি।’ পরদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, ‘বেসরকারী ব্যাংকগুলো ঋণ ও আমানতের সুদের হার এক অঙ্কে নামিয়ে না আনলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।’ বেসরকারী ব্যাংকগুলো বলছে, গত বেশ কিছুদিন ধরে আমানত সংগ্রহ করতে গিয়ে ব্যাংকের খরচ বেড়ে গেছে। এ কারণে ঋণেও সুদহার বেড়ে গেছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতে, ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে (এক অঙ্কে) নামিয়ে আনতে মনিটরিং জোরদার করা হচ্ছে। জানা গেছে, গত বছরের ১ জুলাই থেকে ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিট ও আমানতের সুদহার ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার ঘোষণা দেয় সরকারী- বেসরকারী ব্যাংকগুলো। তবে, ২০১৮ সালের শুরুর দিকে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের সঙ্গে ব্যাংক মালিকদের বৈঠকে সুদহার ৯ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ব্যাংকের উদ্যোক্তারা বেশ কয়েকটি সুবিধা নিয়েছেন। এরমধ্যে ব্যাংক পরিচালকদের মেয়াদ ও সংখ্যা দুটোই বাড়িয়ে নিয়েছেন। এছাড়া ব্যাংকের করপোরেট কর আগের চেয়ে আড়াই শতাংশ কমিয়ে দেয়া হয়েছে। সরকারী আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারী ব্যাংকে রাখা; ঋণ ও আমানতের হার (এডিআর) সমন্বয়সীমার সময় বাড়ানো হয়েছে। রেপো রেট ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে ৬ শতাংশ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকে রাখা ব্যাংকগুলোর নগদ জমা সংরক্ষণ (ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও বা সিআরআর) এক শতাংশ কমিয়ে সাড়ে পাঁচ শতাংশ করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ৫৭টি বাণিজ্যিক ব্যাংকের মধ্যে অধিকাংশই এখনও দুই অঙ্কের সুদ নিচ্ছে। এর মধ্যে ১৯ শতাংশেরও বেশি সুদারোপ করছে চারটি ব্যাংক। ১৬ শতাংশেরও বেশি সুদ নিচ্ছে ১৭টি ব্যাংক। এ প্রসঙ্গে একটি বেসরকারী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জনকণ্ঠকে বলেন, গত বেশ কিছুদিন ধরে আমানত সংগ্রহ করতে গিয়ে ব্যাংকের খরচ বেড়ে গেছে। এ কারণে ঋণেও সুদহার বেড়ে গেছে। তিনি উল্লেখ করেন, আগে আমানত ও ঋণের সুদহারের পার্থক্য ৩ শতাংশ হলেই হতো, কিন্তু এখন তারল্যসঙ্কটের কারণে তহবিল সংগ্রহের খরচ অনেক বেশি বেড়ে গেছে। এর ফলে ব্যাংকগুলো বাধ্য হয়েই ঋণে সুদহার বাড়িয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, সরকারী-বেসরকারী মিলে ৫৭ ব্যাংকের মধ্যে মাত্র দু’টি ব্যাংক ঋণে সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনতে পেরেছে। ২০১৯ সালের এপ্রিল মাসের বাংলাদেশ ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সরকারী খাতের বিশেষায়িত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও বিদেশী খাতের সিটি ব্যাংক এনএ ৯ শতাংশ হারে সুদ নিচ্ছে। যেসব ব্যাংক ক্রেডিট কার্ড সেবা দিচ্ছে, সেগুলো এই সেবার বিপরীতে দীর্ঘদিন ধরে দুই অঙ্কের সুদ নিয়ে আসছে। কোন কোন ব্যাংক ২৫ থেকে ২৭ শতাংশ হারেও সুদ আরোপ করছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, রফতানি খাতে ৭ শতাংশ ও কৃষিতে ৯ শতাংশ সুদে ঋণ বিতরণ করলেও অন্য খাতে ঋণ বিতরণ করছে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ হারে। এরমধ্যে এসএমই, ভোক্তাঋণ, গৃহঋণ, ট্রেডিং খাত উল্লেখযোগ্য। তবে, মাত্র দুটি ব্যাংক সিঙ্গেল ডিজিট সুদে দীর্ঘমেয়াদী বৃহৎ ঋণও বিতরণ করছে। গত মার্চে নতুন করে ১০টি ব্যাংক সুদ বাড়িয়েছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। এতে আরও বলা হয়েছে, গত ফেব্রুয়ারিতে বাড়ায় ৩১টি ব্যাংক। আগের মাসে (জানুয়ারি) ঋণের সুদহার বাড়িয়েছিল ২৮টি ব্যাংক। আর ডিসেম্বরে এ সংখ্যা ছিল ২৭টি। অর্থাৎ প্রতিমাসে ঋণের সুদহার বাড়ানো ব্যাংকের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। জানা যায়, নতুন বাজেটে ক্রেডিট কার্ড ও ভোক্তা ঋণ ছাড়া অন্যান্য খাতে ঋণ ও আমানতের গড় ভারিত সুদহারের ব্যবধান ৪ শতাংশের মধ্যে সীমিত রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে বাজেট প্রস্তাবের দিন অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘দেশের শিল্প ও ব্যবসা খাতে প্রতিযোগিতায় সক্ষম করার লক্ষ্যে আমরা ব্যাংক ঋণের ওপর সুদের হার এক অঙ্কের ওপর দেখতে চাই না। এ লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি।’ অর্থমন্ত্রী বলেন, ‘পর্যায়ক্রমে আমরা ব্যাংকের মূলধনের পরিমাণ বাড়াব।’ এর পরদিন বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘ব্যাংকের যে সমস্যাটা, আমরা সবসময় চেষ্টা করেছি যেন সিঙ্গেল ডিজিটে থাকে। আর এই সিঙ্গেল ডিজিটে রাখার জন্য আমরা কতকগুলো সুবিধাও দিলাম। কিন্তু অনেক বেসরকারী ব্যাংক সেটা মানেনি।’ তিনি বলেন, ‘এবারের বাজেটে সেটা বলাই আছে, নির্দেশনাও আছে। এ ব্যাপারে আমাদের একটা কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। তাদের এই নিয়মটা মেনে চলতে হবে যেন ঋণটা সিঙ্গেল ডিজিটে হয়। কোনমতেই যেন ডাবল ডিজিটে না যায়।’ ঋণের সুদের হার কেন কমছে না তা নিয়ে গত মার্চে এক অনুষ্ঠানে প্রশ্ন তুলে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘বেশ কিছু সুযোগ সুবিধাও করে দিলাম। যেমন আগে আমাদের সরকারী প্রতিষ্ঠানের ৭০ ভাগ অর্থ সরকারী ব্যাংকে আর ৩০ ভাগ বেসরকারী ব্যাংকে রাখা হতো। ব্যাংকের মালিকরা বললেন ‘এটা যদি ফিফটি ফিফটি করে দেয়া হয়, তাহলে আমরা (সুদের হার) সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনব।’ ঋণের সুদের হার এক অঙ্কের ঘরে এলে বিনিয়োগ বাড়বে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার পরও ঋণ-আমানত অনুপাত বা এডিআর নির্ধারিত সীমায় নামাতে পারেনি অনেক ব্যাংক। চলতি বছরের মার্চ শেষে সীমার ওপরে রয়েছে ১৯ ব্যাংকের এডিআর। গত ডিসেম্বরে সীমার ওপরে ছিল এমন চারটি ব্যাংকের উন্নতি হলেও নতুন করে সীমা অতিক্রম করেছে তিনটি ব্যাংক। একশ’ টাকা আমানতের বিপরীতে ব্যাংকগুলো কী পরিমাণ ঋণ বিতরণ করতে পারবে তা ঠিক করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০১৭ সালের শেষ দিকে হঠাৎ করে ঋণ প্রবৃদ্ধি ব্যাপক বাড়তে থাকায় ঋণ-আমানত অনুপাত (এডিআর) কমিয়ে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত বছরের ৩০ জানুয়ারি এক নির্দেশনার মাধ্যমে প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোর এডিআর ৮৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৮৩ দশমিক ৫০ শতাংশ করা হয়। ইসলামী ব্যাংকগুলোর জন্য ৯০ শতাংশ থেকে নামিয়ে আনা হয় ৮৯ শতাংশ। নতুন নির্দেশনায় বলা হয়, যেসব ব্যাংকের এডিআর সীমার ওপরে রয়েছে ধীরে ধীরে নামিয়ে আনতে হবে। শুরুতে ১৪টি ব্যাংকের এডিআর ছিল নির্ধারিত সীমার ওপরে। কমিয়ে আনার জন্য প্রথমে সময় দেয়া হয় গত বছরের ৩০ জুন। তবে পরবর্তী সময়ে চার দফা সময় বাড়িয়ে সর্বশেষ চলতি বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর নির্ধারণ করা হয়েছে। ব্যাংকাররা জানান, বেশি সুদ দিয়েও আশানুরূপভাবে আমানত পাচ্ছে না অধিকাংশ ব্যাংক। এ কারণে এডিআর বেড়ে যাচ্ছে। কোন কোন ব্যাংকের এডিআর আগে থেকেই নির্ধারিত সীমার ওপরে থাকলেও আমানতের তুলনায় ঋণ বাড়ানো অব্যাহত আছে। মূলত কেন্দ্রীয় ব্যাংক এডিআর সমন্বয়ের সময় বারবার বাড়ানোর ফলে ব্যাংকগুলোর মধ্যে একটি ধারণা তৈরি হয়েছে, পরিস্থিতি খারাপ হলে আবার সময় বাড়ানো হবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১৯টি ব্যাংকের এডিআর এখনও সীমার ওপরে থাকলেও সীমার নিচে নামাতে সক্ষম হয়েছে আল-আরাফাহ্ ইসলামী, শাহ্ জালাল ইসলামী, মধুমতি ও স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক। এর আগে প্রিমিয়ার, মেঘনা, সিটি ও ট্রাস্ট ব্যাংক সীমার নিচে নামাতে সক্ষম হয়েছিল। তবে মার্চে এসে ট্রাস্ট এবং সিটি ব্যাংক আবার সীমা অতিক্রম করেছে। ঋণ আমানত অনুপাতে বর্তমানে সবার ওপরে রয়েছে ফারমার্স থেকে পদ্মায় রূপান্তরিত ব্যাংক। ব্যাংকটির এডিআর গত ডিসেম্বরের ১১৬ দশমিক ৬৭ শতাংশ থেকে বেড়ে ১১৮ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশে উঠেছে। পর্যায়ক্রমে বেসিক ব্যাংকের এডিআর রয়েছে ১১৩ দশমিক ৩৯ শতাংশ, রাকাব ১০৩ দশমিক ৪৯ শতাংশ, ন্যাশনাল ব্যাংক ৯৫ দশমিক ৮১ শতাংশ ও এবি ব্যাংকের ৯৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ। সীমার ওপরে আরও রয়েছে এনআরবি ব্যাংক, মিউচুয়াল ট্রাস্ট, মিডল্যান্ড, এনআরবি গ্লোবাল, আইএফআইসি, ট্রাস্ট, এনআরবি কমার্শিয়াল ও সিটি ব্যাংক। ইসলামী ধারার ব্যাংকগুলোর মধ্যে এসআইবিএল, এক্সিম, ইউনিয়ন, ফার্স্ট সিকিউরিটি এবং ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশের এডিআর রয়েছে সীমার বেশি।
×