উল্লাবাড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং উল্লাবাড়ি ইউনাইটেড উচ্চ বিদ্যালয় দুটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল উল্লাবাড়ি গ্রামে ১৯৫৭ -৫৮ সালের দিকে। উল্লাবাড়ি গ্রামটি বর্তমান মাদারীপুর জেলার রাজৈর উপজেলায়। এক সময় এটি বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার মাদারীপুর মহকুমার অন্তর্গত ছিল। সে কতকাল আগের কথা! এতদিনে কত-কত মায়ের ছেলেমেয়ে গ্রামের স্কুল থেকে পড়াশোনা করে জীবিকার পথে বেরিয়ে পড়েছে। আমরা ভাই-বোনেরাও এক প্রকার দাঁড়িয়ে গেছি। বছর দুয়েক আগে এলাকার নির্বাচিত প্রতিনিধি পরিদর্শনে এলে স্কুল দুটির প্রতিষ্ঠাতার নাম নিয়ে প্রশ্ন করেন। মৌখিকভাবে এর একটা উত্তর পেলেও স্কুলের কোথাও তাঁর স্বাক্ষর দেখতে না পেয়ে উষ্মা প্রকাশ করেন তিনি। ভাবখানা এই কেমন গ্রামবাসী আপনারা, প্রতিষ্ঠাতার নামফলকটা পর্যন্ত সংরক্ষণ করেন না! স্কুল দুটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আমার বাবা, শ্রী গৌর চন্দ্র বালা। উল্লাবাড়ি গ্রামে জন্মেছিলেন। মাতা নারায়নী বালা এবং রাজমোহন বালার কনিষ্ঠ পুত্র তিনি। শৈশবে তাঁর বেড়ে ওঠার সময় গ্রামে কোন স্কুল বা পাঠশালা ছিল না। ঠাকুর দা কোদাই বালার ইচ্ছায় গ্রাম থেকে প্রায় আড়াই মাইল দূরে জলিরপাড় পাঠশালা দিয়ে তাঁর শিক্ষা শুরু করেছিলেন পিতা রাজমোহন বালা। এরপর রাজারাম ইনস্টিটিউটে মাধ্যমিক, খুলনা দৌলতপুর কলেজ, কলকাতা রিপন কলেজ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করেন যখন (১৯৪৯), তখন তিনি সতের গ্রামের মধ্যে একমাত্র এমএ পাস যুবক। জন্মের পরই নাতির দিব্যকান্তি মুখখানি দেখে কোদাই বালা তাঁর ছেলেকে বলেছিলেন, ‘তোর এই ছেলেকে পড়াশোনা শেখাস, ও মানুষ হবে,’ ...। ঠিক কথাই বলেছিলেন। মানুষ হওয়ার শিক্ষায় এগিয়ে ছিলেন গৌর চন্দ্র বালা। পিতা কিংবা মাতা- কারও নামে নয়, গ্রামের ছেলেমেয়েদের জন্য স্কুল দুটি গড়েছিলেন তিনি গ্রামের নামে।
আজ ১৮ জুন, বাবার তিরোধান দিবস। ২০০৫-এ এই দিনে ইহলোক ত্যাগ করেন তিনি। কেমন মানুষ ছিলেন আমার বাবা। মায়ের মুখে শুনেছি, স্কুল গড়ার সময় কাছের মানুষ যাঁরা... এমনকি আমার মাও বলেছিলেন, ঠাকুর মা কিংবা ঠাকুর দার নামে করলে ক্ষতি কি? বাবা তা ঠিক মনে করেননি। গ্রামের মানুষের স্কুল হবে গ্রামের নামেই... এই তাঁর ভাবনা। পারিবারিক পরিচয়ের বাইরে গিয়ে মানুষের সর্বজনীনতার মূল্য দিয়েছেন তিনি। বিষয়টি আজীবনই দেখেছি তাঁর স্বভাবে। আমরা যে মানুষ হয়েছি কত-কত ঝড়-ঝঞ্ঝা আর সঙ্কটের মধ্য দিয়ে, সে তো মা ঠিক ঠিক আগলে রাখতে পেরেছেন বলেই। বাবা তো ছিলেন এক সময় যুক্তফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রী (১৯৫৬, বন ও খাদ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে), প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য (১৯৫৪ ও ১৯৭০), গণপরিষদ সদস্য (১৯৫৫)। সে সবের কোন আঁচ বা বাহুল্য আমরা ভাই-বোনরা টের পাইনি কখনও। ফরিদপুর শহরে বেড়ে ওঠা আমাদের শৈশব- কৈশোরের দিনগুলো ছিল উদার সামাজিক আবহে পূর্ণ। স্থাবর-অস্থাবর বিষয় সম্পত্তি কিছুই করেননি তিনি। সে সবের স্বাভাবিক প্রস্তাবও হাসিমুখে ফিরিয়ে দিয়েছেন। এ রকমটা মানুষের ক্ষেত্রে খুব সহজে দেখা যায় না। বাবার স্বভাবের এমন অনেক দিক আছে, ভাবতে গেলেও আমরা অবাকই হই একেক সময়।
