ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

নুসরাত হত্যা মামলা

সোনাগাজীর সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম অবশেষে গ্রেফতার

প্রকাশিত: ১০:৩৮, ১৭ জুন ২০১৯

 সোনাগাজীর সাবেক  ওসি মোয়াজ্জেম অবশেষে গ্রেফতার

নিয়াজ আহমেদ লাবু ॥ বহু আলোচিত ফেনীর সোনাগাজী থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোয়াজ্জেম হোসেনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। নুসরাত হত্যার ঘটনায় সাইবার ট্রাইব্যুনাল পরোয়ানা জারির ২০ দিন পর বহু আলোচনা-সমালোচনার পর রবিবার বিকেলে হাইকোর্ট এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করে শাহবাগ থানা পুলিশ। ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা বিভাগের উপ-কমিশনার মারুফ হোসেন সর্দার জানান, বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে হাইকোর্ট এলাকার আশপাশ থেকে মোয়াজ্জেমকে গ্রেফতার করে শাহবাগ থানায় নেয়া হয়েছে। পরে নিজের কার্যালয়ে তিনি সাংবাদিকদের জানান, সোনাগাজী থানা পুলিশকে খবর দেয়া হয়েছে। তাদের কাছে তাকে হস্তান্তর করা হবে। সূত্রগুলো জানায়, ঈদের আগে মোয়াজ্জেম হোসেনের একটি আগাম জামিনের আবেদন হাইকোর্টে জমা পড়লেও সেই শুনানি তখন হয়নি। ফলে আদালতেও তাকে দেখা যায়নি। সুপ্রীম কোর্টের অবকাশ শেষে রবিবার আদালত খুললে হাইকোর্টের নিয়মিত বেঞ্চে নতুন করে আবেদন করেন এই পুলিশ পরিদর্শক মোয়াজ্জেম। সেখান থেকে ফেরার সময়ই পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। মোয়াজ্জেমের আইনজীবী সালমা সুলতানা জানান, বিচারপতি মোঃ মঈনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চে আগাম জামিনের ওই আবেদন করা হয়েছিল। উনার (মোজাম্মেল) নির্দেশনাক্রমে আগাম জামিনের আবেদন করে তা বেঞ্চে উপস্থাপন করেছিলাম। আদালত বলেছিল আগামীকাল কার্যতালিকায় থাকবে। এখন তো আপনারা জানেন যে উনি গ্রেফতার হয়েছেন। তাই আবেদনটি কার্যতালিকায় থাকলেও শুনানির সুযোগ নেই। আগাম জামিন নিতে পরিদর্শক মোয়াজ্জেম হাইকোর্টে এসেছিলেন কি না- এই প্রশ্নে সালমা বলেন, হয়ত এসেছিলেন। না হলে হাইকোর্টের আশপাশ থেকে উনাকে গ্রেফতার করা হলো কীভাবে। হাইকোর্টের ওই বেঞ্চের সহকারী এ্যাটর্নি জেনারেল গাজী মোঃ মামুনুর রশিদ জানান, ওসি মোয়াজ্জেমের আগাম জামিনের আবেদনের বিষয়ে এ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয় থেকে আগেই সকল আইন কর্মকর্তাকে বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে বলা হয়েছিল। হাইকোর্টে দায়িত্বরত গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, পরোয়ানা জারির পর আত্মগোপনে ছিলেন মোয়াজ্জেম হোসেন। নিজের পরিচয় লুকাতে দাড়ি-গোঁফ বড় রেখেছিলেন মোয়াজ্জেম। এ কারণে প্রথমে তাকে চিনতে পারেননি তারা। কয়েকবারের চেষ্টায় তার পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়। এরপরই হাইকোর্টের বাইরে এলেই তিনি শাহবাগ পুলিশের হাতে গ্রেফতার হন। এর গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে লুকোচুরির পর ফেনীর সোনাগাজী থানার সাবেক ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোয়াজ্জেম হোসেন পালিয়ে গেছেন বলেন সরকার ও পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল। তবে ওসি মোয়াজ্জেম দ্রুতই গ্রেফতার হবেন বলে পুলিশ ও সরকারের উর্ধতনরা বলে আসছিলেন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনাল গত ২৭ মে পরোয়ানা জারি করেন। ৩১ মে পরোয়ানার চিঠি ফেনীর পুলিশ সুপার কার্যালয়ে পৌঁছায়। কিন্তু পুলিশ সুপার কাজী মনির-উজ-জামান বারবার বিষয়টি অস্বীকার করতে থাকেন। একপর্যায়ে ৩ জুন রাতে পরোয়ানা হাতে পাওয়ার কথা স্বীকার করেন তিনি। দু’দিন পর বিশেষ বার্তাবাহকের মাধ্যমে পরোয়ানা রংপুর রেঞ্জে পাঠানো হয়। তখন আবার রংপুর রেঞ্জ বলেছে, কাজটি বিধি মোতাবেক হয়নি। পুলিশের এই গড়িমসির সুযোগে মোয়াজ্জেম হোসেন সটকে পড়েছেন। এর আগে তার মুঠোফোনটি সচল থাকলেও এক পর্যায়ে তা বন্ধ পাওয়া গেছে। সে সময় পুলিশের রংপুর রেঞ্জের উপ-মহাপরিদর্শক দেবদাস ভট্টাচার্য জানান, গ্রেফতারি পরোয়ানা রংপুরে এসেছে। কিন্তু মোয়াজ্জেম হোসেন অনুমতি ছাড়াই কর্মস্থলে অনুপস্থিত রয়েছেন। পরোয়ানাটি সোনাগাজী থানার ওসির কাছে পাঠানো হয়েছে। রংপুরে পাঠানোর ক্ষেত্রে বিধি অনুসরণ করা হয়নি। বিধি মোতাবেক কাজ করার জন্য তিনি ফেনীর পুলিশকে জানাবেন। ডিআইজি দেবদাস জানান, আমরা মোয়াজ্জেম হোসেনকে খোঁজার চেষ্টা করছি। এরপর ফেনী জেলা পুলিশ ঢাকায় এসেও অভিযান চালিয়েছে। তবে মোয়াজ্জেমের কোন হদিস তারা বের করতে পারেনি। পিবিআইয়ের তদন্তে থেকে জানা যায়, গত ৬ এপ্রিল সকালে শাহাদত হোসেন শামীম, নুর উদ্দিন ও হাফেজ আব্দুল কাদের মাদ্রাসায় আসে এবং পরিকল্পনা মতো যার যার অবস্থানে যায়। শাহাদত হোসেন পলিথিনে করে আনা কেরোসিন তেল ও অধ্যক্ষের কক্ষের সামনে থেকে আনা গ্লাস নিয়ে ছাদের বাথরুমের পাশে রেখে দেয়। কামরুন্নাহার মনি তিনটি বোরকা ও চার জোড়া হাত মোজা নিয়ে সাইক্লোন সেন্টারের তৃতীয় তলায় রাখে। শাহাদত হোসেন শামীম, জাবেদ ও জোবায়ের সাড়ে ৯টার দিকে বোরকা ও হাত-মোজা পরিধান করে সেখানে অবস্থান নেয়। নুসরাত পরীক্ষা দিতে এলে পরিকল্পনা মতো উম্মে সুলতানা পপি নুসরাতকে তার বান্ধবীকে মারধরের কথা বলে। নুসরাত দৌঁড়ে ছাদে যেতে থাকে। দ্বিতীয় তলায় পৌঁছালে পপি নুসরাতকে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিতে বলে ও ভয় দেখায়। নুসরাত মামলা তুলবে না বলতে বলতে ছাদে উঠলে কামরুন্নাহার মনি, শাহাদত হোসেন শামীম, জোবায়ের ও জাবেদ নুসরাতের পেছনে ছাদে যায়। সেখানে তারা নুসরাতকে একটি কাগজে স্বাক্ষর দিতে বললে নুসরাত অস্বীকৃতি জানায়। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে শাহাদত হোসেন শামীম বাম হাত দিয়ে নুসরাতের মুখ চেপে ধরে ও পপিকে বলে নুসরাতের বোরকার মধ্য থেকে ওড়না নেয়ার জন্য। পপি ওড়না নিয়ে জুবায়েরকে দেয়। জুবায়ের ওড়নার এক অংশ দিয়ে পা বাঁধে ও পপি হাত বাঁধে। এরপর পপি, মনি ও শামীম তাকে শুইয়ে ফেলে। আর জাবেদ কেরোসিন ঢালে নুসরাতের শরীরে। শামীমের ইঙ্গিতে জুবায়ের তার কাছে থাকা দিয়াশলাই দিয়ে আগুন ধরিয়ে দ্রুত বেরিয়ে যায়। শামীম জবানবন্দীতে বলেছে, নুসরাতের মুখ ও পা চেপে ধরায় সেসব স্থানে কেরোসিন দেয়া যায়নি।
×