পাকিস্তানী শোষক বিরোধী আন্দোলনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে একযোগে কাজ করেছেন বাবা। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা আন্দোলনে বৃহত্তর ফরিদপুরে এবং ফাতেমা জিন্নাহর প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী হিসেবে নির্বাচনকালে ১৯৬৪-এ দক্ষিণবঙ্গে দিনের পর দিন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে থেকে কাজ করেছেন। আইয়ুব খানের সামরিক শাসনকালে বৃহত্তর ফরিদপুর জেলার আওয়ামী লীগের সকল সভার সভাপতি হতেন গৌর চন্দ্র বালা। গোটা ষাটের দশকে ফরিদপুর শহরের অম্বিকা ময়দানে এই জনসভাগুলোতে বাড়ি থেকে চেয়ার-টেবিল পর্যন্ত টেনে নেয়া হতো। মা এবং বড়দার স্মৃতিচারণ থেকে ঐতিহাসিক এসব কত তথ্য জেনেছি! ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় বেসামরিক জোনের ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব¡ পালন করেন তিনি। সীমান্ত-শহর ভারতের বনগাঁয় অবস্থান করেন শরণার্থী মানুষজনের প্রাথমিক সহায়তা নিশ্চিত করতে। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বাবাকে কলকাতায় এসে কাজ করতে অনুরোধ করলেও তিনি যেতে পারেননি বনগাঁ ছেড়ে। গ্রাম থেকে আসা নিজের মানুষদের ছায়া থেকে সরে যেতে চাননি তিনি। এমন কি জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার প্রস্তাবও ফিরিয়ে দিয়েছেন। বাবা যে ছিলেন গ্রাম-সমাজের আত্মার আত্মীয়। আজীবনই সে পরিচয়টিকে ধরে রেখেছেন তিনি। মানুষের প্রতি ভালবাসার তাঁর দরদী মুখখানি আমি দেখেছি।
এই যে মানুষটি, গৌর চন্দ্র বালা, নিজের হাতে গড়া প্রতিষ্ঠানে নামফলক টানাবার প্রয়োজন বোধ করবেন না, সেই তো স্বাভাবিক। যে প্রশ্ন তুলেছেন জন প্রতিনিধি, ভাইপো-ভাইঝিদের মুখে তাই শোনার পর থেকেই মনের মধ্যে খচখচ করে চলেছে। কেন যে এতদিন আমাদেরও মনে এল না। পিতার কর্মের একটা স্মারক গেঁথে রাখা প্রয়োজন! সময়ের সাথে সবই যে মুছে যায়!
গ্রাম থেকে কতো আগেই দূরে চলে এসেছি আমরা। যাঁরা আছেন সেখানে স্বজন, স্কুলের সাথে যুক্তও আছেন- কারও মনেই যে আসেনি এতদিন- সে হয়তো আমাদের হাতে দিয়ে হবে বলেই। পিতার কাজকে এগিয়ে নেয়ার দায়িত্ব সন্তানদের। সেদিন বাড়িতে এই লক্ষ্যেই এক হয়েছিলাম আমরা বাবার জন্ম ভিটায়, তাঁর নাড়ী পোতা যেখানে। বছরে একবার না গেলে শান্তি পাই না। মন্দিরে তাঁর যে ছবিটি, সেই যেন তাঁর মূর্তিমান প্রতীক। আজ বাবার এই প্রয়াণ দিবসে তাঁর স্মৃতির প্রতি আনত হই বার বার।
লেখক : চিকিৎসক, কনিষ্ঠ কন্যা